খেলাঘরখেলাঘর

দাঁড়কাক

এদিকে, ঘুম ভাঙতেই পুরো ঘটনার কথা মনে করে আর রাজকন্যাকে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি না রক্ষা করতে পারার কথা ভেবে লোকটার তো দুঃখের অন্ত নেই, লজ্জায় তার নিজের প্রতিই নিজের রাগ হতে থাকলো। সে মূর্হুতেই লোকটা ঠিক করলো সে রত্নাগড়ের দুর্গে যাবেই আর রাজকন্যাকে উদ্ধারও করে আনবে। কিন্তু রত্নাগড়ের দূর্গ কোথায়? কে তাকে বলে দেবে সে পথ? এসব ভেবে ভেবে কুলকিনারা করতে না পেরে সে নিজেই গভীর বনের দিকে রওনা দিল। চোদ্দ দিন ধরে একটানা বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত খুঁজেও যখন সে রত্নাগড়ের দূর্গ খুঁজে পেলনা তখন বনের একপ্রান্তে নরম ঘাসের ওপর এসে ক্লান্ত শরীরে সে শুয়ে পড়ল। এতোটা রাস্তা চলার পর সেও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তাই সাথেই সাথেই তার চোখ বুঝে এল। কখন যে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে তার খেয়ালই নেই। হঠাৎই চারপাশ থেকে হালকা কান্না আর চিতৎকারের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। লোকটা তাকিয়ে দেখল তার দিকেই আলোর এক সরু রেখা এগিয়ে আসছে। আলোর দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারল দূরে কোন এক ছোট্ট বাড়ী থেকেই সে আলো আসছে। আলো ধরে ধরে লোকটা এগোতে এগোতে একসময় সে বাড়ীর সামনে এসে হাজির হল। সামনে এসেই  দেখতে পেল ছোট বাড়ীটার সামনে এক বিশাল বড় দৈত্য পাহারায় রয়েছে। দৈত্যকে দেখেই ভয় পেয়ে গেলেও মনে মনে লোকটা ভাবল, যদি তাকে দেখতে পেয়ে যায় দৈত্য তাহলে সে মূর্হুতেই তার প্রান চলে যাবে কিন্তু তাও অনেক ভেবে লোকটা এগিয়ে গেল বাড়ীটার দিকে । কিছুক্ষনের মধ্যেই দৈত্যও লোকটাকে দেখতে পেয়ে বলল- খুব ভালো করেছো তুমি এসেছো। অনেকক্ষন ধরেই আমি কিছু খাইনি, তাই এই খিদের মুখে তোমাকেই আমি খাবার হিসেবে আজ গ্রহন করব। কিন্তু লোকটা একটুও ভয় পেলনা। সাহসের সাথে সে বলল- দেখ, দৈত্যভাই, তুমি আমাকে খেলে শুধু আমাকেই পাবে আর তাতে তোমার পেটও বিশেষ ভরবে না কিন্তু আমার কাছে সে উপায় আছে যাতে তোমাকে অঢেল খাবারের ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি। দৈত্যতো এ শুনে আহ্লাদে আটখানা। লোকটাকে ডেকে খাবার টেবিল এ নিয়ে এল দৈত্য। আর লোকটার কাছেও তো রাজকন্যের দেওয়া বর ছিল।তাই সে যতখুশী পাউরুটি, মাংস আর আঙুরের রস এনে দিল দৈত্যকে। পেট পুরে খেয়ে দৈত্যর আনন্দ দেখে কে! সে বলল বলো, তোমার জন্য কি করতে পারি? লোকটা দৈত্যকে রত্নাগড় দূর্গের রাস্তা চিনিয়ে দিতে বলল। দৈত্য তার ঘর থেকে পুরোনো নকশা এনে তাকে দূর্গের রাস্তা দেখিয়ে দিল। দূর্গ পাশের রাজ্যে ছিল, তাও নয় নয় করে প্রায় একশো মাইল দূরে তো হবেই । লোকটার তো মাথায় হাত। এত দূর রাস্তা সে কি করে পায়ে হেঁটে যাবে! তার বিপদের কথা সবিস্তারে খুলে বলাতে দৈত্য বলল, তার কাছে মাত্র দু ঘন্টা সময় আছে, এই সময়ে সে কাঁধে করে তাকে যতদূর পৌঁছে দিতে পারবে দিয়ে আসবে কারন ফিরে এসে তাকে তার ছেলেকে খাওয়াতে হবে। লোকটাও রাজি। যেমন বলা তেমনি কাজ- পিঠে করে দৈত্য লোকটাকে প্রতিবেশী রাজ্যে নিয়ে চলল আর রত্নাগড় দুর্গের কিছু দূর পর্যন্ত দিয়ে এসে দৈত্য বিদায় নিয়ে ফিরে এল।

কাছাকাছি আসতেই লোকটা দেখতে পেল দূর্গটা পুরোটা একটা কাঁচের পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আর সব জাদু প্রহরীরা দুর্গের চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে; তাদের চোখ এড়িয়ে দুর্গের কাছাকাছি আসতেই সে দেখতে পেল অনেক ওপরে রাজকন্যা দাঁড়কাকের রুপে পাহাড়ের ওপর বসে রয়েছে। তাকে দেখেই লোকটার প্রানে খুশীর জোয়ার এল আর সে কাঁচের পাহাড় বেয়ে দাঁড়কাকের কাছে পৌঁছোবার চেষ্টা করতে থাকল; কিন্তু পাহাড়তো কাঁচের তাই যত সে ওপরে উঠতে চায় ততই সে পা হড়কে নিচে চলে আসে; এমন করে কেটে গেল দিন কেটে গেল রাত কেটে গেল বছর- কিন্তু লোকটা মনস্থির করে ফেলেছে রাজকন্যা কে উদ্ধার না করে সে বাড়ী ফিরবে না। তাই পাহাড়ের নিচে সে তার নিজের একটা থাকার ঘরও বানিয়ে ফেলল আর সেখান থেকেই রোজ সে একবার করে পাহাড়ে চড়ার চেষ্টা করে আর দেখে তার মাথার ওপর দাঁড়কাকের রুপ নিয়ে পাহাড়ের ওপর রাজকন্যা ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ায় আর দুপুর হলেই দুর্গের ভেতর ঢুকে যায় । দুঃখ হলেও সে এবার হাল ছাড়বে না ঠিক করেছে।

একদিন সে তার তার ঘর থেকে দেখতে পেল তিনজন চোর নিজেদের মধ্যে খুব ঝগড়া করছে কি একটা জিনিস নিয়ে। খানিকক্ষন দেখার পরও যখন সে দেখলো তাদের ঝগড়া থামছে না তখন মনস্থির করল সেখানে গিয়ে ব্যাপারটা একটু দেখে আসা দরকার। কাছে আসতেই সে জানতে পারল তাদের ঝগড়ার আসল কারন। প্রথম চোর বললো সে একটা জাদুকাঠি পেয়েছে যা দিয়ে ছুঁলে পৃথিবীর সব বন্ধ দরজাই খুলে যাবে, দ্বিতীয় চোর বললো সে একটা জামা পেয়েছে যা পরলে সবার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যাবে আর তৃতীয় চোর বলল সে একটা ঘোড়া পেয়েছে যাতে যেখানে খুশি অনায়াসে যাওয়া যাবে এমনকি কাঁচের পাহাড়েও পৌঁছোনো যাবে। তারা ঠিক করতে পারছে না কোনটা কে নেবে,  নাকি তারা তিনজনে ভাগাভাগি করে নেবে সব জিনিসগুলো!

মুর্হুতের মধ্যে লোকটার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। সে বলল আমি এর একটা সহজ উপায় বের করে দিতে পারি তোমাদের-তোমরা তোমাদের তিনটে জিনিসই আমাকে দিয়ে দাও আমি এর বদলে তোমাদের আরও মূল্যবান জিনিস দেব। সেটা হয়ত অর্থ নয় কিন্তু অর্থের থেকেও মূল্যবান। কিন্তু, তার জন্য আমাকে আগে পরীক্ষা করে দেখাতে হবে তোমরা যা বলছ তা সবই সত্যি। তখনই তৃতীয় চোর তাকে ঘোড়ায় বসিয়ে দিয়ে বলল দেখো, এ ঘোড়া তোমায় সত্যি যেকোনো জায়গায় নিয়ে যায় কিনা আর বাকি দুই চোরও তার হাতে জামা আর জাদুকাটি দিয়ে দিল পরীক্ষা করার জন্য। জাদুকাঠি পাওয়ার সাথে সাথেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল আর ঘোড়া ছুটিয়ে কাঁচের পাহাড় বেয়ে রত্নাগড় দূর্গের দিয়ে উঠতে লাগল। লোকটাকে দেখতে না পেয়ে আর ঠকে গেছে বুঝতে পেরে চোর তিনটে তো ততক্ষনে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে গেছে।

এদিকে দুর্গের সামনে আসতেই লোকটা দেখল দুর্গের দরজা ততক্ষনে বন্ধ হয়ে গেছে, সে জাদুকাঠি ছোঁওয়াতেই দরজা খুলে গেল আর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।সেখানেই সে দেখতে পেল রাজকন্যা একটা বড় পাত্রে আঙুরের রস নিয়ে বসে রয়েছে মনকেমন করে। সাথে সাথেই তার হাতের আংটি রাজকন্যার সামনে রাখা পাত্রে সে ফেলে দিতেই শব্দ করে উঠল। রাজকন্যা আংটি হাতে নিয়েই তার নাম লেখা দেখে বুঝতে পারল যে সেই মানুষটা এসে গেছে যে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। আর তাকে দাঁড়কাক হয়ে বাইরে উড়ে উড়ে বেড়াতে হবে না। রাজকন্যাতো লোকটাকে আর দেখতে পাচ্ছে না, সে যে জাদু জামা পড়ে অদৃশ্য হয়ে রয়েছে। চারিদিকে তাকাতে লাগল রাজকন্যা, আর লোকটা ঘোড়া থেকে নেমে রাজকন্যাকে কোলে তুলে ঘোড়ায় চেপে বসল, তারপর ঘোড়া চালিয়ে সোজা দুর্গের বাইরে। দুর্গের সবাই ছুটে এসে রাজকন্যাকে খুঁজতে লাগল কিন্তু তারা তাকে পাবে কি করে? লোকটা তো বাতাসের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে রাজকন্যাকে দুর্গের বাইরে নিয়ে চলে এসেছে ততক্ষনে।

রাজকন্যাকে নিয়ে ফিরে এলে রাজা আর রানির আনন্দ দেখে কে! তারা তো আনন্দে কেঁদেই ফেললেন আর রাজকন্যা?

সে আর কি করবে?- লোকটার বাঁদিকের গালে ঠোঁট বুলিয়ে বলল তুমি আমায় উদ্ধার করেছো। তুমিই আমার বর। তারপর ধুমধাম করে রাজকন্যার সাথে লোকটার বিয়ে দিলেন রানিমা আর তারপর থেকে তারা পরমসুখে আনন্দে দিন কাটাতে লাগল।

(জার্মানীর রূপকথা অবলম্বনে)


রমিত দে
কলকাতা

More articles from this author