খেলাঘরখেলাঘর

পেরু

পেরু

ছবি তোলা আমার শখ। বছর দুয়েক আগে আমার তোলা একটা ছবি দেখে ন্যাশ্‌নল জিওগ্রাফিক এর গুনীজনেরা পছন্দ করে ফেলেন, আর আমাকে একটা খুব ভাল পুরষ্কার দেন। পুরষ্কারটা কি বলতো? আমার পুরষ্কার ছিল ন্যাশ্‌নল জিওগ্রাফিক এর সঙ্গে চারটে দারুণ জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, এবং আরো ভাল ছবি তুলতে শেখা। ভাব একবার!! যে ন্যাশ্‌নল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের দিকে সারাদিন হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকি আর অবাক হয়ে দেখি বিজ্ঞানী, পশুপ্রেমী এবং ফটোগ্রাফারদের নানারকম অসাধারণ কাজ - তাদেরই সঙ্গে কিনা একসাথে কাজ করব! এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। আর তারপর পৌঁছেও গেলাম তাদের কাছে। ঘুরে দেখলাম দক্ষিণ আলাস্কা, নিউ ইয়র্ক শহর, মেক্সিকো আর পেরু। আজ আমি তোমাকে বলব আমার পেরু ভ্রমণের গল্প।

রিপাবলিক অফ পেরু দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে একটা মাঝারি মাপের  দেশ। এই দেশের একদিকে ছুঁয়ে আছে প্রশান্ত মহাসাগর, আর অন্য দিকে আন্দিজ পর্বতমালা। আর আছে আমাজন অববাহিকার বিস্তীর্ণ জঙ্গল। তবে মোটে সাত-আটদিনে তো একটা পুরো দেশের সব কিছু দেখা যায়না। তাই আমরা প্রথমেই দেখতে গিয়েছিলাম পেরুর সবথেকে জনপ্রিয় দ্রষ্টব্য - ইনকা সাম্রাজ্যের ইতিহাস বহনকারী 'হারানো শহর' -মাছু পিচ্ছু ; দেখলাম চিনচেরো গ্রামে সাবেকি প্রথায় কাপড় বোনার নমুনা ; দেখলাম পেরুর নিজস্ব নৃত্যশৈলী - লা মারিনেরা; আর দেখলাম পেরুর সবথেকে বড় ধর্মীয় উতসব- 'লর্ড অফ মির‌্যাক্‌লস'।

দক্ষিণ আমেরিকাতে ইউরোপীয় দের আসার আগে, ইনকা সভ্যতা ছিল সবথেকে বড় সভ্যতা।ইন্‌কারা তাদের রাজনৈতিক বুদ্ধি আর শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বলে তাদের সাম্রাজ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে বহুদূর বিস্তার করে। মাছু পিচ্ছু খুব সম্ভবত তৈরি করা হয়েছিল ইন্‌কা সম্রাট পাচাকুটির আবাসস্থল হিসাবে। ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দে মাছু পিচ্ছু বানানো শুরু হলেও একশো বছরের মধ্যে এই জায়গা ছেড়ে ইন্‌কারা চলে যায়। স্পেনীয়রা যখন দক্ষিণ আমেরিকায় এসে বিধ্বংসী যুদ্ধ ও লুঠতরাজ শুরু করে, তখনও তারা এই জায়গার কোন খোঁজ পায়নি। ১৯১১ সালে আমেরিকান ঐতিহাসিক হিরাম বিংহ্যাম, পাবলিতো আল্ভারেজ নামে এক স্থানীয় ছোট্ট ছেলের কথা শুনে এই জায়গাটাকে নতুন করে খুঁজে বার করেন।

আগুয়াস ক্যালিন্তেস শহর থেকে বাসে করে পাহাড় কেটে তৈরি করা রাস্তা বেয়ে আমরা চল্লাম মাছু পিচ্ছুর উদ্দ্যেশ্যে। মাছুপিচ্ছু সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৮০০০ ফুটের কাছাকাছি উঁচু। মাছুপিচ্ছুর বসতিটি তৈরি হয় মাছুপিচ্ছু এবং হুয়ানা পিচ্ছু- দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায়। ইনকা ভাষায় মাছুপিচ্ছু শব্দের অর্থ -'পুরোনো পাহাড়'; আর হুয়ানা পিচ্ছু শব্দের অর্থ 'নতুন পাহাড়'।

হুয়ানা পিচ্ছু

মাছু-পিচ্ছুর বাড়িগুলি সব তৈরি হয়েছিল পাথর দিয়ে। আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে তৈরি করা বাড়িগুলির দেওয়াল, উঠোণ, পাঁচিল- সবই পাথর কেটে বানানো হয়েছিল। কিন্তু মজার কথা হল, এই পাথরগুলি কোন কিছু দিয়ে জোড়া দেওয়া নয়। ভূমিকম্প প্রবণ দেশ পেরু। ভূমিকম্প থেকে বাড়িঘর রক্ষা করার জন্য এই ভাবে পর পর মসৃণ পাথর সাজিয়ে ঘর বানাত ইনকারা। মাছু-পিচ্ছুকে এই কারণে বলা হয় স্থাপত্যকলার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তাদের বাড়ি ঘর গুলিও তৈরি হত বিশেষ কতগুলি নিয়ম মেনে, যাতে ভূমিকম্প হলে সবথেকে কম ক্ষতি হয়।

বাড়ি


মাছু-পিচ্ছুর সবথেকে চেনা ছবি হল পাহাড়ের গা কেটে ধাপে ধাপে বানানো চাষ করার জমি। পৃথিবীর অনেক দেশ সহ আমাদের দেশেও পাহাড়ী অঞ্চলে এইভাবে চাষ করা হয়।

ধাপ


ইনকারা তাদের মৃতদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এক বিশেষ নিয়মের সূচনা করেছিল। তারা তাদের প্রিয় মৃত মানুষ এমনকি পোষা প্রাণীদের দেহ এক বিশেষ ঘরের ভেতর রাখত এবং ফুল খাবার ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে রাখত। আমরা দেখলাম সেইরকম একটা ঘর, যেখানে ঠিক সে পুরানো দিনের মত করে সব সাজিয়ে রাখা আছে।

মৃতদের ঘর


সেই সময়ের মানুষ নাগরিক জীবন সম্পর্কে কত উন্নত ভাবনা চিন্তা করত, বোঝা যায় রাস্তার মাঝখানে সুন্দর ভাবে কাটা জল যাওয়ার নালা দেখে।

নালা


একটাই মাত্র বিশাল পাথর কেটে বানানো এই স্থাপত্যের নাম হল 'ইন্‌তিহুয়াতানা'। ইন্‌তিহুয়াতানা খুব সম্ভবত ছিল ইন্‌কাদের সূর্য ঘড়ি, কারণ ইন্‌কাদের ভাষায় এই শব্দের মানে হল -'যেটা সূর্য কে বেঁধে রাখে';

ইনতিহুয়াতানা


মাছুপিচ্ছু কে ইউনেস্‌কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে গন্য করা হয়। ২০০৯ সালে এক ইন্টারনেট পোলের মাধ্যমে মাছু-পিচ্ছুকে নতুন পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে একটি ঘোষণা করা হয়।

মাছুপিচ্ছু দেখতে তো একদিন কেটে গেল। যদিও ইন্‌কারা যে পথে পাহাড় বেয়ে উঠত, সেই ইন্‌কা ট্রেইল ধরে ওপরে ওঠা বা নামা হল না।