খেলাঘরখেলাঘর

সাবান বিক্রেতার ছেলে।

অনেক, অনেকদিন আগে, পারস্যে এক পবিত্র শহর ছিল মেশেদ, যার সোনালি মিনারওয়ালা সুন্দর মসজিদ পারস্যের গর্ব ছিল।  এই মেশেদে আব্দুল্লাহ নামে এক ভাল মানুষ থাকত। সে সাবান বেচে কোনমতে দিন গুজরান করত।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি , সে সারা শহর চষে বেড়াত, আর চিৎকার করতঃ
"ভাইসব, আমার এই সুন্দর সাবান নাও। এই শহরে এর থেকে ভাল সাবান আর নাই, আর সবাই সেটা জানে। ছোট্ট খোকারা কথা বলতে পারলে তারাও একই কথা বলত।"

কিন্তু তাও, তুমি যদি খুব কাছ থেকে ভাল করে দেখ, তোমার সেটাকে  সাবান বলে মনে হবে না। সেটা ছিল কালো আর খসখসে, অনেকটা কাঠের মত দেখতে। যদি কোন দুর্ভাগা পথিক সেই সাবান নিজের হাতে বা মুখে মাখত, তাহলে তার চামড়া আগুনের মত জ্বলত। কিন্তু এটা খুব বেশি ঘটত না, কারণ পারস্যে লোকজন গায়ে বেশি সাবান মাখত না, বা কাপড়েও সাবান ঘষত না, আর বাসনকোসন মাজার জন্য বালিই যথেষ্ট ছিল। তাই অনেকদিনই এমন হত যে বেচারা আব্দুল্লাহ নিজের আর নিজের ছোট্ট ছেলে আহমেদের জন্য খাবার কেনার জন্য যথেষ্ট পয়সা যোগাড় করে উঠতে পারত না।

এইরকম সব সময়ে আব্দুল্লাহ তার ছোট্ট মাটির তৈরি কুঁড়েঘরে গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়ে, দুই হাতে মুখ ঢেকে রাখত, যাতে তাকে ক্ষিদেয় কাতর তার ছেলের চোখের জন দেখতে না হয়। তার দশ বছরের ছোট ছেলে, তার বাবাকে সান্ত্বনা দিত এই বলেঃ

"ইনশাআল্লাহ, তুমি গত কয়েক সপ্তাহের থেকে বেশি সাবান কালকে বিক্রি করতে পারবে।" তার বাবা, তার ছেলের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সাহস যোগাত, আর প্রার্থনা করত, তাই যেন হয়।

কিন্তু দিন কেটে যেতে লাগল আর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল, যখন একদিন একটা ঘটনা ঘটল। ছোট আহমেদ ইশকুলে যাচ্ছিল, আর সেদিন সূর্যের তেজ খুব প্রখর ছিল। সে তখন বড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নালার দুইপাশে সাজানো খেজুর গাছের ছায়ার আশ্রয় নিল। সেখানে মহিলারা জলের পাত্র ভর্তি করছিল, কেউ বা কাপড় কাচছিল; এক সারি উট দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছিল, পাড়ে দাঁড়িয়ে একপাল গাধা জল ছিটাচ্ছিল, কয়েকজন নতুন রঙ করা কাপড় নিংড়োচ্ছিল, সেই রঙিন জল নানা রঙা ঢেউ হয়ে বয়ে চলেছিল।

আহমেদ যখন এইসব দেখার জন্য দাঁড়াল, সেই সময়ে, একজন দরবেশ, শিকলে বাঁধা একটা সিংহ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। তার পেছনে পেছনে অদ্ভূত টুপি আর জামা পড়া কতগুলি লোক এসে দৌড়ে দৌড়ে বলতে লাগলঃ

"বাদশাহের জন্য পথ ছাড়! সবাই দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াও!"  বলতে বলতেই একটা দারুণ সুন্দর সাজানো আরবী ঘোড়ার পিঠে চেপে বাদশাহ এগিয়ে এলেন, তাঁর চারিদিকে সশস্ত্র দেহরক্ষী। তারপরে চারজন বাহকের কাঁধে চেপে এল এক পালকি। এই শোভাযাত্রা এসে দাঁড়াল ঠিক যেখানে আহমেদ দাঁড়িয়ে ছিল। সেই পালকি থেকে নেমে এল ওড়নায় মুখ ঢাকা এক শাহজাদী। শাহজাদী পাশের বাজারের এক দোকানে রূপোর জিনিষ পছন্দ করতে এগিয়ে গেল। কিন্তু সে দোকানে পৌঁছানোর আগেই লোকজনের মধ্যে এক মহা কলরব সৃষ্টি হল। দরবেশের সিংহটা শিকল ছিঁড়ে পাগলের মত এদিক সেদিকে লাফ দিচ্ছিল, আর লোকজনকে তাড়া করছিল। মহিলারা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল, পুরুষেরা পালাল, ছোট বাচ্চারা ভয়ে কাঁদতে লাগল, কেউ কেউ নালায় ঝাঁপ দিল, ঘোড়াগুলি ভয় পেয়ে  ভীড়ের মধ্যে দিয়ে দৌড়াতে লাগল। মহা হট্টগোল লেগে গেল।

সেই সময়ে এক লাফ দিয়ে  সিংহটা শাহজাদীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল; কিন্তু তাকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলার আগেই, আহমেদ এক লাফ দিয়ে এগিয়ে এল, আর পাশের এক কামারের দোকান থেকে লাল গনগনে একটা লোহার টুকরো তুলে নিয়ে, সোজা সিংহের মুখের দিকে ছুঁড়ে দিল। প্রচন্ড  যন্ত্রণায় আর রাগে সিংহটা শাহজাদীকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে দৌড় লাগাল।

ভয় একটু কমতেই, শাহজাদী আহমেদকে কাছে আসতে বললেন, আর নিজের মুখের ওড়ণা সরিয়ে তাকে বললেন সে একজন সাহসী ছোট্ট ছেলে, আর তাঁর একজন পরিচারক কে বললেন তাকে এক বটুয়াভর্তি সোনা দিতে। আহমেদ এত সুন্দরী আর কাউকে কোনদিন দেখেনি, আর এমন অবাক হয়েছিল, যে সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল, ধন্যবাদ বলতে ভুলে গেলে, আর তার সামনে নিয়ে শোভাযাত্রা চলে গেল।

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।