খেলাঘরখেলাঘর

আমার ছোট্টবেলা

মাছ ধরা ছাড়া মামাদের কি আর কোনও কাজ ছিল না ? থাকলেই বা কি ! নৌকা ছাড়া ত কোথাও যাওয়া যেত না, তাছাড়া তাওত মোটে একখানা! একজন নিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল আর কি! চারিদিকে এমন জল দেখতে দেখতে শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম।
দাদুও মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তেন মাছ ধরতে, অবশ্যই নৌকা নিয়ে। আমাকে ডেকে নিতেন মাঝে মাঝে। হরিশদা নৌকা বাইত।
ধানক্ষেতের  মজা কি বলত ? জল দাঁড়িয়ে যত উঁচু হত, ধান  গাছগুলো তত বাড়ত। দাদু হরিশদাকে ধানক্ষেতের মধ্যে নৌকা নিয়ে যেতে বলতেন। দাদুর হাতে থাকত একটা অস্ত্র যা দিয়ে মাছ ঘায়েল করা যায়। তার নামটা হল 'কোঁচ'। এমন নাম শুনেছ কখনও? অদ্ভুত না?
এটা দেখতেও অদ্ভুত। একটা লম্বা বাঁশের ডগায় ঝাঁটার মত করে  আঙুলের মত মোটা মোটা আটদশটা লাঠি বাঁধা। লাঠির মাথায় আবার বর্শায় যেমন থাকে তেমনি লোহার সরু সরু ফলা লাগানো। লাঠির ডগা গুলো আবার গোলাকার করে ছড়ানো থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন লম্বা হাতলওয়ালা একটা বিরাট ঝাঁটা।
ধানক্ষেতের মধ্যে ঢুকে খুব ধীরে ধীরে নৌকা চালাত হরিশদা যাতে শব্দ না হয়, আর তীক্ষ্ণ নজর রাখত ধানগাছগুলোর দিকে। দাদুও খুব নজর করতেন। কি দেখতেন বলত ? কোনও গাছ নড়ছে কিনা !
গাছ নড়া মানেই হল ওর গোড়ায় কোনও মাছ আছে। গাছের গোড়ায় জমে থাকা  প্রিয় খাবার শেওলা খাচ্ছে। হরিশদা দেখতে পেলে ইশারা করত দাদুকে বা তিনি নিজে দেখতে পেলেও, কোনও শব্দ না করে ছুঁড়ে মারতেন কোঁচখানা। অতগুলো বর্শা কিনা, একটা না একটা মাছের গায়ে বিঁধে যেতই। সেখানা বিঁধে গিয়ে মাছ ছটফট করত। মাছ গেঁথেছে বুঝলে হরিশদা ঝাঁপিয়ে পড়ত জলে আর তুলে আনত মাছটা কোঁচ থেকে ছাড়িয়ে। এভাবে অনেক বড় বড় মাছ ধরতে দেখেছি।
কোনও দিন শুধুই নৌকা করে ঘুরতে যেতেন দাদু অনেক দূরে দূরে। একদিনের কথা মনে আছে। এক চাষিভাইয়ের বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় দাদু তার নাম ধরে হাঁক পাড়লেন। সে এলে হাঁসের ডিমের দাম জিজ্ঞেস করলেন। টাকায় বিশটা না আঠারটা, তা নিয়ে বিস্তর দর কষাকষি হয়েছিল সেদিন। শেষ পর্যন্ত টাকায় বিশটা রফা হয়েছিল।
খুব অবাক হচ্ছ হয়ত, কিন্তু তখন একটাকা রোজগার করতে কালঘাম ছুটে যেত! টাকার দাম এখন কমে গেছে, তাই এখন একটা হাঁসের ডিমের দাম টাকা পাঁচেকের মত বোধ হয়!
পাট কি তা নিশ্চয়ই জান। ওখানে অনেক পাট চাষ হত। খুব সম্ভব বর্ষার শেষের দিকে পাট বড় হয়ে গেলে, সেটা কাটা হত। পাট কেটে আঁটি বেঁধে বেঁধে, সেই আঁটি গুলো জলে ডুবিয়ে পচানো হত। পাটকাঠি দেখেছ ত ? খুব হালকা। পাট গাছগুলোও হালকা। জলে ডুবতে চাইত না। অনেকগুলো আঁটি পাশাপাশি জলে ভাসিয়ে তার ওপর বাঁশ বা গাছের ডাল-- এই সব চাপিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হত।
ক'দিন পর জলে ডুবে থেকে গাছগুলো পচে গিয়ে ভারি দুর্গন্ধ ছড়াতো। হরিশদা, আর আরও অনেকে ওই পচা গাছ থেকে পাটের আঁশ ছাড়াতো। পাটগাছের ছালটাই হল পাটের আঁশ। ছাল ছাড়াবার পর যেটা পড়ে থাকে, সেটাই হল পাটকাঠি। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করতে হত এসব। দিনভোর কাজ করত ওরা। কি কষ্ঠ বল! পাট ছাড়িয়ে গোছা বেঁধে বেঁধে কাপড় মেলার মত করে রোদে শুকতে দিত ওরা।
শ্রাবনের শেষের দিকে জলটা বেড়ে গিয়ে কেমন যেন শান্ত হয়ে যেত, জলে ভেসে আসত নানা ধরনের জলজ গাছ আর শেওলা। অদ্ভুত দেখতে সে সব। আর ছিল কচুরীপানা। তাতে ফুটে থাকত অজস্র হালকা নীল রঙের ফুল। দূর থেকে ভারি ভাল লাগত দেখতে। এটা কি জান যে কচুরীপানার ফুলের ব্যাসনভাজা খাওয়া যায় আর সেটা সুস্বাদু ? ঘাটে নৌকা বাঁধা থাকলে তার গলুইয়ের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে শুয়ে এই সব দেখতাম। একদিনের কথা খুব মনে আছে। জলে পচে মরে যাওয়া একটা ঝোপের একটা কাঠি কি করে যেন জলের ওপর সোজা দাঁড়িয়ে ছিল আর একটা ফড়িং সেই কাঠিটার মাথায় বসার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একবার করে বসছে আবার পরক্ষণেই উড়ে যাচ্ছে! কিছুতেই আর বসা হচ্ছিল না! এরকম ভাবে কতবার আর কতক্ষণ যে করেছিল  সে বলতে পারব না। শেষে আমিই অধৈর্য্য হয়ে সেখান থেকে চলে গেছিলাম!
আশ্বিনে, কোন কোনও বার ভাদ্রের শেষের দিকে, জল নামতে শুরু করত। তখন বাড়ির পেছন দিকের জমিতে জল কমে যেত। এখানে নৌকা বাঁধা থাকত অনেক সময়। একদিন সাহস করে দড়ি খুলে হাতে ছোট একখানা লগি নিয়ে নৌকা বাইবার চেষ্টা করেছিলাম। দু'এক বারের চেষ্টায় পেরেছিলাম নৌকা চালাতে। দেখলে মনে হতে পারে  এটা সোজা কাজ, কিন্তু মোটেই সহজ নয়। ভারি শক্ত নৌকা বাওয়া। দাদু কিন্তু সেদিন দেখেছিলেন, তবে কিছু বলেন  নি। কেন বল দেখি ?
তোমাদের মত ছোটরা এটা কখনও না কখনো নিশ্চয়ই ভাব, 'ধ্যাত, কিচ্ছু ভাল লাগে না। কবে যে বড় হব!' কোনও সময় হয়ত বড়দের মত কোন কাজ করেও ফেল সাহস করে। বাবা-মা সেটা দেখেও না দেখার ভান করেন। কেন বল দেখি ? কারন তাঁরা জানেন, তোমাদেরও ত বড় হয়ে একা একাই সব কাজ করতে হবে একদিন!  
আমার দাদুও একই কারনে কিছু বলেন নি, কেন না আমাকেও কোন দিন নৌকা বাইতে হতেও ত পারে একা একাই!
অবশ্য তেমন কাজ করতে হয় নি। কলকাতায় আর নৌকা বাইব কি করে ?
ঠিক ধরেছ! আমার  যখন বছর দশেক বয়স তখন এমনই এক শ্রাবণ মাসের থৈ থৈ জলের মধ্যে নৌকা করে মা ভাই বোনেদের সাথে পাড়ি জমিয়েছিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। আর কোনদিন ফিরে যেতে পারিনি মামাবাড়ির গ্রামে, অথবা পাবনা শহরে।
অনেক কিছু লেখা হল, আবার অনেক কিছুই লেখা হল না। কিন্তু কি আর করা যায়। একদিন ত থামতেই হয়। তাই না ?


(সমাপ্ত)


সন্তোষ কুমার রায়,
রুপনারায়নপুর।

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।