খেলাঘরখেলাঘর


সেদিন একটা অদ্ভুত মজা হলো। শনিবার, ছুটির দিনের সকালে উত্তেজনায় একেবারে সাড়ে ছটায় ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। শীতের ভোর,চারিদিকে অন্ধকার ঘুটঘুট্টি,তার মধ্যে
দাঁত মেজে গপগপ করে মুখে চারটে বিস্কুট গুঁজে সাইকেলের চাকায় পাম্প দিতে বসে গেলাম। সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যেতে হবে যে। তুমি নিশ্চই অনেক সকালে ঘুম থেকে ওঠো...মানে তুমি না উঠলেও কেউ কেউ তো ওঠে। আর শনিবারে আমার নিজের ঘুম ভাঙে ভীষণ দেরী করে। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার ভয়ে আর সময়টা বললাম না।

আমার নতুন সাইকেল। বাঁ হাতে সাতটা গিয়ার আর সেই সাতটা গিয়ারের প্রত্যেকটার জন্য হাই, লো, আর মিডিয়াম এই তিনতে গিয়ার। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কটা, আমি মুখে বলি একুশটা। তাতে মনে হয় যেন এটা সাইকেল নয় রকেট। সত্যি কথাটা এই যে রকেট না হলেও সাইকেলটা খুব ভালো আর বেশ জোরে যায়। আমি তো সাঁ সাঁ করে সেটা নিয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে আটটা নাগাদ সেই চত্ত্বরটার সামনে গেলাম যেখানে সবাইকে জমায়েত হতে হবে। প্রথমে তো শীতের হাওয়া একেবারে অস্থির করে দিলো। কিন্তু এই শীত আর বেশিক্ষণ থাকবে না। কারণ এক যে বেলা বাড়বে। কারণ দুই যে সাইকেল চালালে এমনিতেই শীত বেশ কমে যায়। আর সবচেয়ে বড় কারণ হলো এই যে...আমি তো একা নই আরো অন্তত দুশো সাইকেল আমাদের সঙ্গে যাবে।

ভেবে দেখো দেখি আমাদের সামনে পুলিশ, পেছনে পুলিশ নীল আলো জ্বালিয়ে পিঁয়...পিঁয় করে সাইরেন দিয়ে যাচ্ছে আর আমরা নানা রঙের গেঞ্জি, প্যান্ট আর হেলমেট পরে পনপন করে রাস্তা দিয়ে চালাচ্ছি। আমাদের জন্য রাস্তার সব গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে, লোকে হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখছে। এইটা হল বড় রাস্তা। আমরা এই পথে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার পথ গিয়ে পড়বো একটা ছোট রাস্তায়। আর সেখান থেকে মজার শুরু। ঠিক বাঁদিকে একটা ফুলে ভর্তি খাড়া ঢাল পাহাড় থেকে নেমে গেছে সমুদ্রের ওপরে। নিচে ট্রেন যাচ্ছে, ক্যাঁচ করে স্টেশনে থামছে আবার ঘটাং ঘট ঘচাং ঘচ শব্দ করে স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে। আরো মজার কথা এই যে সাইকেলে করে আমরা দিনের শেষে ঠিক যেখানে গিয়ে থামবো এই ট্রেন গুলোও ঠিক সেখানে গিয়েই থামবে। খালি ওরা অনেকটা এগিয়ে আর আমরা অনেকটা পিছিয়ে।

কিন্তু তাতে কি? আমরা তো চারপাশ দেখতে দেখতে চালাচ্ছি। শুধু কি ট্রেন লাইন? ওদিকে ঝকঝকে দিন দেখে সমুদ্রে যে কতলোক ছোট ছোট পাল তোলা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে আর কি বলবো? গেলো বছর আমরাও একটা নৌকা নিয়ে নিজেরা চালিয়ে একটা নদীতে চারদিন ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই গল্প পরে হবে। এত গুলো নৌকা কিন্তু কোনো জাহাজ নেই। থাকবে কি করে? সারা দিন তো মোটে দুটো জাহাজ ভোরে আসে আর সন্ধ্যে বেলায় যায়। এদিকে সাইকেল চালাতে চালাতে রোদ বেড়েছে শীত কেটেছে, আমাদের মনে আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু এত লোক খামোকা শনিবারের সকাল সকাল উঠে সাইকেল চালাচ্ছে কেনো?

আরে সেটা তো এখোনো তোমাকে বলাই হয় নি!

একদিন বিকেলে, সে প্রায় মাস খানেক আগে হবে, আমি বাড়ি থেকে সাইকেলটা নিয়ে বেরোচ্ছি এমন সময় হঠাত এক ভদ্র মহিলা আমার হাতে একটা ছাপানো কাগজ দিয়ে কি সব বিড়বিড় করে বলে আবার চলে গেলেন। কাগজটা হাতে নিয়ে তো আমার চক্ষুস্থির। আমারই পাড়ার দুটো ছেলে তাদের সাইকেল নিয়ে নাকি এই পৃথিবীটার চারিদিকে একটা গোটা পাক দিতে বেরোচ্ছে। জলের ওপর দিয়ে হয়তো জাহাজে কিম্বা প্লেনে যাবে বাকিটা পুরো সাইকেলে। আর তাই ওরা চায়, যত লোক সম্ভব ওদের সঙ্গে যেন প্রথম দিনটা সাইকেল চালায়। দু চাকায় বিশ্ব জয় করতে অবশ্য ওরা দুম করে বেরোয়নি। তার আগে প্রায় দেড় বছর প্ল্যান করেছে, প্র্যাক্টিস করেছে, মানুষজনের সাথে কথা বলে পয়সা কড়ির যোগাড় করেছে। এমনকি মিশরের দক্ষিণ থেকে উত্তরে নীল নদ বরাবর সাইকেল চালিয়েছে।



যাত্রা শুরু

এখন যে ওরা সাইকেলে করে বিশ্ব ভ্রমণে যাচ্ছে, তাতে আবার ওদের সাইকেলের ডিজাইনটা নিজেরাই চিন্তা ভাবনা করে একটু বদলে নিয়েছে। এই যে এতোদিন ধরে ওরা যাবে, তার রসদ কতটা নেবে, কিভাবে নেবে, কোথায় ক'কিলো ঝোলাবে সব হিসেব করেছে। ব্যালান্স রাখতে হবে তো। একটা সাইকেলের পিছনে খুব নীচু চাকাওয়ালা একখানা বাক্স জুড়েছে। সীট গুলোকে কেটে নিজেদের দেহের আকার মতো করে নিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধে যাচ্ছে।

যে ছেলে দুটো এই দুঃসাহসিক কান্ডটা করছে তাদের নাম হলো সাইমন আর ফার্গাল। সাইমন আমাদের সবার সামনে চালাচ্ছে আর ফার্গাল সবার পিছনে। দুজনেই অতি চমতকার ছেলে। কারো সাইকেলের চেন পড়ে গেলে ফার্গাল এসে চট করে সেটা আবার তুলে দিচ্ছে। আবার আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় কোন বিপজ্জনক বাঁক দেখলেই সাইমন চেঁচিয়ে সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছে। আমরা যে এত ঘণ্টা চালাচ্ছি মনেই হচ্ছে না। সাইমন আর ফার্গালের মা, বাবা ভাই বোন সবাই একসাথে আমাদের সঙ্গে চালাচ্ছে।

বিকেল নাগাদ আমরা পাহাড় টাহাড় পেরিয়ে সেই যেখান থেকে ওরা টা টা করে বিশ্ব ভ্রমণে পাড়ি দেবে সেখানে গেলাম। সে কি অবস্থা। এই টুকু টাউন কিন্তু লোকে লোকাকার। কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে, কেউ হুইসল দিচ্ছে, কেউ নাচছে, কেউ রঙ করা শোলার বল বাতাসে মুঠো মুঠো করে ছুঁড়ছে। কেউ লেবু জল কেউ কেক,কেউ স্যুপ এই সব খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আমাদের তো তখন নিজেকে হিরো মনে হচ্ছে। রাজা বাদশার মত সাইকেলে হেলান দিয়ে আমরা খাচ্ছি। এর প্রায় আধ ঘন্টা পরে ওরা আমাদের টা টা করে দুটো সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড় ঘুরে পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে গেলো।

বলো তো দেখি এখন ওরা কোথায়?

যখন এই লেখা লিখছি, ওরা তখন আন্দিজ পর্বতমালায় লাতিন আমেরিকার পেরুতে কুজকো বলে একটা শহরে। ওদের চারিদিকে একগাদা লামা। বৌদ্ধ লামা নয় কিন্তু, সেই যে উটের মতো একটা জন্তু ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মুখে থুথু ছুঁড়তো, সেই লামা। অতি শান্ত চেহারা। কারো কারো মাথায় বিনুনি বাঁধা। কতদূর সাইকেল চালিয়েছে ভাবো দেখি। আমি তোমাকে যে গোপন খবরটা দিলাম সেটা তোমরাও পেতে পারো।


আন্দিজ পর্বতমালায় লামার দল


বলিভিয়ার পথে ছুটছে সাইকেল


পথের বন্ধুদের সাথে সাইমন আর ফার্গাল

ওরা ওদের যাত্রা পথের রানিং কমেন্ট্রি দিচ্ছে ইণ্টারনেটে www.revolutioncycle.ie তে। সঙ্গে ছবি আর ভিডিও। গেলেই বুঝতে পারবে ওরা গত ক মাসে কি কান্ডটাই না করে চলেছে।  আর এখন ঠিক কোথায় আছে সেটাও জেনে যেতে পারো। তোমরা ওদের ওয়েবসাইটে রেগুলার ফলো করতে পারো, এরপর ওরা যায় কোথায়। এখনো প্রায় অর্ধেক রাস্তা বাঁকি। আর কি চাই ছুটির দিন দেখে তুমিও বন্ধুদের সাথে সাইকেল নিয়ে অন্তত বাড়ির আশেপাশে বেড়িয়ে পড়ো এবার। দেখবে কি মজাটাই না হচ্ছে। 

 

বিক্রম
ডাবলিন
আয়ারল্যান্ড

ছবিঃ রেভলিউশন সাইকেল