খেলাঘরখেলাঘর

 

কাঠের ঘোড়া

 

অনেকক্ষন হাঁটার পর হঠাৎ অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ পেল। যেন কেউ জোরে জোরে কিছু আদেশ করছে। তারপর একটু অপেক্ষা করতেই দেখতে পেল একটা বিশাল রাজকীয় শোভাযাত্রা চলেছে। ঘোড়ায় চেপে চলেছে অনেক সৈন্য সামন্ত, ঘোড়ায় টানা গাড়িও আছে অনেক। শোভাযাত্রার মাঝে বড় ও খুব সুন্দর একটা সোনার কাজ করা গাড়ি । তার তিনদিকে কাঁচের জানলা, একদিকে কাঁচের দরজা। যে চারটে ঘোড়া টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই গাড়িটা তাদের গায়ে মাথায়ও সোনার কাজ। চারিদিকে সৈন্যরা নিশ্ছিদ্র পাহারা দিয়ে চলেছে।

রাজপুত্র ওদের পথ করে দেওয়ার জন্যে রাস্তা থেকে একটু সরে দাঁড়ায়। হঠাৎ গাড়িটা এসে ওর সামনে থেমে গেল। একটা প্রহরী জিগ্যেস করল

– তুমি কি বিক্রী করছ?

– কিছু না।

লোকটি ওর ঝুড়ির দিকে দেখিয়ে জিগ্যেস করল – তোমার ঝুড়িতে তো পীচ আর ন্যাসপাতি আছে। আমাদের রাজপুত্র খুব ক্ষুধার্থ। আমরা ঐ ফলগুলো কিনতে চাই। কত দামে বিক্রী করবে ?

-কিন্তু এই ফলগুলো বিক্রীর জন্যে নয়। এগুলো আমি রাস্তায় খিদে পেলে খাবো বলে নিয়ে যাচ্ছি। দেখছ না এখানে কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। একটুও সবুজের কোন চিহ্নমাত্র নেই। এগুলো বিক্রি করে দিলে আমি কি খেয়ে বেঁচে থাকব?

ভিনদেশী রাজকুমার গাড়ির ভেতর থেকে একটা মোহর এগিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল

-যা দাম চাইছে তাই দিয়ে ফলগুলো কিনে নাও। রাস্তায় বেশি সময় নষ্ট করো না।

সে জিগ্যেস করল – তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

-আমাদের রাজকুমার পশ্চিমে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।

প্রহরীকে আরো কিছু প্রশ্ন করে সে বুঝতে পারল এরা রাজকন্যা অলকানন্দার দেশেই যাচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বাইরে কিছু প্রকাশ করল না। সে ফল বিক্রি করতে রাজি হল। মোহরটা নিয়ে সে বেছে বেছে সব থেকে ভালো দেখে দুটো পীচ আর দুটো ন্যাসপাতি দিল ।

ভিনদেশের রাজকুমার সোমদেব এমন সুন্দর ফল দেখে খুব খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি গোগ্রাসে খেয়ে ফেলল। শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল। গাড়ির দুলুনিতে তার ঘুমিয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সে নিজের অবস্থা দেখে হাত পা ছুঁড়ে চীৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করল। প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে। গাড়ির ভেতরে মুখ বাড়িয়ে দেখে রাজকুমার নয় যেন এক দৈত্য বসে আছে। মুখে বিশাল সাদা দাড়ি, মাথায় বিশাল দুটো শিং। তারা আতঙ্কিত হয়ে চেঁচামিচি আরম্ভ করল। গোটা শোভাযাত্রাটাই তখন থেমে গেল। সবাই ভাবল ফলওয়ালার ফল খেয়েই এই অবস্থা হয়েছে। ওরা শোভাযাত্রা থামিয়ে ফলওয়ালার জন্যে অপেক্ষা করে থাকল। কিছুক্ষন পরে ফলওয়ালা বেশি রাজপুত্র দিগ্বিজয় আসতেই ওরা তাকে চেপে ধরে

-কি রকম ফল তুমি আমাদের রাজকুমারকে বিক্রি করছ শুনি?

-কেন? গাছ থেকে টাটকা ফল পেড়ে নিয়ে এসেছি আমি।

-তাহলে ফল খাওয়ার পরই আমাদের রাজকুমারের এমন এক হাত দাড়ি আর দুটো শিং গজালো কেন?

সে গাড়ির জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল ভিনদেশী রাজকুমারের কিম্ভুত কিমাকার রূপ। মনে মনে খুব খুশি হল। মুখে বলল - তা আমি কি জানি! আমি তো এই ফল রোজই খাই। কই আমার তো কিছু হয় নি।

এর উত্তরে তারা কিছুই বলার মতো খুঁজে পেল না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা আরম্ভ করল। এই রকম চেহারা নিয়ে তো কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করতে যাওয়া যায় না। গেলেও রাজকন্যার বাড়ির লোকেরা তাড়িয়ে দেবে ওদের। তার থেকে দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। কিন্তু রাজকুমার কিছুতেই দেশে ফিরে যেতে রাজি হল না।

শেষে ভিনদেশের রাজার সব থেকে প্রিয় অমাত্য এসে বল

-আমরা আপাততঃ একটা কাজ করতে পারি। একটা সুন্দর দেখতে ছেলেকে খুঁজে নিয়ে তাকেই রাজকুমার বলে কাজ চালিয়ে দিই। বিয়ের পর রাজকন্যা নিয়ে আমরা দেশে চলে যাব। তখন তো সবটা আমাদেরই হাতে থাকবে। রাজকন্যাকে নিয়ে কি করা হবে তা তখন ভিনদেশের রাজাই স্থির করবেন।

সবার এই পরিকল্পনাটি পছন্দ হল। তারা একটা সুন্দর দেখতে ছেলের খোঁজ করতে লাগল। শেষে ফলওয়ালাকে দেখে সবাই একমত হল যে ওখানে যতজন আছে তার মধ্যে সেই সব থেকে সুপুরুষ। সবাই তাকে অনুরোধ করল রাজপুত্র সেজে তাদের কথা মত কাজটা সুসম্পন্ন করে দিতে।

রাজপুত্র দিগ্বিজয় তো মনে মনে খুব খুশি হল। কিন্তু এমন ভাব করল যে সে এরকম কাজ করতে একেবারেই রাজি নয়। বলল সে তার কাজে বেরিয়েছি। তার এখন এসবের জন্যে একেবারেই সময় নেই। তারা অন্য লোক খুঁজে নিক।

রাজপারিষদরা, অমাত্যরা, প্রহরীরা সবাই মিলে ওকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করতে লাগল। বলল

– তোমায় পাঁচটা মোহর দেবো।

রাজপুত্র বলল – মাত্র পাঁচটা মোহরের জন্যে এরকম ছল-চাতুরীর কাজ আমি করতে পারব না

-তাহলে সাতটা দেবো।

তখন রাজপুত্র রাজি হল। তাকে ওরা ভিনদেশী রাজকুমারের মতো রাজার পোশাক সাজিয়ে দিল। বলল – রাজকুমারের মতো সোজা হয়ে গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে। আর রাজকুমার সোমদেবকে গাড়ি থেকে বার করে ঘোড়ায় চাপিয়ে দেওয়া হল। তার মাথার শিং আর দাড়ি সব ঢেকে দিল কাপড় দিয়ে। তাকে সব সময় মুখ ঢেকে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হল। আরো বলা হল যে রাজধানীতে পৌঁছলে সে যেন সব সময় ঘরের ভেতরেই থাকে। বাইরে বেরনোর কোন দরকার নেই। বাকি যা ব্যবস্থা করার তা তারাই করবে।