শাপলার সাথে সাথেই শালুক কথাটাও এসে পড়ে। শাপলা, শালুক নিয়ে কয়েকটা কথা এই ফাঁকে তোমাকে জানিয়ে রাখি। এরা একটা গাছেরই দুটো অংশ। পুকুরের একেবারে নিচে মাটির মধ্যে থাকে শালুক। শালুক থেকে শাপলার ফুল ও পাতার মুকুল বেরিয়ে জলকে আশ্রয় করে একেবারে জলের ওপর পর্যন্ত চলে আসে। পাতাগুলি জলতলে জলের ওপর ভেসে থাকে । আর ফুলের কুঁড়ি জলতলের কিছুটা ওপরের উঠে পড়ে ও পরে ফুল ফোটে। শালুক আসলে কান্ড না মূল সেটা বলতে পারবো না। এটা তোমাকে জীবন বিজ্ঞান যিনি পড়ান তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে ভালো করে জানতে পারবে। আমার ধারণা শালুক কতকটা রাঙা আলু বা কচুর মতন যা কিনা মাটিতে থাকে। আর ফুল পাতা মাটির ওপরে থাকে। পুকুরের জলে পাতা সহ শাপলা ফুল দেখতে ভারি ভালো লাগে। শালুক কিন্তু খাওয়া যায়। যেটুকু মনে পড়ে আমিও খেয়েছি কাঁচা অবস্থায়। বিশেষ ভালো লাগেনি। তবে শুনতাম শালুক নাকি পুড়িয়ে খাওয়া যায় আর ভালোও লাগে। আর অনেকেই শাপলা ডাঁটার তরকারি খেতে ভালোবাসেন। শাপলা ফুল শুকিয়ে গেলে ফুলের বীজের আধারটা ক্রমশঃ বড় হতে থাকে। একে বলে 'ঢ্যাপ' । ঢ্যাপ পাকলে গ্রামের লোকেরা সেগুলি তুলে এনে বিক্রি করতো। ঢ্যাপের মধ্যে বীজ থাকতো কালো কালো সর্ষের মতো দেখতে। বীজগুলি ছাড়িয়ে নিয়ে বালির খোলায় ভাজতেন দিয়ানী। ছোট্ট ছোট্ট খই হতো তার থেকে। শেষ পর্যন্ত হতো সেই খইয়ের মোয়া। খুব ভালবাসতাম সেই ঢ্যাপের মোয়া খেতে। আর কাশফুলের কথাটা তো বললামই না। গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল ফুটতো চারিদিকের ক্ষেত খামারের নানা জায়গায়, বিশেষ করে ক্ষেতের আলে। আল মানে বুঝলে? আল হল দুটি ক্ষেতের সীমানা নির্দেশকারী একটু উঁচু রাস্তার মতো জায়গা। দূর থেকে দেখেই মনটা উড়ু উড়ু করতো পুজোর কথা ভেবে। ঠিক দুর্গা পুজো না, লক্ষ্মী পুজোর কথা ভেবে। একথা কেনো বললাম জানো? আমাদের ছোটবেলায় সেই গ্রামে পুজোর আসল মজাটা ছিলো লক্ষ্মীপুজোয়। ছোট-বড় সকলেই লক্ষ্মীপুজোর অপেক্ষায় থাকতো। পাড়ার সব বাড়িতেই লক্ষ্মী পুজো হতো ধুমধাম করে। আমাদের অর্থাৎ ছোটদের আনন্দটা ছিলো বোধহয় বেশি। পুজোর দিন সন্ধ্যায় পুজো হয়ে যাওয়ার পর আমরা অর্থাৎ পাড়ার সব ছোটরা দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়তাম বাড়ি বাড়ি "কোজাগরী" করতে বা প্রসাদ খেতে। জানো বোধ হয়, দুর্গাপুজোর পর যে লক্ষ্মীপুজো হয়, তাকে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বলে। এই সময় প্রত্যেকের কাছে থাকতো একটা করে কাপড়ের ছোট থলি। দিয়ানী প্রতি বছর একটা করে আমাকে বানিয়ে দিতেন। থলি থাকতো কেন বলতো? সব বাড়িতেই তিলের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, তক্তি, বাড়িতে তৈর ক্ষীরের সন্দেশ, এইসব ভালো ভালো জিনিষ খেতে দেবে। কতো খাওয়া যায়? দু'একটা মুখে দিয়ে বাকিটা থলিতে রাখতাম। এরকম করে থলিটা একেবারে ভর্তি হয়ে যেতো। এটাই ছিল রেওয়াজ। কাজেই থলিতে বাড়ি নিয়ে আসায় কোন লজ্জার ব্যাপার ছিলো না। বরং পরদিন সব বন্ধুরা মিলে বড়াই করতাম যে কে কত বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছে। একবার কি হয়েছিলো শোনো। মাথায় কি যে ভূত চাপলো। আমি আর আমার মাসতুতো ভাই স্থির করলাম যে আমরা একটা ছোট করে লক্ষ্মীপুজো করবো। ভেতরের উঠোনে হবিষ্য ঘরের পেছনে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার আর ফাঁকা ছিলো, যদিও একটু তফাতে ঝোপঝাড় ছিলো। ঠিক করা হলো ওখানেই পুজো করবো। শুলে বড়রা আপত্তি করলেন। কারণ, বাড়ির পুজোটা দাদুর ঘরে হবে, সবাই মাঝের উঠোনে ব্যস্ত থাকবে; আর আমরা ভেতরের উঠনে একা থাকবো, সেটা ঠিক হবেনা। কিন্তু কে শোনে সেসব কথা !একবার যখন মনে হয়েছে তখন করতেই হবে। ছোট্ট একটা ঘর বানিয়েছিলাম পাটকাঠি আর বাঁশের বাখারি দিয়ে। তারপর পাটকাঠির বেড়ায় গোবর কাদা দিয়ে লেপে দারুণ সুন্দর ঘর হয়েছিলো সেটা। আর প্রতিমা? দিয়ানীর একটা পেতলের পঞ্চপ্রদীপ ছিলো - একটি মেয়ে পঞ্চপ্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা চেয়ে নিয়ে প্রতিমা বানানো হলো। এর পর ফুল, প্রসাদ, সবই যোগাড় হলো। কিন্তু মুশকিল হলো পুজোর সন্ধ্যায়। সত্যি করেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাড়ির আসল পুজোয়। আমাদের কাছে বড়রা কেউই রইলেন না। ভয় ভয় করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে নানারকম আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে মানে মানে সরে পড়লাম আর কি! শেষে যা হবার তাই হলো। দিয়ানীর কাছে বকুনি জুটলো ভাল মতই। এরপর বন্ধুরা সবাই এসে পড়লো কোজাগরী করতে। আমরাও বেড়িয়ে পড়লাম ওদের সাথে। আর আলাদা করে লক্ষ্মী পুজো করার কথা ভাবিনি কখনও।
সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্ল্স্ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।