খেলাঘরখেলাঘর

 

কাঠের ঘোড়া

 

অনেক দিন আগে এক ভিনদেশের রাজা রাজকন্যা অলকানন্দার অসামান্য সৌন্দর্যের কথা শুনে রাজার কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন যে তিনি তার পুত্র রাজকুমার সোমদেবের সাথে রাজকন্যার বিয়ে দিতে চান। কিন্তু রাজা তখন সে আবেদন প্রত্যাখান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন রাজা ভাবলেন রাজকন্যাকে এই ভাবে রক্ষা করা অসম্ভব। তার থেকে ভীনদেশের সেই রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভাল।

তিনি ভিনদেশের রাজার কাছে দূত পাঠালেন। সঙ্গে লিখে দিলেন এক চিঠি – আমার কন্যার এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। আমি চাই আপনার পুত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হোক। বিয়েটা সুসম্পন্ন হলে আমরা চির আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ হব ও আমাদের দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হবে। আপনি যদি এই প্রস্তাবে রাজি থাকেন তাহলে দয়া করে রাজপুত্রকে নিয়ে আমাদের দেশে আসুন ও বিবাহ সুসম্পন্ন হলে পুত্রবধূ নিয়ে নিজের দেশে ফিরে যান।



এ পাশে রাজপুত্র দিগ্বিজয় রাজকন্যা অলকানন্দার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পরেও রাজকন্যার দেখা না পেয়ে তার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। এখন সে কি করে! রাজকন্যাও নেই। তার অত শখের কাঠের ঘোড়াটাও নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সে এক মরুভূমির মধ্যে বসে আছে। যে দিকে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ করছে শুধু বালি আর বালিয়াড়ি। মাথার ওপর প্রখর সূর্য। কাঠ ফাটা রোদ আর ভয়ানক গরম। কোথাও সবুজের কোন চিহ্ন মাত্র নেই।

যত সময় যেতে থাকে তত খিদে আর তেষ্টায় সে কাতর হয়ে পড়ে। শেষে এক সময় সে আর থাকতে না পেরে জলের খোঁজে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু কোথাও কোন জলও নজরে পড়ে না। ভাবল বালির পাহাড়গুলোর ওপর উঠলে কিছুটা দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। বুঝতে পারা যাবে জল কোন দিকে আছে। কিন্তু বালির পাহাড়ের ওপর উঠতে গিয়ে তার পা এমন বালির মধ্যে ঢুকে যেতে লাগল যে হাঁটাই কষ্টকর। অনেক পরিশ্রম করে সে যখন ওপরে পৌঁছল তখন মনে হল পায়ের তলার বালিটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা। দেখল বালির পাহাড়ের অন্য দিকে এক সুন্দর সবুজ বাগান। সে গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড় থেকে নেমে পড়ল। বাগান ভরা ফলের গাছ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। লাল, সবুজ আরও নানা রঙ-বেরঙ্গের পাকা পাকা ফল দেখে সে লোভ সম্বরন করতে পারল না। খিদেও পেয়েছিল খুব। সে তাড়াতাড়ি কয়েকটা পাকা পীচ ফল পেড়ে এক গাছের ছায়ায় বসে খেয়ে নিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল গাছের তলাতেই।

যখন তার ঘুম ভাঙ্গল, তখন তার গাল আর চিবুকে কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হল। হাত দিয়ে দেখল গোঁফ দাড়িতে ভর্তি হয়ে গেছে মুখ। খুব অবাক হয়ে গেল সে। কি হতে পারে তার এই ভাবতে ভাবতে সে ফলের বাগানে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। ভাবল বুঝি পীচ খেয়েই তার এরকম দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। একটু পরে আবার খিদে পেয়ে গেল তার। কিন্তু এবার ভয়ে সে আর পীচ খেল না। দেখল অনেক গুলো ন্যাসপাতি গাছও আছে। একটা গাছের ডাল সাবধানে নীচু করে কয়েকটা বড় দেখে ন্যাসপাতি পেড়ে খেয়ে নিল। তারপর আবার ঘুম পেয়ে যায়। তাই গাছের তলাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ঘুম থেকে উঠে বসতে গিয়ে মাথাটা খুব ভারি লাগল। মাথায় হাত দিতেই বুঝতে পারল তার দুটো মোটা মোটা শিং গজিয়েছে। তার দাড়িটাও বেড়ে এক হাত লম্বা হয়ে গেছে। কি ভয়ংকর দেখতে লাগছে তাকে এই ভেবে আঁতকে উঠলো সে। রাজকন্যা যদি এখন কাঠের ঘোড়ায় চড়ে ফেরতও আসে তাহলেও ওকে চিনতে পারবে না, ভালো ও বাসবে না আর।

তাহলে এখন কি করা যায় ভেবে দুঃখে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল।

খুব বুড়ো একটা লোক তার কাছে এসে জিগ্যেস করছে - বাছা, তুমি এতো বিমর্ষ কেন?

ও তখন সব খুলে বলল লোকটিকে। লোকটি বলল

-চিন্তা কোরো না। যাও গিয়ে কয়েকটা শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতি গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নাও। সে গুলো খেয়ে ফেললেই তোমার গোঁফ দাড়ি আর শিং সব অদৃশ্য হয়ে যাবে। তুমি আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে। তারপর এই জায়গা ছেড়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও। এখানে অনেক দুষ্ট দানব, দৈত্য, ভূত প্রেতরা থাকে। তারা এখন ঘুমিয়ে আছে। জেগে উঠলেই তোমাকে মেরে খেয়ে ফেলবে।

ঘুম ভেঙ্গে যায় রাজপুত্র দিগ্বিজয়ের। চোখ মুছে উঠে বসে সে। ঠান্ড হাওয়া দিচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে স্বপ্নে দেখা বুড়োটার কথা অনু্যায়ী শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতি কুড়িয়ে নেয় গাছের তলা থেকে। সেগুলো মুখে পুরে চিবোতে আরম্ভ করে। দেখতে না দেখতে সত্যিই তার দাড়ি গোঁফ আর শিং সব মিলিয়ে গিয়ে ও আবার আগের মতো হয়ে যায়। সে খুশিতে ডগমগ হয়ে যায়।

তারপর কি যেন ভাবে। তারপর উইলো গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে তাই দিয়ে এক ঝুড়ি বানায়। সেউ ঝুড়ি ভরে অর্ধেক পাকা আর অর্ধেক শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতি ভরে নেয়। তারপরেই ঐ বাগান ছেড়ে জলদি পালিয়ে যায়।

যে করেই হোক তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কিন্তু কোন পথে গেলে বাড়ি পৌঁছবে তা বুঝতে পারে না। তাই শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। খাদ্য হিসেবে শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতিই এখন তার একমাত্র ভরসা। ঘুম পেলে ঘুমাতে হবে এই মরুভূমিতেই। সে তাও চলতেই থাকে। এই ভাবে সাত দিন সাত রাত্রি হেঁটে চলে সে। মানুষ তো দূরের কথা কোথাও কোন পাখিও নজরে পড়ে না তার। হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে মরুভূমিতেই বসে পড়ে। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে সে হাঁটতে থাকে।

শেষ একটা বিশাল চওড়া রাস্তা দেখতে পায়। সে ভাবে রাস্তা যখন আছে, তখন কোন না কোন লোক এখান দিয়ে ঠিক যাবে। এই আশায় সে রাস্তার ধারে বসে বিশ্রাম করে। হঠাৎ দেখে একটা লোক গাধার পিঠে চেপে যাচ্ছে। লোকটার সঙ্গে কথা বলে ও জানতে পারে যে ওর নিজের দেশ পূর্ব দিকে আর রাজকন্যা অলকানন্দার দেশ পশ্চিমে। কিন্তু দুটো দেশই অনেক অনেক দূরে। হেঁটে পৌঁছতে অনেক দিন লাগবে। কাঠের ঘোড়াটা থাকলে এক নিমেষে পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু সেটাও নেই সঙ্গে। ভাবতে থাকে কোন দিকে যাবে। রাজকন্যার কথা মনে পড়তে ঠিক করল রাজকন্যার দেশেই আগে যাবে। রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল সে।