খেলাঘরখেলাঘর

ছবি

অনেক অনেক দিন আগে, জাপানের এক দূর প্রান্তে এক দম্পতি বসবাস করতেন। তাঁদের ছিল এক ছোট্ট মেয়ে। সে ছিল তার বাবা মায়ের খুব আদরের। তার নাম ছিল মাৎসুয়ামা।একবার তার বাবাকে কাজের খাতিরে অনেক দূরে কিয়োটো তে যেতে হল। যাওয়ার আগে মেয়েটির বাবা তাকে বলে গেলেন সে যদি ভাল হয়ে থাকে আর মা'কে কাজে কর্মে সাহায্য করে, তাহলে তিনি তার জন্য এমন একটা উপহার নিয়ে আসবেন, যেটাকে সে খুব পছন্দ করবে। এই বলে তার বাবা তার মায়ের কাছ থেকেও বিদায় নিলেন। মা আর মেয়ে তাঁকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।

যখন তিনি বাড়ি ফিরে এলেন, তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে তাঁর বিরাট টুপি আর চটি খুলে নেওয়ার পরে, তিনি সাদা মাদুরে বসে একটা বাঁশের ঝুড়ি খুললেন। তিনি দেখলেন তাঁর ছোট্ট মেয়ে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে ঝুড়ির দিকে। তিনি ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা দারুণ সুন্দর পুতুল আর একটা মিষ্টির বাক্স বার করে এনে তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে দিলেন। তারপরে তিনি আবার ঝুড়ির ভেতরে হাত দিলেন, আর স্ত্রীর জন্য বার করে আনলেন একটা ধাতুর আয়না। তার বাঁকানো তলটি ঝকঝক করছিল। তার পেছনে আঁকা ছিল পাইন গাছ আর সারস পাখিদের ছবি।

সেই মহিলা এর আগে কোনদিন আয়না দেখেন নি, আর তাই আয়নার দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন আয়নার ভেতর থেকে আরেকজন মহিলা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি অবাক হয়ে দেখতে থাকলেন। তখন তাঁর স্বামী তাঁকে রহস্যটা বুঝিয়ে বললেন, আর আয়নাটাকে খুব যত্নে রাখতে বললেন।

এই সমস্ত আনন্দের মূহুর্তগুলি বেশিদিন থাকল না। মাৎসুয়ামার মা হটাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মারা যাওয়ার কিছু আগে তিনি ছোট্ট মাৎসুয়ামাকে ডেকে বললেন, " সোনা আমার, আমি মরে গেলে তোমার বাবার খুব ভাল করে যত্ন নিও। আমি চলে গেলে তোমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এই আয়নাটা নাও, আর যখন তোমার সবথেকে একা লাগবে, এটার মধ্যে দেখ - তুমি আমাকে দেখতে পাবে।" এই বলে মাৎসুয়ামার মা মারা গেলেন।

কিছুদিন পরে মাৎসুয়ামার বাবা আবার বিয়ে করলেন। তাঁর নতুন স্ত্রী নিজের সৎ মেয়ের ওপর একদম সদয় ছিলেন না। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা তার মায়ের কথা মনে রেখেছিল। তার খুব কষ্ট হলে সে এক কোনায় গিয়ে আয়নাটার দিকে ব্যাকুল ভাবে তাকিয়ে থাকত। তার মনে হত সে আয়নার মধ্যে তার প্রিয় মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছে । কিন্তু সেই মুখ মৃত্যুর সময়ের মত ব্যথায় ভরা ছিল না, সেটা ছিল এক অল্পবয়সী সুন্দর মুখ।

একদিন যখন সে এক কোনায় বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে মায়ের সাথে কথা বলছিল, তার সৎমা তখন তাকে দেখে ফেলল। তার সৎমা মাৎসুয়ামার হাতের আয়নাটা দেখতে পাচ্ছিল না। সে এমনিতেই মাৎসুয়ামাকে ঘোর অপছন্দ করত, আর মনে মনে ভাবত যে তার সৎ মেয়েও তাকে ঠিক সেইরকমই অপছন্দ করে। তার কুটিল মনে সে ভাবল, মেয়েটা নির্ঘাৎ কোন জাদু করছে, নির্ঘাৎ তার ছবির গায়ে সূঁচ বেঁধাচ্ছে। এই সব ভেবে, সে তার স্বামীর কাছে গিয়ে নালিশ করল যে তাঁর হিংসুটে মেয়ে তাকে মন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে।

তার স্বামী এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি সোজা তাঁর মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তিনি হটাৎ ঘরে ঢোকায় তাঁর মেয়ে চমকে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার জামার আড়ালে আয়নাটা লুকিয়ে ফেলল। এই প্রথম তার স্নেহশীল বাবা তার ওপরে রেগে গেলেন, আর তিনি ভয় পেলেন, যে হয়ত, তাঁর স্ত্রী তাঁকে যা বলেছে, সে সব সত্যি। তিনি মেয়ের কাছে আসল কথাটা জানতে চাইলেন।

মাৎসুয়ামা যখন এই সমস্ত অদ্ভূত কথা তার বাবার মুখে শুনল, সে অবাক হয়ে গেল। সে তার বাবাকে বলল, সে তাঁকে খুবই ভালবাসে, তাই তার পক্ষে তাঁর স্ত্রীকে মারার কথা ভাবাও অসম্ভব, কারণ সে জানে তিনি তাঁর স্ত্রীকে কতটা ভালবাসেন।

"তুমি জামার ভাঁজে কি লুকিয়েছ?" তার বিস্মিত বাবা খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করলেন।

"তুমি মাকে যে আয়ানাটা দিয়েছিলে, যেটা মা আমাকে মারা যাওয়ার সময়ে দিয়েছিলেন। আমি যখনি এটার দিকে তাকাই, আমি আমার মায়ের সুন্দর , অল্পবয়সী মুখটা দেখতে পাই। আমার যখন খুব কষ্ট হয় ---হ্যাঁ! গত কয়েকদিন আমার খুব মন খারাপ হয়েছে --- আমি আয়নাটা বার করি, আর মিষ্টি, শান্ত হাসিতে ভরা আমার মায়ের মুখ আমাকে শান্তি দেয়, আমাকে কটু কথা আর রাগী দৃষ্টি সহ্য করতে সাহায্য করে।"

তখন মাৎসুয়ামার বাবা নিজের মেয়েকে আরো ভাল করে বুঝতে পারলেন আর তাঁর প্রতি তার দায়িত্ববোধ দেখে তাকে আরো ভালবাসলেন। এমনকি, তার সেই সৎমা, যখন সব কথা জানতে পারল, সেই খুব লজ্জিত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল। আর মাৎসুয়ামা, যে বিশ্বাস করত যে সে আয়নার মধ্যে তার মায়ের মুখ দেখেছে, সে তার সৎমাকে ক্ষমা করে দিল।

তাদের সংসার থেকে অশান্তি চিরকালের মত বিদায় নিল।

(জাপানের রূপকথা)

অনুবাদঃ
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা


মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।