খেলাঘরখেলাঘর

আমার ছোট্টবেলা -৭       

বসন্ত কালের একটা বড় উতসব হল চড়কপুজো আর মেলা। সেটা ত' এখানেও হয়। তোমরা মেলায় যাও ত ?
        
চৈত্রমাসে পুজো হত পাটঠাকুরের। সেটা কি তা বলি। গোটা মাস ধরে প্রতি পাড়ার দু'একটা দল, যে দলে ৮/১০ জন করে থাকত, প্রতিদিন একটা ঠাকুর কাঁধে নিয়ে বাড়ী বাড়ী চালডাল ভিক্ষে করে বেড়াত। পাটঠাকুর কেমন দেখতে বলি সেটা। নৌকর মত দেখতে, কাঠের তৈরী,  কালো রং করা জবজবে করে তেলসিঁদুর মাখানো আর সংগে একটা বড় ত্রিশূল - এই হল ঠাকুর। একে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হত।
        
এক মাস ধরে ভিক্ষে করলে অনেকটা চালই হওয়ার কথা,হতও তাই। সেই চালডালের খিচুড়ি রান্না করে সংক্রান্তির দিন হৈ চৈ করে খাওয়া হত। বড়রা প্রতি বছর করলেও আমি করতে পেরেছিলাম একবছর, যখন একটু বড় হয়েছি।
       
যাই হোক, চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে চড়কের মেলা বসত গ্রামে। তাতে যে কত রকমের জিনিষ বিক্রি হত! আমাদের মত ছোটদের একটা জিনিষ অতি অবশ্যই কিনতে হত মেলা থেকে। অবিকল হাতদা'এর মত দেখতে একখানা ছোট্ট ছুরি। হাতদা, যাকে কাটারিও বলে, দেখেছ ত ? তাতে হাতল থাকত না, লাগাতে হত কেনার পর। এ ব্যাপারে হরিশদা ছিল যাকে বলে এক্সপার্ট।
      
কেন কিনতাম বলত ছুরিখানা? আরে,কাঁচা আম খেতে হবে না! ইতিমধ্যেই যে আমের গুটিগুলো বেশ বড় বড় হয়ে যেত।
       
আমের গুটি গাছ থেকে পারবার নানা রকম ফিকির ছিল। একত' ঢিল ছুঁড়ে পারা যেতই, এছাড়াও লাঠির সাথে বিশেষ ভাবে একটুকরো কাঠ বেধেঁ একটা কোঁটা বানিয়ে তাই দিয়ে বা গাছে উঠে পারা যেত। কিন্তু এছাড়াও আরও একটা উপায় ছিল।
       
বেত গাছ দেখেছ ? যে বেত দিয়ে আসবাবপত্র বানানো হয়, সেই গাছ। এটা একটা লতানো গাছ,গা ভর্তি কাঁটা। এই লতার একেবারে মাথায় থাকত একটা লম্বা শিষ, যাতে থাকত খুব ধারালো অজস্র কাঁটা। একটা লম্বা লাঠির মাথায় এই শিষ বেঁধে নিলেই হয়ে যেত আম পারবার কোঁটা। ব্যস, তারপর যে আমটা চাই, তার বোঁটায় আটকিয়ে টান মারলেই আম একবারে হাতের মুঠোয়।
        
আম পেড়ে ছোট ছুরিখানা দিয়ে খোসা ছাড়ানো এরপর সহজ ব্যাপার। তারপর নুন দিয়ে আয়েস করে কাঁচা আম খাওয়া! লোভে পড়ে বেশ কয়েকটা খেয়ে ফেলতাম, ফলটা বুঝতেই পারছ। দাঁত টকে একেবারে যাচ্ছেতাই। আর উপরি পাওনা ছিল বড়দের বকুনি।
        
চৈত্র বৈশাখ মাসে হরিশদা আর অন্য কাজের মানুষেরা একটানা রোদের মধ্যে কাজ করে ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে যেত। দুপুরে ফিরে এসে সবচেয়ে টক আমগাছের আম পেড়ে নিড়ানি (খুরপি) দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে আমগাছের ছায়ায় বসে নুন দিয়ে কাঁচা আম খেত। এতে নাকি গরম লেগে অসুখ করে না।
        
ওরা যে আমগাছের আম খেত, সেটা ছিল সবচেয়ে টক আমের গাছ। গাছটার নাম কি ছিল জান! চুকারি! কেন বল দেখি। পুর্ববাংলার মানুষ টককে বলেন 'চুকা', তাই চুকারি। পাকলেও ঐ আম মিস্টি হত না। সে জন্য কাঁচা খেয়েই শেষ করা হত।
        
বেত গাছের কথা যখন উঠল তখন আর একটা কথা বলি। এই গাছে ছোট ছোট থোকা থোকা ফল হয়, এক এক থোকায় আঙ্গুরের মত অনেকগুলো করে ফল থাকে। ফল পেকে গেলে খোসা ছাড়িয়ে নিলে ভেতরে লাল শাঁস পাওয়া যায়। টক টক, ভালই লাগে খেতে। এর নাম হল 'বেথুর'।
        
আর একটা ফলের নাম বলি। এর নাম হল 'গাব'। মাঝারি আকারের গাছ হয়, আর সবুজ সবুজ টোম্যাটোর সাইজের ফল হয়। কাঁচা অবস্থায় এই ফলের দারুন আঠাল কষ বেরোয়। খোসার ওপর ছুরির একটা পোঁচ মারলেই হল। গল গল করে আঠা বেরতে থাকে। ঘুড়ি ওড়াবার সময় একটা গাব সঙ্গে থাকা চাইই চাই, ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে আঠা দিয়ে জুড়তে হবে ত'!
        
সে সময় এখনকার মত নাইলনের জাল পাওয়া যেত না। তাই মাছ ধরার জন্য সুতোর জাল ব্যবহার করতেন জেলেভাইরা। কিন্তু জলে থেকে থেকে জালের সুতো পচে যেত। যাতে সেটা না হয় সে জন্য গাব ব্যবহার করা হত। কি করে ? কাঁচা গাব খন্ড খন্ড করে কেটে নিয়ে জলে ফোটানো হত আর ওই ফুটন্ত জলে সুতোর জাল ডুবিয়ে রাখা হত। এরপর শুকিয়ে নিলে সুতোর ওপর গাবের আঠার একটা আস্তরন পড়ে যেত, যা জালকে পচন থেকে রক্ষা করত। আর গাব পেকে গেলে সেটা যা একটা সুস্বাদু ফল হত তা আর কি বলব!পাকা গাবের বিচি মুখ থেকে ফেলতেই ইচ্ছে হত না। বেথুর আর গাব ঠিক কখন পাকত সেটা এতদিন পর মনে নেই।
         
দেখ, চড়কের মেলা থেকে কত কথা এসে গেল। মেলার আরও অনেক কথাই যে বাকি থেকে গেল। যাত্রা দেখার কথা, জিলিপি আর নানা রকম ভাজা খাবার কথা-- এসব কথা খুব মনে পড়ে। একধরনের ঝুড়িভাজার,জিলিপির মত প্যাঁচালো, কথা বেশ মনে আছে। আর মনে আছে রঙ বেরঙ্গের মঠের কথা। চিনি দিয়ে তৈরী মঠ খেতে খেতে গা গুলিয়ে উঠত।
         
যাত্রার রাজাদের সাজপোষাক দেখে ঐ রকম সাজার চেষ্টা করতাম, ঠিক অপুর মত (পথের পাঁচালি দেখেছ ত ?)। তা দেখে দাদু একটা ধনুক বানিয়ে দিয়েছিলেন।

মাঘ ফাল্গুন মাসে ফাঁকা মাঠের দিকে চাইলে হঠাত কোন খেত নজরেপড়ত যেটা হলুদ ফুলে ভরা। সেটা আসলে সরষে ক্ষেত আর ওগুলো সরষে ফুল। সুন্দর সে দৃশ্য ভলা যায় না।
      
চৈত্র মাসে শীত পড়ে, এটা বিশ্বাস করতে পার! অবাক লাগলেও মোটেই আশ্চর্য্য নয়। মাঝে মাঝে শিলাবৃষ্টি হয় চৈত্র মাসে।হলে সেদিন পড়ত যাকে বলে হাড়কাঁপানো শীত। মুশকিল আসান ত ছিলই হাতের কাছে। দিয়ানির তৈরী কাঁথার কথা বলেছিলাম মনে নেই ? তা থাকতে আর চিন্তার কি!তার একখানা জড়িয়ে নিয়ে নিশ্চিন্তে নাক ডাকাতাম।

 

সন্তোষ কূমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।