কলকাতার ভোরে তখন ভৈরবীর মূর্ছণা । পুবের আলো ফুটিফুটি করে সবেমাত্র আলস্য কাটিয়ে উঠছে কুয়াশার চাদর সরিয়ে । বিজয়ার মানখারাপ সেই উঠিউঠি আলোয় সরে গেল । প্লেনের জানলার ধার, ওপর থেকে একচিলতে চেনা নীলনদীর দেহবল্লরী,আর মেঘের পরতে হারিয়ে যাওয়া ঘুমন্ত মহানগরের ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে মেঘসমুদ্রে ভাসমান হল আমাদের প্লেন । অতিবেগনী রাশ্মিমালার সূতো ছিঁড়েখুঁড়ে মেঘের পালকে ভেসে ভেসে ঘন্টাদুয়েকেই দিল্লী । সেখান থেকে একে একে চোখের আড়ালে চলে গেল নতুন দিল্লী, পুরোণো দিল্লীর স্কাইলাইন , হুমাযুনের টুম্ব আর কত স্মৃতিসৌধেরা । যমুনানদীর চোখে তখন শুকনো বালির চর । একে একে পুরোণো শহর গাজিয়াবাদ, মীরাট, মুজজাফরনগর পেরিয়ে উত্তরাখন্ডে প্রবেশ করলাম আমরা । রুরকি এল । শুধু আখের ক্ষেত আর তাকে ঘিরে পপলার গাছ । গঙ্গা চোখের নজরে এল । বুঝলাম হরিদ্বার কাছাকাছি । বর্ষার পরে গঙ্গায় আরো থৈ থৈ জল আশা করেছিলাম কিন্তু লকগেট এবং তেহরী ড্যামের জন্য জল বেশ কম লাগল । মোদীনগর এবং রুরকীতে ট্র্যাফিক জ্যাম থাকায় দিল্লী থেকে হরিদ্বার পৌঁছতে সাত ঘন্টা লেগে গেল । হোটেলে পৌঁছেই মালপত্র রেখে আবার এলাম গঙ্গার ধারে হর কি পৌরিতে । গঙ্গা বয়ে চলেছে আপন মনে । স্রোতও আছে ঠিক যেমন দেখেছিলাম আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে । বেড়েছে জনস্রোত, দোকানপাট আর ট্যুরিষ্ট । কিন্তু গঙ্গার জলে পা ডুবিয়েই মনে হল হরিদ্বার অমলিন । এখানে সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে । কত জল বয়ে গেছে সুদূর হিমালয়ের বরফ গলে গঙ্গার ওপর দিয়ে কিন্তু গঙ্গা পড়ে আছে গঙ্গাতেই । আজন্মকাল ধরে মানুষের পাপ ধুতে ধুতে এখনো ক্লান্ত হয়নি সে ।
হরিদ্বারে গঙ্গা আরতি
হর কি পৌড়ির অর্থ হল শিবের সিঁড়ি। সমুদ্রমন্থনের পর গড়ুর পাখী যখন কলসে করে অমৃত নিয়ে উড়ে চলেছিলেন আকাশে তখন হরিদ্বারের গঙ্গার মধ্যে সেই অমৃতের ফোঁটা নিক্ষিপ্ত হয় এবং এই স্থানকে তাই ব্রক্ষকুন্ড বলা হয় । বৈদিকযুগে নাকি ভগাবান বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এই ব্রহ্মকুন্ড দর্শন করতে এসেছিলেন । এইস্থানে কুম্ভমেলা হয় । সারাবছর ধরে প্রতিদিন বহু পুণ্যার্থী এই হর কি পৌরী আসেন তীর্থ করতে , স্নান করতে এবং অভিনব গঙ্গারতি দেখতে ।
প্রতিদিন সূর্যাস্তে এবং সূর্যোদয়ের পূর্ব মূহুর্ত্তে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে পুরোহিত বিশালাকার প্রদীপ নিয়ে এক অপূর্ব আরতি করেন । প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় নদীর ধারে; মন্ত্রোচ্চারণে , বিশাল ঘন্টাধ্বনিতে, শঙ্খে শঙ্খে অণুরনিত হয় গঙ্গার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । গঙ্গার জলে সেই ফুলের দীপের ভেলার প্রতিচ্ছবি আজো চোখে লেগে রয়ে গেল । গঙ্গার দিকে তাকিয়ে মনে হয় এ কোন্ এক ধর্মভীরুতা ভর করল আমাকে ? তাই কি শিকাগো লেকচারে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন সারা পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থের নীচে রয়েছে ভারতের ভগবত্গীতা । যার অর্থ হল সব ধর্মকে ধারণ করে রেখেছে ভারতের ধর্ম । আর আমি সেই দেশে জন্মেছি ? আমি কত ভাগ্যবতী!
ফুলের প্রদীপ
সূর্যাস্তের হর কি পৌরী একটুর জন্যে মিস হয়ে গেল । আর সেই সাথে গঙ্গার আরতিও । তবে পৌঁছেই পুজো কিনে পাতার ভেলায় ফুল আর কর্পূর দীপের আরতি করলাম মা গঙ্গাকে আর ভাসিয়ে দিলাম গঙ্গার বুকে সেই পাতার একটুকরো নৌকো । দুলে দুলে চলতে লাগলো ফুল-আলোর সেই ভেলা । আমার এবছরের দীপাবলীর সূচনা হল । তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে এক পাল আলোর ভেলা স্রোতের আনুকুল্যে চলতে লাগল সেই মোহানার দিকে । কে জানে কখন নিবে যাবে তারা ! এক সরলরেখায় চলেছে সকলে মিলে । হরিদ্বারের গঙ্গার হাওয়া, দেবভূমির বাতাস বড়ই মনোরম । হেমন্তের বাতাসে একটু ঠান্ডার ছোঁয়া । সব মিলিয়ে কৃষ্ণা একাদশীর রাত ফুরিয়ে গেল সেই হাওয়া মেখে । পতিতোদ্ধারিনি গঙ্গার আরতিতে মানুষের সকল পাপ নাকি ধুয়ে যায় । সেই আশায় মানুষ আসে সেখানে । রাতের ঘন আঁধার তখন ঘিরে ধরেছে হিমালয়কে । দূর থেকে পাহাড়ের মাথায় ঝিকমিক আলো দেখে জানলাম মনসাদেবীর মন্দিরের কথা । ওটি মনসা পাহাড় । মনসা পাহাড়ে মনসাদেবীর মন্দিরে গিয়েছিলাম খুব ছোটবেলায় । কত যে সাধুসন্তরা পর্ণকুটিরে বাস করে পাহাড়ের ওপরে উঠলে তা দেখা যায় । কিছু দূর গেলে কঙ্খল । সাধুসন্তদের জায়গা । আগের দিন সন্ধ্যের গঙ্গারতি না দেখার দুঃখ ভুলালাম পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই হর কি পৌরিতে আবার পৌঁছে। সূর্য তখনো ওঠেনি । আকাশে একফালি শুক্লপক্ষের চাঁদ রয়েছে । বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে গঙ্গার ধারে । কিন্তু আলোর রোশনাই গঙ্গার জলে । আরতির তোড়জোড় চলছে । কতকত মানুষ ঘুম ভুলে, আলস্য ছেড়ে জমায়েত হয়েছে সেই আরতি দেখার জন্য । ঠিক ছ'টা বেজে পাঁচ মিনিটে আরতি শুরু হল । পুরোহিতের হাতে মনে হল একশো আট প্রদীপদান । সাথে গঙ্গার স্তবস্তুতি আর জয়ধ্বনি । ঊষার আকাশ বাতাস অণুরনিত হতে লাগল । আমার গঙ্গার দিকে তাকিয়ে মনে হল মানুষ ঈশ্বরের কি বিচিত্র সৃষ্টি ! তারা গঙ্গার আকর্ষণে কেমন আবিষ্ট হয়ে আসে এখানে । জগতে কত কিছু পরিবর্তন হয় কিন্তু মানুষের ধর্মচেতনা অক্ষয় অব্যয় । কি অপূর্ব এই আরতির দৃশ্য । কি সম্মোহনী শক্তি মা গঙ্গার ! যাইহোক ভোরের সেই গঙ্গারতি লেগে রয়ে গেল দুচোখে । হোটেলে ফিরে এসে সম্পূর্ণ নিরামিশ প্রাতঃরাশ । কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরপুর । একধারে ইডলি-দোসা-সম্বর্-চাটনী অন্যদিকে পরটা-টক দই-আচার । সাথে কুচোনো ফল, দুধ-কর্ণফ্লেক্স তো আছেই । এবার হৃষিকেশ যাবার তোড়জোড় ।