খেলাঘরখেলাঘর

আনমনে

ভাবছ, এ কিরকম নাম এই লেখার? আমের আচারের সাথে মোরগ লড়াই-এর কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে। এইরকম আরো অনেকগুলি শব্দ বলতে পারি পরপর - জামরুল, লেড়োবিস্কুট, রেল-কাম-ঝমাঝম, মনিপিসি...

আসলে এই সব শব্দগুলি জড়িয়ে আছে আমার ছোটবেলার গ্রীষ্মের ছুটির সাথে। গরমের ছুটি বা সামার ভেকেশন বললেই এই সব স্মৃতিগুলি ফিরে ফিরে আসে। আজকে সেই সব গল্প, একটু, একটু, তোমার সাথেঃ

কালবৈশাখীঃ গরম পড়বে, আর কালবৈশাখী হবে না তা কি হয়? আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন এইরকম করে গরমে ঘামতে ঘামতে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হত না, যে কবে একটা কালবৈশাখী হবে। নিয়মিত ভাবেই দুই -তিন দিন পর পরই বিকেলের দিকে আকাশ কালো করে এসে, হাঁক-ডাক করে, জল-টল ঢেলে ঠাণ্ডা করে দিয়ে যেত। তার পরে বিকেলটা কি সুন্দর হয়ে যেত। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, তাপমাত্রা কমে গেছে, পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার সাত রঙে আকাশ পুরো রঙিন। গাছের পাতা থেকে জল ঝরছে টুপটাপ, বেল-যুঁই-মাধবীলতারা বৃষ্টিতে স্নান সেরে হাল্কা সুগন্ধ বিলোতে শুরু করেছে। রাস্তা ঘাট ভিজে গেছে, সেই ভেজা রাস্তা ছেয়ে আছে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া - রাধাচূড়া-জারুলে। আমার ছোটবেলা কেটেছে লাল মাটির দেশে, তাই বলতে বাধ্যই হচ্ছি, কলকাতা, বা বলা চলে এঁটেল মাটির দেশের মত বৃষ্টি হলেই কালো ঘোলা জলে রাস্তা ভরে যেত না, অথবা, জামাকাপড়ে কাদার বিচ্ছিরি দাগ লাগত না।

মোরগ লড়াইঃ কালবৈশাখীর কথা বললে মোরগ লড়াইটা বলতেই হয়! এটা মোটেও সত্যিকারের মোরগ লড়াই ছিল না। ঝড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে খসে পড়ত অনেক ফুল, এবং আধফোটা কুঁড়ি। এই আধফোটা কুঁড়ি গুলিকে খুব সাবধানে খুললে, পাওয়া যেতে একগোছা পরাগদন্ড। তার মাথায় ছোট্ট দানার মত একটা আবরণ, যার মধ্যে আছে পরাগ। এই পরাগদন্ড দুই আঙুলে তুলে নিয়ে , দুই বন্ধুতে চেষ্টা করা হত, কে আগে অন্যের পরাগধানীটা ছিঁড়ে দিতে পারে। এ ছিল আমাদের নিরীহ, নির্ভেজাল, রক্তপাতহীন মোরগ লড়াই।

আমের আচারঃ গ্রীষ্মের ছুটি হবে, আর আমের আচার হবে না, এ তো হয় না! কাজেই গ্রীষ্মের ছুটি মানেই বাড়িতে গুড়েপাক দিয়ে আমের আচার তৈরি হত। মা তৈরি করতেন। সেই আচার আবার চুরি করে না খেলে কোন আনন্দই নেই। মানে, দুপুরের খাওয়ার সময়ে শেষ পাতে দেওয়া হল ঠিকই, কিন্তু মন ভরল না। তাই, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, শেষ বিকেলে উঠে, চুপিসারে রান্নাঘরে গিয়ে বেশ খানিকটা আচার চেটে চেটে খেতে না পারলে তো গ্রীষ্মের ছুটির কোন মানেই হয় না!

রেল-কাম-ঝমাঝমঃ গরমের ছুটি মানেই ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে দাদু-ঠাকুমা- কাকা-পিসিদের সাথে দেখা করতে চন্দননগর চলে যাওয়া। গরমের দুপুরে, ঠা-ঠা- রোদ্দুরে, ট্রেনের জেনারেল কামরায় বসে, ঘামে ভিজতে ভিজতে সেই যাত্রার মজাই আলাদা। যেতে যতটুকু কষ্ট, একবার গিয়ে পড়তে পারলেই- ব্যস - বাবার বকাবকি নেই, এন্তার আদর , আর সারাদিন খেলাধুলা করার অফুরন্ত সুযোগ। পড়ার বই সাথে থাকত বটে, তবে সে ওই নামেই... আর হ্যাঁ, এই রেলযাত্রার বেশ কিছুটা পথ আমরা যেতাম স্টিম ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়ি চেপে। এখন বাষ্পচালিত স্টিম ইঞ্জিন আর প্রায় দেখাই যায় না। এক চলে দার্জিলিং এর টয় ট্রেন। আর হয়ত চলতে পারে কোন দূর গ্রামাঞ্চলের পথে, সে আমি ঠিক জানি না। আমি জানি, তুমি স্টিম ইঞ্জিনের ছবি দেখেছ, হয় কোন মিউজিয়ামে গোটা একটা স্টিম ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছ, কিন্তু, সেই ঘসঘস আওয়াজ করতে করতে, কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলা , আর পোড়া কয়লার সেই অদ্ভূত এক গন্ধ...ইঞ্জিনের কাছাকাছি কামরায় বসলে চোখে কয়লার গুঁড়ো এসে পড়া...এইসবের অভিজ্ঞতা মনে হয় হয়নি, তাই না?

জামরুলঃ চন্দননগরের বাড়ির একটা বিশাল বাগান ছিল। সেখানে একটা বড় জামরুল গাছ ছিল। তাতে গরমের সময়ে থোপা থোপা সাদা সাদা জামরুল হত। সেই জামরুল কি মিষ্টি। পাড়ার ছেলেরা চুরি করে নিয়ে যেত কত, তাই জামরুল শেষ হত না। আর জামরুল খাওয়াও শেষ হত না।

লেড়োবিস্কুটঃ বিকেলবেলা সবাই মিলে গোল হয়ে বসে চা খেতাম। আমরা ছোট ছিলাম, তাই আমাদের ভাই বোনেদের ছোট ছোট চায়ের কাপ ছিল। চায়ের সাথে দারুণ লাগত খেতে কড়মড়ে লেড়ো বিস্কুট। ভাবছ লেড়ো বিস্কুট কি? আজকের দিনে সুন্দর প্যাকেটে মোড়া 'রাস্ক' বিস্কুটই হল আমাদের সেই ছোট বেলার লেড়ো বিস্কুট।

মনিপিসিঃ আমার গরমের ছুটি মানেই মনিপিসি। আমার সব থেকে ছোট পিসি। আমার থেকে বছর ছয়-সাতেকের বড়। সে ছিল গ্রীষ্মের ছুটির সব থেকে বড় আকর্ষণ। আমার পুতুল খেলার , রান্নাবাটির সাথী। রোজ সকালে এক ঝুড়ি খেলনার হাঁড়ি-কড়াই নিয়ে আমার সাথে খেলতে বসত। মনিপিসিও তখন স্কুলে পড়ত। তাই তার স্কুলেও গরমের ছুটি। তাই আমাদের দুজনের এক সাথে খেলায় কেউ বাধা দিত না।

তুমি বলবে - বড়রা খালি বলে - "আমাদের সময়ে সব কিছু ভাল ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ..." আসল কথাটা হল, বড়রা যতই বড় হোক না কেন, তারাও আসলে মনে মনে ছোটবেলাটাকে ভুলতে চায় না। তাই তারা ফিরে ফিরে যায় ছোটবেলার গল্পে। এই যেমন আমি ফিরে গেলাম আমার ছোটবেলার গল্পে।

মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা

ছবিঃ
প্রকৃতি গুপ্ত
ষষ্ঠ শ্রেণী
অক্সিলিয়াম কনভেন্ট, ব্যান্ডেল, হুগলি

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।