খেলাঘরখেলাঘর

অনেকদিন আগে এক বিধবা মহিলা ছিলেন, যাঁর একটা ছেলে ছিল। ছেলেটি বড় ভাল মনের ছিল, তাই তাকে সবাই খুব ভালবাসত। একদিন সে তার মাকে বলল, "আমার সব বন্ধুদের ঠাম্মা আছে, দিদান আছে। আমার কেউ নেই। আর তাই আমার খুব মন খারাপ।"

"আচ্ছা, আমরা তোমার জন্য একজন ঠাম্মা খুঁজে আনব, " তার মা বললেন। এর পরে কিছুদিন কেটে গেল। একদিন এক খুব বুড়ি এবং দুর্বল ভিখারিনী তাদের বাড়িতে ভিক্ষা চাইতে এল। তাকে যখন ছেলেটি দেখল, সে বলল, "তুমিই আমার ঠাম্মা হবে!" আর সে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, "বাইরে একজন ভিখারিনী রয়েছে, আমি তাকে আমার ঠাম্মা বানাব।" মা দেখলেন, সে ভিখারিনী খুব নোংরা, কিন্তু তিনি তাই ছেলের কথায় রাজি হলেন। তাঁর ছেলে বলল, " আমরা ঠাম্মাকে ভাল করে স্নান করিয়ে দিই।" আর তারা সেই বিড়িকে ভাল করে স্নান করাতে লাগ ল। কিন্তু তার চুলে প্রচুর চোরকাঁটা ছিল। তারা সেগুলিকে যত্ন করে বেছে তুলল, আর একটা কৌটাতে ভরে রাখল। সে এত চোরকাঁটা যে কৌটোটা পুরো ভর্তি হয়ে গেল। তখন সেই বুড়ি তাদের বলল, এগুলিকে ফেলে দিয়োনা। বাগানের এক কোনায় পুঁতে রাখো। আর যতদিন না আবার সেই ভয়ানক বন্যা, সেই মহা প্লাবন হয়, ততদিন খুঁড়ে বার করবে না।"

"সেই ভয়ানক বন্যা কখন আসবে?" ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল।

"যখন জেলখানার সামনের খিলানের মাথার ওপর সিংহদুটোর চোখ লাল হয়ে যাবে, তখন সেই ভয়ানক বন্যা আসবে, " ঠাম্মা বলল।

ছেলেটা তখনি ছুটে সিংহগুলোকে দেখে এল, কিন্তু তাদের চোখ লাল হয়নি। তার ঠাম্মা তাকে আরো বললেনঃ "কাঠ দিয়ে একটা ছোট্ট নৌকা বানাও আর সেটাকে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্সে রাখ। " তা ছেলেটা তো সেটা দুইদিনেই বানিয়ে ফেলল। আর এদিকে রোজ জেলখানার সামনে যেতে শুরু করল। সেখানে গিয়ে হাঁ করে সিংহগুলোকে দেখত। তাই দেখে রাস্তার লোকেরা তো অবাক হয়ে যেত।

একদিন, যখন সে কসাইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, কসাই তাকে জিজ্ঞাসা করল, সে রোজ সিংহগুলোকে দেখতে ছুটে যায় কেন। ছেলেটা বলল," যখন সিংহদের চোখগুলো লাল হুয়ে যাবে, তখন সেই ভয়ানক বন্যা আসবে।" সেই কথা শুনে কসাই খুব হাসল। আর পরের দিন সকালে, খুব ভোরে, সে তার দোকান থেকে কিছুটা মুর্গির রক্ত নিয়ে গিয়ে সিংহগুলোর চোখে মাখিয়ে দিল। যখন ছেলেটা দেখল যে সিংহগুলোর চোখ লাল হয়ে গেছে, তখন সে তো ছুট্টে বাড়ি চলে এল। সব শুনে তার ঠাম্মা বললেন, " ওই কৌটোটা খুঁড়ে বার কর তাড়াতাড়ি, আর বাক্স থেকে ওই ছোট্ট জাহাজটাকে বার কর।" তারা যখন কৌটোটা খুঁড়ে বার করল, সেটা ভর্তি ছিল উজ্জ্বল সাদা মুক্তোয়, আর সেই ছোট্ট জাহাজটা একটা সত্যিকারের জাহাজের মত বড় হতে থাকল। তখন ঠাম্মা বললেন, "কৌটোটাকে নিয়ে জাহাজে উঠে পড়। যখন সেই ভয়ানক বন্যা আসবে, তখন যত পশু-পাখী তোমাদের কাছে আশ্রয় চাইতে আসবে, তাদের রক্ষা কর। কিন্তু কালো মাথাওয়ালা মানুষদের আশ্রয় দিও না। তখন মা আর ছেলে তাড়াতাড়ি করে জাহাজে উঠে বসল। কিন্তু পেছন ফিরে ঠাম্মাকে আর দেখতে পেল না। তিনি হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

তারপরে শুরু হল বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে লাগল। তার জোর ক্রমশঃ বাড়তে লাগল। এক সময়ে আর আলাদা করে বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে পাওয়া গেল না, শুধু যেন জলের এক বিশাল স্তর, যা সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

সেই জলে ভাসতে ভাসতে এল এক কুকুর। ছেলেটা তাকে জাহাজে আশ্রয় দিল। একটু পরেই এল একজোড়া ইঁদুর, তাদের ছানাপোনা সমেত। কিচকিচ করে অনুনয় করে তারা আশ্রয় চাইল। তাদেরকেও ছেলেটা আশ্রয় দিল। জল ততক্ষণে বেড়ে বাড়িগুলির মাথা ছুঁয়েছে। এমনি একটা ছাতে একটা বিড়াল দাঁড়িয়ে, পিঠ বেঁকিয়ে করুণ সুরে মিউমিউ করছিল। তারা বেড়ালটাকেও জাহাজে তুলে নিল। কিন্তু প্লাবন বাড়তেই থাকল। বেড়ে গাছের মাথা ছুঁতে থাকল। এমনি একটা গাছে বসে একটা দাঁড়কাক নিজের ডানা ঝাপটাচ্ছিল আর জোরে কা কা করে ডাকছিল। তাকেও তারা তুলে নিল। শেষে এক ঝাঁক মৌমাছি তাদের দিকে উড়ে এল। এই ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীগুলির ডানা ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে গেছিল, বেচারারা উড়তেই পারছিল না। তাই তারা মৌমাছিগুলিকেও আশ্রয় দিল। শেষে এক সময়ে কালো চুলের এক মানুষকে তারা স্রোতে ভেসে যেতে দেখল। ছেলেটা বলল, "মা, চল , একেও আমরা বাঁচাই"।

"কিন্তু তোমার ঠাম্মা যে আমাদের বলেছিলেন কালো মাথাওয়ালা মানুষদের না বাঁচাতে?"

" কিন্তু আমি তাও বাঁচাব," ছেলেটা বলল, " আমার ওর জন্য খুব দুঃখ হচ্ছে, আমি এভাবে ওকে স্রোতে ভেসে যেতে দিতে পারবনা।"

অবশেষে এক সময়ে জল কমতে থাকল। জল পুরো কমে গেলে, তারা সবাইকে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে গেল। আশ্রিতদের সবার কাছ থেকে তারা বিদায় নিল। আর তাদের সেই জাহাজ আবার ছোট হয়ে গেল।

কিন্তু সেই লোকটা, যাকে তারা বাঁচিয়েছিল, তারা সেই মুক্তোগুলির জন্য খুব লোভ হল। সে হিংসায় জ্বলে গিয়ে সেই ছেলেটা আর তার মায়ের নামে রাজার কাছে নালিশ করল, আর তাদের দুজনকে গারদে পুরে দেওয়া হল। তখন সেই ইঁদুরগুলি এল, আর কয়েদখানার দেওয়ালে একটা গর্ত করল। আর সেই গর্ত দিয়ে , মাংস নিয়ে এল কুকুরটা , আর রুটি নিয়ে এল বেড়ালটা। তাই তাদের আর না খেয়ে কাটাতে হল না। আর সেই দাঁড়কাক, সে কোথায় যেন উড়ে গেল, আর রাজার কাছে ফিরে এল একটা চিঠি নিয়ে। সেই চিঠি লিখেছিলেন স্বয়ং এক দেবদূত, আর তাতে লেখা ছিলঃ

"আমি মানুষের দুনিয়ায় গেছিলাম এক ভিখারিনীর বেশে। আর এই ছেলেটা আর ওর মা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। ছোট্ট ছেলেটা আমাকে নিজের ঠাম্মার মত ভলবাসেছিল,আর আমার নোংরা গা ধুয়ে দিতেও ও ঘেন্না পায়নি। এই কারণেই আমি ওদেরকে ওই মহাপ্লাবন থেকে বাঁচিয়েছিলাম। ওই প্লাবন এসেছিল তোমার রাজধানীকে পাপমুক্ত করতে। হে রাজন,ওদের মুক্ত কর, না হলে তোমাদের ওপর ঘোর দুর্ভাগ্য নেমে আসবে।"

তখন রাজা তাদের ডেকে পাঠালেন, এবং জানতে চাইলেন তারা কিভাবে বন্যা থেকে প্রাণে বেঁচেছে। মা আর ছেলে সব খুলে বলল। তাদের কথার সাথে দেবদূতের চিঠির কথা মিলে গেল। তখন রাজা তাদেরকে মুক্তি দিলেন, আর সেই দুষ্টু লোকটা, যে তাদের নামে নালিশ করেছিল, তাকে খুব শাস্তি দিলেন।

এর পরে অনেক দিন কেটে গেল। ছেলেটা বড় হয়ে কাজের উদ্দেশ্যে অন্য দেশে গেল। সেখানে একদিন সে শুনল, দেশের রাজকন্যার বিয়ে হবে। কিন্তু নিজের জন্য সঠিক পাত্র বেছে নিতে, রাজকন্যা একটা উপায় বার করেছেন। তিনি নিজেকে একটি ময়লা ফেলার ঝুড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন। সেই ঝুড়িটাকে, আরো অনেকগুলি ঝুড়ির সাথে , বাজারে রেখে আসা হয়েছে। প্রতিটা ঝুড়িতে রয়েছে একজন করে ঘোমটা ঢাকা মহিলা। এই সমস্ত ঝুড়ির মধ্যে থেকে যে রাজকন্যা শুদ্ধ সঠিক ঝুড়িটিকে বেছে নিতে পারবে, সেই রাজকন্যাকে বিয়ে করতে পারবে। তা সেই ছেলেটিও সেই কথা শুনে বাজারে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল, সেই যে মৌমাছিগুলিকে সে সেই ভয়ানক বন্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, তারা সবাই একটা ঝুড়ির ওপরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই দেখে সে সেই ঝুড়ির দিকে এগিয়ে গেল, আর হ্যাঁ, সত্যি! রাজকন্যা সেই ঝুড়ির ভিতরে ছিলেন!

নিজের শর্ত মত রাজকন্যা তখন তাকে বিয়ে করলেন। তারপরে তারা দুজনে মিলে আনন্দে বাকি জীবনটা কাটালেন।

(চীনের রূপকথার অনুবাদ)


মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।