খেলাঘরখেলাঘর

 

-পর্ব তিন-

শীতের দুপুরে পাঠশালা থেকে ফিরে কোন কোন দিন দেখতাম 'মলন' দেওয়া হচ্ছে। উঠোনের মধ্যে বৃত্তাকারে ধানশুদ্ধ গাছগুলোকে উঁচু করে সাজিয়ে ফেলা হত। তারপর এর ওপর দিয়ে একজোড়া বলদ হাঁটানো হত। এর নামই 'মলন' দেওয়া।

কেন দেওয়া হত বলতো? তখন তো গ্রামের দিকে গাছ (খড়) থেকে ধান ছাড়ানোর মেশিন ছিল না। তাই এই পদ্ধতি। ক্রমাগত হাঁটার ফলে বলদের পায়ের চাপের গাছ থেকে ধান আলাদা হয়ে তলায় পড়ে যেত। এর পর ওপর থেকে খড় ঝেড়ে তুললেই হল। হাঁটার সময় গরুদের মখে দড়ির তৈরি জাল এঁটে দেওয়া হত যাতে ধানে মুখ দিয়ে কাজে ফাঁকি না দেয়।

খড় ঝেড়ে তোলার পর উঠোনে যে ধান পড়ে থাকত তাতে অনেক খড়ের টুকরো থাকত। কি বলে এগুলোকে? কুড়ো বলে বোধ হয়!

পরে এইসব টুকরো বা কুড়ো গুলোকে ঝাড়তে হত। তারও আবার একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল। সেটা পরে বলছি।

একদিন মলনে উঠে বলদগুলির পিছন পিছন খুব ছুটেছিলাম। বড়দের নিষেধ শুনিনি, ফলে শাস্তিও পেতে হল হাতে হাতে। সারা গায়ে কুড়ো লেগে কি চুলকানি, বাপরে! সেই প্রথম আর সেই শেষ। ন্যাড়া কবার আর বেলতলায় যায় বল!

দু'জন মহিলা ঐ সময় আসতেন ধান থেকে খড়ের কুড়ো বা টুকরো গুলোকে আলাদা করার কাজে। যেখানে খুব বাতাস বয় সেরকম খোলামেলা কোন জায়গায় কুলোতে করে কুড়ো শুদ্ধু ধান মাথার উপর নিয়ে অল্প অল্প করে নীচে ফেলা হত। ধান ভারি হওয়ায় সোজা নীচে পড়ত। কিন্ত কুড়োগুলো তো হালকা। সেগুলো হাওয়ায় উড়ে গিয়ে কিছু দূরে পড়ত। ফলে দুটো স্তূপ হত - যার একটায় ধান আর অপরটায় কুড়ো থাকত। বেশ মজার বলে মনে হত ব্যপারটা।যাঁরা একাজ করতেন তাঁদের একজনের নাম আমার মনে আছে। তাঁর নাম খুশি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজার মজার কথা বলতেন আর আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর চুলগুলি ছিল পেকে একেবারে সাদা আর কোঁকড়ানো। আর সারা মুখের চামড়ায় ছিল বয়সের ভারে কাটা আঁকিবুকি। নাম খুশি বলেই বোধহয় সর্বদাই হাসি খুশি থাকতেন।

হরিশের কথা আগেও বলেছি। আমার থেকে বয়সে বেশ বড়। কখনও বলতাম হরিশভাই, কখনও হরিশদা আবার কখনও শুধু নাম ধরে বলতাম। সে ছিল বাড়ির কাজের মানুষ। কিন্ত তাহলেও ছিল আমার বন্ধুর মত।

শীতের এক দুপুরে আমাকে বলল, চল, বেড়িয়ে আসি। কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে বলল, গেলেই দেখতে পাবে।

সেদিন একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে চললাম ধানকাটা হয়ে গেছে এমন সব ক্ষেতের আল ধরে। দূরে দূরে ক্ষেতের মধ্যে একরকম ঘর দেখতে পেলাম যেগুলো এস্কিমোদের বাড়ি 'ইগলু'র মত দেখতে। ওদের বাড়িগুলো বরফ দিয়ে তৈরি হয়, কিন্তু এগুলো খড় আর বাঁশ দিয়ে।

এরকম একটা ঘরের কাছে থেমে হরিশদা বলল- এখানে দাঁড়াও আমি আসছি।

ঘরের দিকে ভাল করে নজর দিলাম। ঘরটা খড় আর বাঁশ দিয়ে তৈরি বটেই এমনকি মেঝেতেও পুরু করে খড় বিছানো। গদির মত নরম। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরটা বেশ গরম। দুজনে আরাম করে শোয়া যায়। হরিশদার কাছ থেকে পরে জানতে পারি যে ক্ষেতে রাত পাহারা দরকার হলে এখানে রাতে শোয়া হয়।

যাই হোক একটু পরেই হরিশদা এল শুঁটি সুদ্ধ এক গোছা মটর গাছ নিয়ে। ঘর থেকে একটু দূরে খানিকটা খড় যোগাড় করে আগুন তৈরি করল আর মটর গাছগুলো তাতে ফেলে দিল।

কিছুক্ষনের মধ্যেই পট  পট শব্দ করে সবটা পুড়ে কালো ছাইয়ে পরিনত হল।
কালো পোড়া মটরশুঁটিগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে আমাকে দিয়ে বলল -খাও।
ছাইমাখা পোড়া সেই মটরশুঁটি যে কি সুস্বাদু কি বলব। একবার সুযোগ পেলে খেয়ে দেখ। ভুলতে পারবে না।

শীতের বিকেলে বড়রা একটা খেলা খেলতেন। সেটা ছিল কতকটা ক্রিকেট আর কিছুটা বেসবল মিলিয়ে একটা খেলা। এটার নাম ছিল 'তেকাঠি' খেলা। বেশ ভাল লাগত খেলাটা দেখতে। ওরা মাঝে মাঝে ফুটবল অথবা হাডুডু এসবও খেলতেন। আমারও একটা ছোট্টমত ফুটবল ছিল। ছোটমামা বলতেন এক নম্বর বল। এর চাইতে ছোট বল নাকি হয় না। বাবা শিলং থেকে পাঠিয়েছিলেন সেটা। ছোটমামা হাওয়া ভরে দিতেন তাতে। আমি আমাদের উঠোনে খেলতাম।

বিকেল হলেই দেখতাম মামি, মাসিরা পাঁচ ছটা লন্ঠণ নিয়ে বসতেন। লন্ঠনে তেল ভরা, পলতে ঠিক করা, ময়লা চিমনিগুলো ছাই দিয়ে ঘষে ঝকঝকে করে তোলা - এইসব কাজ থাকত রোজ রোজ। তখন, মানে আজ থেকে বছর ষাটেক আগে মামার বাড়ির গ্রামে বিদ্যুতের আলো আসেনি। পাবনা জেলার সেই জামিরতা গুধিবাড়ী গ্রামে আজও বিদ্যুতের আলো এসেছে কিনা জানিনা।

কখন যে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যেত বোঝাই যেত না। সন্ধ্যা নামলে আমার ভালোও লাগত আবার ভয়ও করত।

বিকেল হলেই কাজের লোক এসে গরু দুইয়ে যেত। সন্ধ্যায় দিয়ানি সেটা জ্বাল দিতেন আর সবার জন্য বাটিতে বাটিতে ভাগ করে রাখতেন। শেষে কড়াইটা চেঁছে চাঁছি বের করতেন। সে চাঁছির কি স্বাদ- এখনোও মুখে লেগে আছে।

ছোটমামা খেলাধুলা করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে একটা লন্ঠণ জ্বালিয়ে পড়তে বসতেন। আমাকেও তাঁর সঙ্গে বসতে হত দাদুর হুকুমে- তা পড়ি আর না পড়ি। না বসলে একটা শাস্তি মজুদ থাকত - সেদিন রাতে দাদুর কাছ থেকে আর গল্প শোনা যেত না।

ছোটমামা আমার থেকে সাত-আট বছরের বড় ছিলেন। পড়তে বসলে তিনি আমার উপর নানাভাবে 'মামাগিরি' ফলাতেন। পড়ায় ফাঁকি দিলে দাদুর কানে সটান চলে যেত।
দাদুর কাছে কত গল্পই যে শুনেছি। টুনটুনির গল্প, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প, শিয়াল পন্ডিতের গল্প- আরো কত কি!

এর পরই খাওয়ার ডাক পড়ত।
শীতকাল হলে খাওয়ার শেষে হাত মুখ ধুয়ে এক ছুটে দিয়ানির খাটে একেবারে লেপের তলায় ঢুকে যেতাম।
সন্ধ্যাবেলার ভয়টা নিয়ে যে আর বলা হলনা। আচ্ছা সেটা যাক এখন। পরের সংখ্যায় বলব সেটা।

সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।