খেলাঘরখেলাঘর

রবিবারে সাত

অনেকদিন আগে দুই কুঁজো ছিল। একজন খুব দয়ালু ছিল, কিন্তু অন্যজন ছিল খারাপ আর হিংসুটে। দুই কুঁজো গ্রামের ভেতরে কাজ করতে পারত না, কারণ সবাই তাদের নিয়ে মজা করত; সেইজন্য তারা পাহাড়ে কাঠ কাটতে যেত। যার মানে হল, দয়ালু কুঁজো সমস্ত কাঠ কাটত, কারণ হিংসুটে কুঁজো খুব অলস ছিল, আর সবসময় নিজের সঙ্গীকে বলতঃ
"ওহ! আমি আজকে কি ক্লান্ত। তুমি যদি এই সপ্তাহে কাঠ কেটে আনো তো খুব ভাল হয়।" তার সঙ্গী , যেহেতু দয়ালু ছিল, কোন প্রতিবাদ না করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ পাহাড়ে গিয়ে কাজ করত।
একদিন, যখন হিংসুটে প্রতিবারের মতই বাড়িতে ছিল, তখন দয়ালু কুঁজো কাঠুরে অনেক কাজ করে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যেহেতু তার বাড়ি অনেক দূরে ছিল, তাই সে ঠিক করল একটা ছোট ঝরনার পাশে বিশ্রাম নেবে। প্রায় মধ্যরাতে, কুঁজো কাঠুরে শুনল কেউ গান গাইছে। প্রথমে সে ভাবল, আশেপাশে বোধ হয় আরো কেউ রাত কাটাচ্ছে, কিন্তু যখন সে মন দিয়ে শুনল কি গান হচ্ছে, তখন সে বুঝতে পারল যে গলার আওয়াজ সে শুনতে পাচ্ছে সেগুলি মানুষের নয়।
খুব সাবধানে সে উঠল আর নিঃশব্দে যেদিক থেকে গানের আওয়াজ আসছিল সেইদিকে এগিয়ে গেল। ভাব সে কত অবাক হল যখন সে দেখল এক দল পরী আগুনের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর গাইছেঃ
সোমবার আর মঙ্গলবার আর বুধবারে তিন
সোমবার আর মঙ্গলবার আর বুধবারে তিন
পরীরা শুধুমাত্র এইটুকুই গাইছিল , একই পংক্তি ঘুরে ঘুরে গেয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তারা মাত্র এই একটাই গান জানে। তখন কুঁজো কাঠুরে ঠিক করল তাদের সাথে কথা বলবে।
তাই, যখনি সে আবার তাদেরকে গান গাউতে শুনল, সে আগুনের কাছে গেল আর পরীরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল।
"মানুষ, তুমি কি চাও?" পরীরা জিজ্ঞেস করল, "তুমি আমাদের বিরক্ত করতে এসেছ কেন?"
"কারণ আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি। আমি কেমন গাইছি শোন, আর দেখবে তোমাদের গান শুনতে আরো ভাল লাগছে।" এই বলে সে গাইলঃ
সোমবার আর মঙ্গলবার আর বুধবারে তিন
বৃহস্পতি আর শুক্র আর শনিবারে ছয়...
ওহ! এই গান শুনে পরীদের খুব আনন্দ হল। তারা তখন লক্ষ্য করল যে দয়ালু কাঠুরের পিঠে কুঁজ আছে।তারা তাকে ঝুঁকে বসতে বলল, আর একটা জাদুকাঠি দিয়ে তার কুঁজটাকে ছুঁয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা চলে গেল, আর সে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠল।
হটাৎ প্রবল শব্দ করে মাটি কাঁপতে থাকল; পাথর গড়িয়ে পড়তে লাগল।
"রাক্ষসেরা আসছে! তাড়াতাড়ি কর", পরীরা বলল।"ওই গাছে উঠে পড়, নাহলে রাক্ষসেরা তোমাকে মেরে ফেলবে," এই বলে পরীরা অদৃশ্য হয়ে গেল।
চোখের এক পলকে, কাঠুরে গাছে উঠে ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। সে গাছে উঠে বসতে না বসতেই তিনটে বিশাল, কদাকার রাক্ষস এসে হাজির হল, আর সেই গাছের তলায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা দিতে শুরু করল।
"কি ভাইসব, এই বছরে কি কি খারাপ কাজ করলে হে?" তারা একে অপরকে জিজ্ঞেস করল।
একজন বলল-" আমি পুরো গ্রামটাকে অন্ধ করে দিয়েছি। ওরা এমন অন্ধ হয়ে গেছে, যে সূর্যের আলো মাত্র দেখতেই পাচ্ছে না।"
এই বলে তারা একে অপরকে খোঁচা মারতে মারতে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
দ্বিতীয় রাক্ষস তখন বললঃ
"হা! এটা আবার একটা কাজ হল নাকি? আমি আমার রাজ্যের লোকেদের শাস্তি দিয়ে মূক করে দিয়েছি। আর ওদের আওয়াজ বেরোন এমন বন্ধ হয়েছে যে বাচ্চারা পর্যন্ত কাঁদতে পারছে না।"
এই শুনে বাকি দুইজন আরো জোরে হেসে উঠল।
"দেখ বাপু," তৃতীয় রাক্ষস বলল, " আমিও অলস হয়ে বসে ছিলাম না।  আমি আমার প্রজাদের এমন বধির করে দিয়েছি যে তারা এমন কি পাগলাগারদের বন্দীদের কান্নাও শুনতে পায় না।"
এইসব কথা বলতে বলতে রাক্ষসেরা আরো জোরে হাসতে থাকল, আর মনের খুশীতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকল। তারা এতটাই খারাপ ছিল যে মানুষের সব দুঃখ কষ্ট তাদেরকে আনন্দ দিত। বেচারা কাঠুরে তাদের এইসব কথা শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
"যাইহোক", যে রাক্ষস প্রথমে কথা বলেছিল সে বলল, " এমন যেমন করেছি তোমরা যদি সেইরকম করে থাক, তাহলে সবকিছুই ঠিকঠাক এগোবে। ওই দুর্ভাগাগুলো, যাদেরকে আমি অন্ধ করেছি, তারা জানেই না কত সহজে তাদের দৃষ্টি ফিরে পেতে পারে। যাইহোক, ভেবনা আমি ওদের সারিয়ে তুলব , আর দাওয়াইটাতো জানাবই না।"
"ভাল", দ্বিতীয় রাক্ষস বলল," তুমি আমাদের বলবে, তাই না? আমার কাছে আমার প্রজাদের বধিরতা সারানোর একটা দাওয়াই আছে। আমি আমি নিশ্চিত আমাদের এই বন্ধুর নিজের লোকেদের ভাষা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যেও একটা দাওয়াই আছে।"
"তুমি ঠিক ধরেছ," বলল তৃতীয় রাক্ষস, "আমারো একটা দাওয়াই আছে।"
"ভাইসব", প্রথম জন বলল," আমার প্রজাদের অন্ধত্ব সারানোর জন্য শুধুমাত্র এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শিশির সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সেই শিশিরে ডোবানো একটা আঙুল ওই অন্ধদের চোখে ঘষে দিলেই, তারা দৃষ্টি ফিরে পাবে।"
"তুমি নিজের এই গুপ্ত দাওয়াই ভালভাবে গোপন রাখ; এটা বেশ নতুন ধরণের,"দ্বিতীয় রাক্ষস বলল। কিন্তু আমার দাওয়াই-এর কথা শোন। আমি তো বলেইছি, আমি আমার প্রজাদের বধির করে দিয়েছি। জান তারা কিভাবে সেরে উঠবে? তোমার অন্ধত্ব সারানোর থেকে এই বধিরত্ব সারানো একটু বেশি কঠিণ। তোমরা তো ঘন্টাওয়ালা পাহাড়ের কথা শুনেছে? যা করতে হবে তা হল এই বধিরদের সেই পাহাড়ে নিয়ে যেতে হবে, সেখানে চুড়ার পাথরটার পাশে তাকে বসাতে হবে, আর পাথরটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে হবে। সেই আঘাতে যে শব্দ তৈরি হবে সেটা এই বধির মানুষদের শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে।"
" এতো কিছুই নয়," তৃতীয় রাক্ষস বলল, " আমার প্রজাদের মুখে ভাষা ফিরিয়ে আনতে হলে, কাউকে একজনকে মাঠে -প্রান্তরে যেতে হবে, আর সেনিজো গাছের ফুল তুলতে হবে, যেগুলি এক্মাত্র ভাল বৃষ্টি হলে তবেই ফোটে। এই ফুলগুলিকে জলে ফুটিয়ে চা বানাতে হবে। যারা মূক তাদেরকে এই চা পান করতে দিতে হবে। তাহলে তারা শুধু তাদের ভাষা ফিরে পাবে না, সমস্ত রকমের রোগভোগ থেকে মুক্তি পাবে।"
রাক্ষসেরা গল্পগাছা করে দিব্যি সময় কাটাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু ভোর হয়ে আসছি, তাই তারা ঠিক করল, তারা সেই একই জায়গায় ঠিক এক বছর পরে দেখা করবে। তারপরে তারা যে যার পথে হাঁটা দিল।
রাক্ষসেরা চলে যেতেই, কাঠুরে গাছ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে এল। সে নিজেকে বলল, পরীরা আমাকে সাহায্য করেছে। আমারো এবার উচিত অন্যদের সাহায্য করা। আমি গিয়ে ওইসব অসহায় মানুষগুলিকে সাহায্য করব, যাদের কথা রাক্ষসেরা বলছির। কিন্তু, যেহেতু এপ্রিল মাস আসতে এখনো অনেক দেরি, আমি প্রথমে গিয়ে মূক ও বধিরদের সুস্থ করে তুলব।
এই ভেবে সে হাঁটা দিল।
হাঁটতে, হাঁটতে, দয়ালু কাঠুরে শেষ অবধি বোবাদের দেশে গিয়ে পৌঁছাল। সে মাঠ থেকে সেনিজো ফুল তুলল, সেগুলি ফুটিয়ে চা বানাল, আর বোবাদের সেটি পান করতে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের ভাষা খুঁজে পেল। সুস্থ হয়ে উঠে সেইসব মানুষগুলি এতই কৃতজ্ঞ হল যে, তারা কাঠুরের ছোট্ট গাধাটার পিঠ বোঝাই করে সোনা আর রূপোর বাঁট দিয়ে দিল। বোবাদের দেশ থেকে, কাঠুরে গেল বধিরদের রাজ্যে। সে সব বধিরকে ঘন্টাওয়ালা পাহাড়ের মাথায় নিয়ে গেল, এবং তাদের সুস্থ করে তুলল। কি আনন্দ! এই মানুষগুলিও কাঠুরে আরেকটি গাধা দিল, যার পিঠে বোঝাই সোনা ও রূপার বাঁট।
যেহেতু এপ্রিল মাস প্রায় এসে গেছিল, তাই কাঠুরে অন্ধদের গ্রামে গেল। সেখানে ঘাসে ভরা এক খোলা প্রান্তরে সে আস্তানা গাড়ল, আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যখন সঠিক সময় এল, দয়ালু কাঠুরে তখন ঘাসের ডগা থেকে শিশির সংগ্রহ করে অন্ধদের গ্রামে গেল, আর সবার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল। উপহার স্বরূপ, সেইসব মানুষেরা তাকে আরো অনেক সোনা ও রূপা দিল।
অবশেষে সে তার বাড়ি ফিরল, যেখানে তার জন্য হিংসুটে কুঁজো কাঠুরে অপেক্ষা করছিল। ভাল কাঠুরে তাকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলল, কিন্তু হিংসুটে সোনা-রূপো পাওয়াকে পাত্তাই দিল না। সে শুধু চাইছিল তার কুঁজটার ভার থেকে মুক্তি পেতে।
"ভাই," সে তার দয়ালু বন্ধুকে বলল, "তুমি আমাকে বলছ না কেন এই গাছটা কোথায় আছে? রাক্ষসেরা সেখানে খুব তাড়াতাড়ি এসে পড়বে; হতে পারে আমিও তোমার মত ধনী হয়ে যেতে পারি। সবথেকে বড় কথা হল,  আমি ভাবছি, পরীরা যদি আমার কুঁজটাকেও অদৃশ্য করে দেয়।"
দয়ালু কাঠুরের নিজের বন্ধুকে দেখে কষ্ট হল, তাই সে ঠিক করল বন্ধুকে সাহায্য করবে। যেদিন রাক্ষসেদের ফের মোলাকাত হওয়ার কথা, সেইদিন সকালে সে গাছটার কাছে নিয়ে গেল। হিংসুটে কুঁজো কাঠুরে তার বন্ধুকে ধন্যবাদ তো জানালই না, বরং হুড়মুড় করে গাছে গিয়ে উঠে বসে রাক্ষস আর পরীদের আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
কিন্তু পরীরা আসার আগেই, আগের মত সজোরে মাটি আর পাথর কাঁপিয়ে রাক্ষসেরা এসে উপস্থিত হল।
"বন্ধুরা", সবথেকে বড় রাক্ষসে বলল, "আমাদের মধ্যেই একজন বিশ্বাসঘাতক আছে। কেউ একজন গিয়ে আমার প্রজাদের অন্ধত্ব সারিয়ে দিয়েছে। একবছর আগে যা কথা হয়েছিল সেগুলি একমাত্র আমরাই জানতাম। আমাদেরই মধ্যে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতক হবে।"
"আমি নই, " দ্বিতীয় রাক্ষস বলল, " কারণ আমার রাজত্বে বোবারা এখন কথা বলতে পারে।"
"আর আমার আগের বধির প্রজারা এখন শুনতে পায়," রেগে চিৎকার করে বলল তৃতীয়জন।"একজন কাঠুরে আমার রাজ্যে এসে সবাইকে সুস্থ করে দিয়েছে।"
"আরে, সেই লোকটাই তো আমার প্রজাদের সুস্থ করেছে", বলল বাকি দুইজন।
এইসব কথাবার্তার মধ্যে পরীরা এসে হাজির হল, আর আগুণ জ্বেলে নাচতে আর গাইতে লাগল। মনে হচ্ছিল তারা রাক্ষসদের দেখে আর ভয় পাচ্ছেই না।
সোমবার আর মঙ্গলবার আর বুধবারে তিন
বৃহস্পতি আর শুক্র আর শনিবারে ছয়...
তারা গাইতে শুরু করল।
হিংসুটে কুঁজো দেখতে পেয়েছিল পরীরা এসে গেছে, আর তার কুঁজও অদৃশ্য হয়ে যাবে, এই আশায় অধৈর্য্য হয়ে উঠছিল, কখন গান শুরু হবে, আর সে তাতে এক পংক্তি যোগ করতে পারবে। পরীরা যেই "ছয়" বলল, অমনি কিংসুটে কুঁজো কাঠুরে সব কিছু ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলঃ
"...আর রবিবারে সাত!"
কয়েক মূহুর্তের জন্য রাক্ষসেরা আর পরীরা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু একটু পরেই তাদের সম্বিত ফিরে এল, আর পরীরা হা-হুতাশ করে বলল," আমাদের গানটা পুরো নষ্ট হয়ে গেল..."
...আর এই বলে তারা হুশ করে অদৃশ্য হয়ে গেল!
ইতিমধ্যে রাক্ষসেরা তো চারিদিকে খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে, আর চিৎকার করছে -"ওই তো সেই বিশ্বাসঘাতক!" তারা গাছে উঠে পড়ল, আর হিংসুটে কুঁজো কাঠুরেকে নামিয়ে আনল।
"তাহলে তুই-ই সেই পাজি ছুঁচো, যে আমাদের গোপন কথা আর গোপন রাখিস্নি! এইবার দ্যাখ, তোর কি হয়!" এই বলে রাক্ষসেরা মন্ত্রবলে হিংসুটের পিঠে আরেকটা কুঁজ তৈরি করে দিল।

মেক্সিকোর রূপকথা

অনুবাদঃ
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।