খেলাঘরখেলাঘর

আনমনে

পৌষ সংক্রান্তির দিন কয়েক আগে মা বললেন- ময়দা, নারকেল, চালের গুঁড়ো , ক্ষীর, নতুন গুড় - এই্সব যোগাড় করে রাখতে। পিঠে পুলি বানাতে হবে যে! এখন যেহেতু আমি নিজে নিজেই পিঠে পুলি বানাতে পারি (অনেকটা বড় হয়ে গেছি কিনা) তাই আমিও মা'কে সাহায্য করলাম। করতে করতে মনে পড়ে গেল আমাদের ছোট বেলার পৌষ -পার্বণের কথা। মায়ের এখন বয়স হয়েছে, এখন আর অত পিঠে এক সাথে বানাতে পারেন না। আমারও নানা কাজের চাপে একসাথে প্রচুর রান্না করা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন আমি আর ভাই ছোট ছিলাম, তখন পিঠে তৈরি হওয়াটা যেন একটা উৎসব ছিল। আমার মা সকালবেলা স্কুলে পড়াতে যেতেন। ফিরে আসতেন বেলা এগারোটা নাগাদ। তখন পৌষ সংক্রান্তি বলে স্কুলে ছুটি থাকত কিনা আমার ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে, দুপুরের পর থেকে মা রান্নাঘরে টুকটুক করে কাজ করতে শুরু করতেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামত। রান্নাঘরের এলামাটির হলুদ রঙা দেওয়ালকে আরো উজ্জ্বল করে তুলত হলুদ বাল্‌বের আলো। উঁচু কাউন্টার (এখন তার বিলিতি নাম শিখেছি, তখন তো বলতাম 'তাক') এর ওপরে হিটারে তাওয়া বসিয়ে মা ভেজে তুলতেন ক্ষীর নারকোলের পুর দেওয়া 'পাটিসাপ্‌টা'।  তারই পাশে গ্যাসের মৃদু আঁচে ফুটতে থাকত দুধে ডোবা সাদা সাদা 'বকুল পিঠে'। পাশাপাশি ঘরের এক কোণে জ্বলে উঠত কয়লার উনুন। সেখানে বিশেষ ভাবে তৈরি মাটির সরায় চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হত 'সরা পিঠে', যেটাকে মাঝে মাঝে 'আস্কে পিঠে'ও বলা হত। সেই দক্ষিণী ইডলির মত দেখতে সরা পিঠে খাওয়া হত নতুন খেজুর গুড় দিয়ে।
ওদিকে পাটিসাপ্‌টা ভাজা শেষ হয়ে গেলেই সময় চলে আসত 'জিবেগজা' আর 'এলোঝেলো' তৈরি করার। মাটিতে খবরের কাগজ বিছিয়ে বেলনা-চাকি নিয়ে মা ঝটাপট বেলে ফেলতেন জিবেগজা; সেই গজাকেই ছুরি দিয়ে একটু কায়দা করে চিরে নিয়ে দুই হাতে ধরে একটু পাক দিলেই হয়ে যেত এলোঝেলো। আমি আর ভাই মা'কে এলোঝেলো বানাতে সাহায্য করতাম। তারপরেও সময় থাকলে তৈরি হত কুড়মুড়ে 'মুগের চাপ্‌টি'। শীতের সন্ধ্যেয় রান্নাঘরের নরম গরম হলুদ আলোয় মা আমাদের গরম গরম ভেজে খেতে দিতেন। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত মায়ের সেই হাসিমুখ আমাদের তৃপ্তিভরা মুখ দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠত।
এরই মধ্যে পিসিদের বাড়ি থেকে , বা পাশের বাড়ির মামির থেকে চলে আসত 'দুধ-পুলি' বা 'গোকুল পিঠে'। সব মিলিয়ে সন্ধ্যের খাওয়াটা হয়ে উঠত জমজমাট। রাতে আর ভাত খাওয়ার প্রশ্নই ছিল না।
আরেকটা জিনিসও তৈরি করা হত এই সময়েই। সেটা ছিল মুড়ির মোয়া বানানো। আজকাল আর কেউ বাড়িতে মুড়ির মোয়া বানায় না। মা বড় টিন ভর্তি করে মুড়ির মোয়া বানিয়ে রাখতেন। সেটা হত সন্ধ্যের জলখাবার। গরম এবং তরল হয়ে যাওয়া গুড়ের মধ্যে টাটকা মুড়ি মিশিয়ে হাত দিয়ে গোল গোল করে বড় বড় মোয়া বানানো হত। আমি আর ভাইও হাত লাগাতাম।বানাতে বানাতে বেশ কয়েকটা খেয়েও ফেলতাম।
আজকের এই ব্যস্ত দুনিয়ায়, আরো অনেক সাবেকি খাবারের মতই, শীতকালে মিষ্টির দোকানে বিক্রি হয় ঠাণ্ডা, শক্ত পাটিসাপ্‌টা; অতি বাজে খেতে হয়; প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া বাজে তেলের গন্ধওয়ালা এলোঝেলোও কিনে খেয়ে দেখেছি। মন ঠিক ভরে না। মায়ের হাতের স্বাদ ও পাই না, গরম গরম খাওয়ার সুখ ও নেই। কিন্তু কি আর করা যাবে - রান্নাঘরের দেওয়ালে এলামাটির জায়গা নিয়েছে নানারঙা অয়েল পেইন্ট। পেটমোটা উষ্ণ হলুদ রঙের গোলগাপ্পা বাল্‌ব জায়গা করে দিয়েছে শীতল সাদা ডায়েট করা সি-এফ-এল ল্যাম্পকে। গতিময় জীবনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মেনে নিয়েছি অনেক বদল, এটাও তার মধ্যে একটা।

মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।