খেলাঘরখেলাঘর

আমার ছোট্টবেলা     

এই ভাবে গ্রীষ্ম শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে বর্ষা এসে পড়ত। শুরু হয়ে যেত আর এক মজা।
প্রচন্ড গরমের মাঝে একদিন দেখা যেত দক্ষিণ-পুর্ব আকাশে ঘন কাল মেঘ। ক্রমে সে মেঘ সমস্ত আকাশ ঢেকে ফেলত, শুরু হত প্রথমে টিপি টিপি , আর তারপর ঝমঝমিয়ে প্রবল বৃষ্টি। অত গরমের পর বৃষ্টি দেখে আনন্দে সবাই উঠোনে বেরিয়ে পড়তাম জলে ভেজার জন্য। দাদু-দিয়ানি বকাবকি শুরু করে দিতেন, পাছে জলে ভিজে অসুখ-বিসুখ করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
বর্ষার প্রাথমিক আনন্দ কেটে যাবার পর শুরু হয়ে যেত ঘ্যান-ঘ্যানানি বৃষ্টি, এতে খারাপ লাগলেও একটা ব্যাপারে খুব উতসুখ থাকতাম।
চারিদিকে শোনা যেত বন্যার খবর, এখন শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু সে সময়ে অতটা বুঝতাম না। বন্যার খবর পাওয়ার পরই উতসুক থাকতাম এই ভেবে কবে আমাদের দিকে ওই জল আসবে, আর বড় 'পাগারে' পড়বে!
'পাগার' কথাটার মানে ত' নিশ্চয়ই জান না। এর অর্থ হল একটা বড় ডোবার মত গর্ত। গ্রামের বাড়িঘর বন্যার জলের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বাড়ি তৈরীর সময় ভিটে উঁচু করতে হত। সে সময় কোন জায়গা থেকে মাটি  কেটে নেওয়া হত। অনেক মাটি লাগত কিনা। তাই বড় বড় গর্ত তৈরী হয়ে যেত, তাদেরই কোনটার নাম হয়ে যেত 'বড় পাগার' আবার কারও নাম হত 'ছোট পাগার'। 
বিশাল বড় নদী যমুনা খুব কাছে না থাকলেও ঐ নদীর জন্যই বোধ হয় বন্যা হত প্রতি বছর। বৃষ্টির জলে ওই নদী ফুলে ফেঁপে উঠে ভীষনাকার হয়ে যেত। উপচে পড়া নদীর জল ঢুকে পড়ত আশ পাশের ডাঙা জমিতে, গ্রামে-গঞ্জে। আমাদের গ্রামে আসত একটা নালা পথ দিয়ে যাকে বলে 'জোলা'।
জোলাপথের থেকে পাগারগুলো সাধারনত একটু বেশী গভীর হয়। তাই জোলাপথের জল পাগারে পড়ার সময় জোর শব্দ হয় ঝরণার মত। সে শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়।
কোন বছর সে শব্দ দিনে দুপুরে শোনা যেত, আবার পরের বারই হয়ত ঘুমভাঙা ভোরে শুনতে পেতাম। সে শব্দের অনুভুতি, আনন্দ তোমাদের বোঝান আমার কম্ম নয়।
এই খানে একটা কথা বলে নি। সেই যে আমার ঘুম ভাঙানোর কথা বলেছিলাম একেবারে শুরুতে-- সেই যে ঘুঘুর ডাক বা হেমন্তের ভোরের শিশিরের শব্দে ঘুম ভাঙার কথা, সে রকম বর্ষার কোন কোনও ভোরে ঘুম ভাঙত বৃষ্টির মিষ্টি শব্দে! টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ ভারি মিঠে, তা সে ঝিরঝির করেই হোক আর মুষলধারেই হোক। এমন শব্দ শুনেছ কখনও? কেউ কেউ শুনে থাকতে পার যারা টিনের চালওয়ালা বাড়িতে থাক।
যে কথা বলছিলাম।
পাগারে জল এলেই গ্রামের সব ছেলেরা, এমনকি বড়রাও, এসে ভিড় জমাত পাগারের ধারে। অতি উতসাহে ছোটরা কেউ কেউ আবার নেমে পড়ত জলে, বার বার সাঁতরিয়ে এপার ওপার করত।
আমি সাঁতার জানতাম না বলে আমার জলে নামা প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। এছাড়াও ছিল নতুন জলে স্নান করে  অসুখ-বিসুখ হওয়ার ভয়ও।
বন্যার জল ক্রমশঃ বাড়তে  বাড়তে সমস্ত ডাঙা জমি ডুবিয়ে দিত। চারিদিক জলে জলময় হয়ে যেত, উঁচু ভিটেওয়ালা বাড়িগুলো জলের মধ্যে দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে থাকত শুধু।
খেলা ধুলা, পাঠশালা, বন্ধুদের সাথে দেখাশোনা সব বন্ধ একদম। বড়রাই শুধু নৌকা করে এখানে ওখানে যাওয়া আসা করতেন।
যাদের নৌকা ছিল না তারা বানিয়ে নিত কলাগাছের ভেলা। চার পাঁচটা কলা গাছ পাশাপাশি রেখে আড়াআড়ি দু'তিন জায়গায় বাঁশ বেঁধে নিলেই হয়ে যেত ভেলা। দু'একজন মানুষ সহজেই যাতায়াত করতে পারত।
বাড়ির দক্ষিন দিকে একটা স্বর্নচাঁপার গাছ ছিল। একটা দুটো কালবৈশাখী হয়ে গেলেই গাছ ফুলে ফুলে ভরে যেত। আর বর্ষায় সংখ্যাটা দ্বিগুন হত, আর তার গন্ধে চারি দিক ম ম করত। গন্ধরাজ ফুলও চাঁপার সাথে পাল্লা দিয়ে একই কায়দায় ফুটত।
ওর পাশেই ছিল  একটা কদম ফুলের গাছ, শ্রাবণ মাসে ফুটত কদম ফুল, গাছ ভরে। ভারি সুন্দর দেখতে ছিল ফুলগুলো, আর কি তার মাতাল করা গন্ধ !
বর্ষার জল পেলে বা তারও আগে থেকে বাগানের মাটি ফেটে বেরত ভুঁইচাঁপা ফুল। হ্যাঁ, ফুল আগে ফুটত, তারপর গাছ বেরত।
আরও নানা ধরনের লিলি ফুলের গাছ ছিল বাগানে, কত তার রঙ, কত তার গন্ধ !
জোলার পথে যেখান দিয়ে জল ঢোকে তার মুখে বাঁশের একটা ত্রিকোনাকার ফ্রেমের মত বানিয়ে তাতে বাঁধা হত খুব বড় মাছধরা জাল। বাঁধত জেলে ভাইয়েরা। এর নাম ছিল 'খরাজাল'। স্রোতের টানে ছুটন্ত জলে থাকা মাছেরা সব আটকে যেত জালে। নানা ধরনের ছোট বড় মাছ ধরা পড়ত, মামারা কিনে আনতেন মাঝে মাঝে।
জেলেভাইরা নানা রকমের জাল ব্যাবহার করতেন মাছ ধরার জন্য। টানা জাল, খ্যাপলা জাল- এমন সব নাম ছিল জালের। সব মনে নেই।
অনেক সময়  মাছ কিনতেই হত না, কেননা মামারা নানা  কায়দায় মাছ ধরতেন নিজেরাই। সে সব বলি দু'একটা। প্রথমেই বলতে হয় 'দোয়ার'-এর কথা। এটা ছিল বিশেষভাবে তৈরী একটা খাঁচার মত, বাঁশের সরু সরু কাঠি দিয়ে তৈরী। ভেতরে যাবার রাস্তা থাকে, কিন্তু বেরোবার রাস্তা মাছেরা খুঁজে পায় না, এমন ভাবে বানানো সেটা। খাবারের লোভে একবার ভেতরে ঢুকলে মাছ আর বেরতে পারে না। হ্যাঁ, খাবার ত দিতেই হত। ধান গাছের মধ্যে থাকত ফড়িং এর মত এক ধরনের পতংগ। সেগুলোই ছিল মাছেদের খাবার। যেখানে জলের স্রোত আছে এমন জায়গায় দোয়ার পাতা হত। সন্ধ্যাবেলায় পাতা হলে পরের দিন ভোরে অনেক মাছ পাওয়া যেত। সবই ছোট মাছ।
বড় মাছ ধরার জন্য ছিল 'জেয়ালা' দেওয়া। এটা একটা মাছধরা ছিপই, তবে তার হাতলটা ছিল মোটা কঞ্চি বা বাঁশের ডগা দিয়ে বানানো আর সুতোও ছিল বেশ মোটা। আর বঁড়শিটা ? সেটাও ছিল বড়সড়, যাতে আর, বোয়াল বা রিঠার মত বড় মাছেরা টোপ গিলতে পারে।
তার টোপ ছিল কি বলত ? একটা আস্ত জ্যান্ত ব্যাঙ বা ছোট মাছ! এর পিঠে বঁড়শি গেঁথে ছিপটা গাড়া হত মাটিতে এমনভাবে, যাতে ব্যাঙ বা মাছ জলের ঠিক ওপরে ভেসে ছটফট করতে থাকে আর জলে খলবল করে আওয়াজ তোলে।
বুঝতেই পারছ অল্প জলেই বড় মাছ ধরার জন্য এই জেয়ালা দেওয়া হত। অল্প জল না হলে মাটিতে ছিপ গাড়া হবে কি করে বল ? জ্যান্ত ব্যাঙ বা মাছের শব্দ পেয়ে বড় মাছেরা এসে খপ করে টোপটা গিলে ফেলত বঁড়শি শুদ্ধ । সন্ধ্যায় পেতে রাখলে সকালে  প্রতিদিনই কোন না কোনও মাছ ধরা পড়ত।
বড়মামা আর ছোটমামা ছিপে মাছ ধরতেন। বর্ষার শুরুতেই তৈরী হত সেই ছিপ।আমাকেও দিতেন একটা ছোট ছিপ, ছোট মাছ ধরার জন্য। বঁড়শিতে কেঁচো গেঁথে ছিপ ফেললে একটু পরেই ফাতনা নড়ে উঠত, আর মওকা বুঝে টান মারতেই উঠে পড়ত মাছ- ট্যাংরা, পুঁটি বা চ্যালা-- এমন মাছই উঠত সব।
ফুলমামা আর সোনামামা  আবার গামছা দিয়েও মাছ ধরতেন!  কিভাবে বলত? বর্ষায় অনেক মা মাছই ছোট ছোট অসংখ্য বাচ্চা নিয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। মামারা দুজনে আড়ি পেতে থেকে সেরকম মাছ গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতেন।একবার এমন করে মাছ ভেবে ব্যাঙের বাচ্চা তুলে দাদুর কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলেন মামারা। ব্যাঙাচিরা  অবিকল মাছের বাচ্চার মত দেখতে কিনা!

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।