সন্ধ্যা নামলেই বোঝা যে শীত আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। সেটা আরও বেশী করে বোঝা যেত রাতে শুতে গিয়ে। গা শির শির করত। দিয়ানী গায়ে দিয়ে দিতেন একখানা কাঁথা। তাঁর নিজের হাতে তৈরী করা। হেমন্তের অল্প শীতে কাঁথার নিচে শুয়ে ঘুমতে ভারি আরাম।
কাঁথা কাকে বলে জান ? মা-ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার। আমিও একটু বলি। কয়েকখানা পুরোন পরিষ্কার কাপড় মাপ মত কেটে নিয়ে একখানার ওপর আরও কয়েকটা পর পর রেখে একটু পুরু হলে সেগুলোকে সেলাই করে নিলেই হয়ে যায় কাঁথা। প্রয়োজন মত পুরু বা পাতলা করা যায়। সেলাই করা হয় নানা রকম নক্সা করে। দেখতেও হয় দারুন সুন্দর সুন্দর।
আমাদের বাড়ীর পশ্চিম দিকে ছিল বাইরের উঠোন। সেই উঠনটা পার হয়েই ছিল একটা মাঠ, যে মাঠে ছোটমামারা খেলাধুলা করতেন। ফুটবল ছাড়াও খেলতেন আর এক রকমের খেলা যার নাম ছিল 'তেকাঠি' খেলা। কতকটা ক্রিকেট আর বেস বল খেলাকে মিলিয়ে তৈরী। অবশ্য তখন এসব খেলার নামও জানতাম না।
সেই মাঠের পরে ছিল 'বড়সড়ক' ,মানে বড় রাস্তা। নামেই বড়। কেননা সেটা ছিল কাঁচা রাস্তা। গরুর গাড়ীর চাকার চাপে দুদিকে গভীর গর্ত তৈরী হয়েছিল সেই রাস্তায়। মাঝ বরাবর ছিল পায়ে চলা পথ। বর্ষায় জলের নীচে চলে যেত গোটা রাস্তা। রাস্তাটা যেমনই হোক, তা বলে 'বড়সড়ক' কেন ?এর কারন এত দীর্ঘ রাস্তা গ্রামে ছিল না । তাছাড়া ওটা ছিল পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামের একমাত্র যোগাযোগকারী রাস্তা। এছাড়াও ছিল তার ধার দিয়ে কিছুটা দূর দূর টেলিগ্রাফের খুঁটি পোঁতা। খুঁটিতে কান পাতলে শণ্ শণ্ শব্দ শোনা যেত।
বড় সড়কে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। হেমন্তে সেই সব ধান পেকে উঠছে আর তাতে ধরছে সোনালী রঙ। আর একটু পেকে গেলে সেটা কেটে বাড়ীতে নিয়ে আসা হবে। এর পর হবে 'মলন' দেওয়া, যে কথা আগে একবার বলেছি।
হেমন্তে বা শীতের শুরুতে আর একটা ছোট পুজোর মত ব্যাপার হত। একে বলা হত 'গাস্সি' অথবা 'গাস্যি'। জানিনা কোন বানানটা ঠিক। জানবার উপায় ও নেই। একদিন খুব ভোরে ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠত সবাই। এর পর উঠোনে কিছু একটা পুজো হত। এরপর আমার একটা ভুমিকা থাকত। সেটা বেশ মজার। আমার হাতে দেওয়া হত একটা গোটা পান, গোটা সুপারি, কলা আর একটা মিস্টি। সে সব নিয়ে অন্ধকারে শীতের মধ্যে আমাকে গোটা বাড়ীর চারিদিক এক পাক ঘুরে আসতে হত। কলা আর মিষ্টিটা ছিল আমার পাওনা।
এরপর পাটকাঠির আগুন জ্বেলে হাত সেঁকত সকলে। বাড়ীর পুরুষেরা প্রত্যেকে একটা করে পাটকাঠির একপ্রান্তে আগুন জ্বেলে সিগারেট পান করার মত করে ধোঁয়া টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আমিও বাদ যেতাম না। মজা পেতাম এই ভেবে যে বড়দের সাথে তাদের মত করে ধুমপান করছি
আর কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ছি। কারও বারণ করার আর আমার তা শোনবার মত
কিছু নেই। পুজো কিনা!
নানা আনন্দের মধ্যেও একটা নিরানন্দের ব্যাপার সব সময় মনকে বিব্রত করত, যেটা তোমাদেরও করে। পুজোর ছুটির পরেই বার্ষিক পরীক্ষা যে! এই সময় ছোটমামা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতেন। উঁচু শ্রেণীতে পড়তেন ত।
একটা মজাদার কথা শোন। সে সময়ে প্রায় সব শ্রেণীতেই বাংলা পরীক্ষায় কয়েক লাইন কবিতা মুখস্থ লিখতে হত। তাছাড়া কবিতার বিষয় বস্তু জানারও প্রয়োজন থাকত । সে কারণে কবিতা গুলো ভালভাবে মুখস্থ করতেই হত । আর তাতে প্রান হয়ে উঠত ওষ্ঠাগত। ছোটমামা আর তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে বড় বড় কবিতা মুখস্থ রাখার
চমতকার এক উপায় বের করেছিলেন । কবিতার প্রতিটি লাইনের প্রতিটি শব্দের প্রথম বা প্রথম দুটো অক্ষর পর পর লিখে নিয়ে শুধু সেটা মুখস্থ করতেন। সেটা জানা
থাকলেই সমস্ত লাইনটা লিখে ফেলা যেত।
এরকম একটা কবিতার দুটো লাইনের কথা মনে আছে। সেটা ছিল কবিগুরুর 'বঙ্গমাতা' কবিতা। লাইন দুটো হল--
' পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রেখ নাকো ভাল ছেলে করে।'
ছোটমামা মুখস্থ করতেন এইভাবে--
' প প ছো ছো নিষে ডো
বে বে রে না ভা ছে কো ।'
কেমন বল, মজার না ?
শিউলি ফুল কুড়ানো নিয়ে পরে বলব বলেছিলাম । পুজোর কাজে যে লাগত সে'ত আগেই বলেছি। এছাড়া আমার কাজ ছিল ফুলের রঙিন বোঁটাগুলো পাপড়ি থেকে আলাদা করে নিয়ে রোদে শুকতে দেওয়া । বোঁটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে হাতের নখ আর আঙুল গুলো রঙিন হয়ে যেত । কয়েকদিন ধরে শুকিয়ে নিলে বোঁটাগুলো চা পাতার মতো কুরকুরে হয়ে যেত । বেশ কিছুদিন ধরে এরকম শুকনো বোঁটা জমিয়ে রাখতেন দিয়ানি। সরস্বতী পূজোর সময় ঐ শুকনো বোঁটা দিয়ে কাপড় রাঙানো হত বাসন্তী
রঙে । কেমন করে বলতে পারবে ?
বোঁটাগুলো গরম জলে ফোটালে জলটা রঙিন হয়ে যেত। তাতে নতুন কাপড় ডুবিয়ে রোদে শুকিয়ে নিলেই হয়ে যেত বাসন্তী রঙের ধুতি। পুজোর দিনে সেই কাপড় পরে যেতাম অঞ্জলি দিতে। তুমি এই ভাবে অঞ্জলি দিয়েছ কখনো ? রঙিন কাপড় পাবে কোথায় তাই ভাবছ ? মা'কে বলেই দেখ না একবার ।
গ্রামে একটাই সরস্বতী পুজো হত, আর সেটা করতেন ছোটমামাদের দল। খুব হৈ চৈ হত। একবার কি হল শোন। ঐ দলের একজনের একবার কলকাতার আলো ঝলমলো পুজো দেখে এসে গ্রামের পুজোতেও আলো জ্বালানোর ইচ্ছা হল। কিন্তু গ্রামে আলো আসবে কোথা থেকে!
অনেক ভেবে শেষে টর্চের বাল্ব আর ব্যাটারী দিয়ে আলো জ্বালানো ঠিক হলো। কিন্তু তারের কি হবে ? কোথায় পাওয়া যাবে তা ? ভেবেচিন্তে উপায় বেরোল একটা । কামার বাড়ী গিয়ে বলে কয়ে ওরা জোগাড় করলেন তামার পাত থেকে সরু করে কাটা লম্বা দু'টুকরো পাত। পাতজোড়ার দুপ্রান্তে বাল্ব আর ব্যাটারী জুড়ে আলো জ্বালানো হতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল ।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আলোটা কোথায় রাখলে ভাল হবে তা নিয়ে। একজন পরামর্শ দিলেন একেবারে মুখের সামনে রাখতে, কেননা তাতে নাকি মুখটা ভাল দেখা যাবে। কিন্তু কেউ ভেবেই দেখল না যে এতে প্রতিমার মুখটা দেখতে ভারি অসুবিধা হতে পারে। বড়রা কেউ কেউ সেকথা বলেছিলেনও। কিন্তু কে শোনে কার কথা ! আলো জ্বলেছে এই খুশীতেই মগ্ন সবাই।
কালীপুজোর বাজির কথায় বলেছিলাম যে সরস্বতী পুজোয় বাজি হয়। সেই বাজি ছিল একটা শব্দবাজি। তোমরা চাবিকামান* কি সেটাত জান ? এর মতই কতকটা ছিল সেই বাজি। কিন্তু তা ছিল অনেক বড় আর শব্দও হত খুব জোরে।আর এতে চাবিকামানের মত দেওয়ালে বা মাটিতে না ঠুকে আগুন দেওয়া হত। শব্দ শুনে আনন্দ পেলেও ভেব না যে ব্যাপারটা ভাল ছিল। যদিও সেটা তখন জানতাম না। বাঁশের চোঙের মতো দেখতে একটা আটদশ ইঞ্চি দীর্ঘ লোহার নলের নিচের দিকটা হত সরু, যাতে নলটা মাটিতে শক্ত করে গেঁথে রাখা যায়। পুরু দেওয়ালওয়ালা ঐ নলের তলাটা একদম বন্ধ হলেও দেওয়ালের নীচের দিকে একটা ছোট্ট ছিদ্র থাকত।
এবার নল মোট যতটা লম্বা তার অর্দ্ধেকটায় ঠেসে বারুদ ভরা হত, আর বাকীটায় ঠাসা হত আঠালো মাটি। এতে ছোট ছিদ্রের মধ্যেও সামান্য বারুদ এসে যেত। এরপর ফাটাবার সময় বারুদভরা নলের সরু দিকটা মাটিতে পুঁতে দেওয়া হত এমনভাবে যাতে ওপরের দিকটা একটু হেলে থাকে একদিকে। হেলানো হত সেইদিকে যেদিকে ফাঁকা মাঠ আছে। এরপর একটা লম্বা পাটকাঠিতে আগুন জ্বেলে নলের সরু ছিদ্রের সামনে ধরা হত। বারুদে আগুন লাগলে প্রথমে হাওয়াই বাজির মত ফুলকি বেরত, আর তার পরেই 'দড়াম' । সে আওয়াজ বহুদুর পর্যন্ত শোনা যেত।
এরকম অনেকগুলো ফাটান হত।এছাড়া আর কোন বাজির কথা মনে পড়ে না। বাজি নিয়ে আর কোন কথা
মনে পড়লে পরে জানানো যাবে, না কি বল !
(চলবে)
*সংযোজনঃ এখন প্রায় সব চাবির মুখই নিরেট হয় । কিন্তু আগে অনেক চাবির মুখ ফাঁপা হত। চাবির পেছনে যে রিং থাকে অর্থাৎ যেখানে চেপে ধরে চাবি ঘোরান হয় সেখানে লম্বা সরু একটা কঞ্চি ঢুকিয়ে শক্ত করে বাধাঁ হত। এর নাম কামানের হাতল । এবার চাবির ফাঁপা মুখে দেশলাই কাঠির মাথা থেকে বারুদ ছাড়িয়ে নিয়ে, ঐ বারুদটা ভরে দেওয়া হত। এর
পর চাবির মুখের মাপে একটা পেরেক নিয়ে বারুদের ওপর চেপে বসিয়ে হাতল ধরে দেওয়ালে জোরে ঠুকে দিলেই ফটাস করে ফাটত চাবি কামান। পেরেকটা যাতে পড়ে না যায় সেজন্য সুতো দিয়ে সেটা হাতলে বাঁধা থাকত।
সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান