খেলাঘরখেলাঘর

সে অনেক দিন আগের কথা...হ্যাঁ তা প্রায় পাঁচকোটি বছর হবে, মানুষের উদ্ভব হয়েছিলো পৃথিবীতে। সময়ের গতিতে বিবর্তনের ধাপে ধাপে এই প্রাচীন মানুষই (Primates)ক্রমে নিপুণ মানুষ (Homo habilis)থেকে বুদ্ধিমান মানুষে(Homo sapiens) রূপান্তরিত হতে হতে তৈরী হয়েছে আজকের এই মানব সমাজ।

তুমি নিশ্চই জানো আদিম মানুষের জীবন ধারণের প্রথম ও একমাত্র উপায় ছিলো শিকার করা। অন্য সব প্রাণীর চেয়ে শারীরিক শক্তিতে দুর্বল মানুষকে তাই সহায়তা নিতে হয়েছে অস্ত্রের। পাথরের ভোঁতা সেই অস্ত্র সময়ের সিঁড়ি বেয়ে পরিবর্তিত হয়েছে ধাতুর অস্ত্র সম্ভারে। জীবন রক্ষায়,খাদ্যের প্রয়োজনে একাকী অথবা যুথবদ্ধ ভাবে গোষ্ঠীতে থাকা মানুষের শিকার সন্ধানের আদিম চেষ্টাই আজকের সব খেলাধূলার শিকড়। কি অবাক হচ্ছো নাকি? কিন্তু ভেবে দেখো অন্য প্রতিযোগীকে দৌড়ে হারিয়ে শিকার করে নিজের গোষ্ঠীতে ফিরে আসা কিম্বা সাঁতারে জলাভূমি, নদী পার হয়ে অন্য এক ভূখন্ডে বসতি স্থাপন করার প্রাণান্ত প্রয়াসে শারিরীক সক্ষমতা আর বুদ্ধিই তাদের সম্বল। কাউকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ...বলতে পারো একটা চ্যালেঞ্জ।

আমাদের এই যাযাবর শিকারী জীবনের থেকে আজকের উত্তরণ সম্ভব হয়েছে আমাদেরই কোনো এক আদি জননীর উদ্ভাবিত কৃষি পদ্ধতির সৌজন্যে। কৃষির ফলেই আমাদের সমাজ জীবন স্থিত হবার সুযোগ পেয়েছে। পেয়েছে তার পরম প্রিয় গেরস্থালী। বাবা, মা, ভাই, বো্‌ন, ঠাকুমা, দিদিমা সবাইকে নিয়ে হৈ হৈ করা এক সংসার। আদিম সেই শিকারী জীবনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু সেই কৃষি জীবনের সুন্দর ছান্দিক সুরের মধ্যে কোথাও না কোথাও থেকে গেছে আমাদের সেই আদিম জীবনের শিকারের ছবি। বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে মনে হয়তো বা কোনো এক খেলার রূপ নিয়ে। মানুষ সেগুলো তখন বেশ তাড়িয়ে উপভোগ করেছে সুস্থ বিনোদনের তাগিদে।

ভাবছো এ আবার কি...!ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার সময় থোড়াই না আমরা এরকম ভাবি। আচ্ছা যদি একটু গম্ভীর হয়ে ভাবি তাতে ক্ষতি কি? যেমন ধরো সেই সব খেলা গুলো তীরন্দাজি, অসিচালনা, কুস্তি, মুষ্ঠি যুদ্ধ,লাঠিখেলা,ঘোড়-দৌড় কত কত খেলার কথা বলবো আর। ব্যক্তিগত ভাবে এইসব খেলার দক্ষতা বিচারে বিজয়ী হবার গৌরবে গোষ্ঠীতে সেই মানুষটার একটা আলাদা পরিচয় হতো। স্মমান বাড়তো। গোষ্ঠীর লোকজন গর্ব করে বলতেন তাঁর কথা।


সাঁতারুর দল


চাকার আবিষ্কারের পরেই সামাজিক মানুষও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। দ্রুত হয়েছিলো তাদের জীবন যাপন প্রণালী। গোলাকার বস্তু নিয়ে খেলার একটা প্রবণতাও বেড়ে গিয়েছিলো। শুরু হল গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে খেলা। বিজয়ী গোষ্ঠীর আনন্দ তখন আর দেখে কে। পুরষ্কারের কথা নিশ্চই জানতে ইচ্ছে করছে। দাঁড়াও তাহলে বলি তোমাকে, খুব একটা আহামরি ছিলো না কিন্তু সেইসব বিশেষ করে আজ তোমরা খেলে যে সব পাও তার কাছে খুবই নগন্য। পুরস্কৃত মানুষটিকে দেওয়া হলো হয়তো সামান্য পশু মাংস কিম্বা জীবন ধারণের কিছু টুকরো টাকরা। পুরষ্কার সামান্য হলে কি হবে তার সাথে সম্মানটাই ছিল অসামান্য। রাতারাতি হিরো হয়ে যেত সেই দল কিম্বা গোষ্ঠী। খেলার এই ইতিহাসের এখোনো কিছু নিদির্শন আমরা পাই খ্রীষ্ট জন্মের আগে মিশরীয় ছবিতে স্থাপত্যে।

মহাভারতের কুরু-পান্ডবের অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষার প্রথম শিক্ষক ছিলেন কৃপাচার্য। একদিন রাজকুমারদের গুলিডান্ডা (ডাংগুলি?)খেলার মাঝে গোলকটি একটি কূপের মধ্যে পড়ে যায়। গুলিটি উদ্ধারে রাজকুমারদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখে দ্রোণাচার্য তাঁর অদ্ভুত পারদর্শিতায় কুশ দিয়ে সেটিকে উদ্ধার করে দেন। ফলে কৃপাচার্যকে সরিয়ে তিনিই রাজকুমারদের অস্ত্র গুরু রূপে ভীষ্মের মনোনয়ন পান। দ্রোণাচার্য শিক্ষান্তে তাঁর ছাত্রদের অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষার কুশলতা প্রদর্শনের জন্য যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন সেইখানেই সূত পুত্র বলে উপহাসিত হন কর্ণ। রাজকুমার দুর্যোধনের বদান্যতায় অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন বটে কিন্তু রাজকুমারদের সাথে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি পাননি। এরপর ঠিক কি ঘটেছিলো সেটা না হয় আর এক দিন তোমাকে বলবো।

পুরাণের আলো-আঁধারির এই কথা কাহিনী ছেড়ে আমরা যদি আধুনিক যুগের খেলাধুলার কথায় ফিরি তবে দেখা যাবে খেলার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওলিম্পিক প্রতিযোগিতার আগেও মিশর, মেসোপটেমিয়া, চিন ও ভারতবর্ষে খেলাধুলোর অনেক ইতিহাস ছড়ানো ছিটোনো রয়েছে। ওলিম্পিক এর আগে খেলাধুলোর অলিখিত ইতিহাসের একমাত্র ব্যতিক্রম মিশরের দেওয়াল চিত্রে কুস্তি প্রতিযোগিতার বিশদ ছবি।

পৃথিবীতে ধারাবাহিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসে। ৭০৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে প্রথম অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতা চার বছর অন্তর নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৯৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ৩৯৩ খ্রীষ্টাব্দে রোমান সম্রাট থেওদোসিওস এই বিশাল প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিংবদন্তি অনুসারে প্রাচীন এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উতপত্তি পেলোপ্‌স এবং ওইনোমস্‌-এই দুই বিখ্যাত দৌড়বীরের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
অন্য আর এক কিংবদন্তিতে সুবিখ্যাত গ্রীক বীর হেরাফ্লেস'ই এই প্রতিযোগিতার প্রতিষ্ঠাতা। গ্রীসের পেলোপস্‌লেসের এলিস প্রদেশে গ্রীক দেবতা জিউস এর দেবস্থান ওলিম্পিয়া থেকেই প্রাচীন মহান এই ক্রীড়া উতসবের উতপত্তি আর বিকাশ।



প্রাচীন অলিম্পিয়া, যেখানে অলিম্পিক শুরু হয়


১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে বাঁর পিয়ের দ্য কুবেয়ারত্যাঁর(১৮৬৩-১৯৩৭) ঐকান্তিক চেষ্টায় পুনরায় এই অলিম্পিক শুরু হয়। সেই অলিম্পিক এর আসরে যুক্ত হয় অন্যতম একটি প্রতিযোগিতা ম্যারাথন দৌড়। ফাইডিপাইডিস নামের এক সংবাদ বাহক মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই প্রতিযোগিতার নামের মধ্যে। ৪৯০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ম্যারাথন রণাঙ্গন থেকে গ্রীস বাহিনীর যুদ্ধ জয়ের খবর প্রায় ছাব্বিশ মাইল অতিক্রম করে সেই সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন ফাইডিপাইডিস। সংবাদ পৌঁছে দেবার পরই তাঁর মৃত্যু হয়। এথেন্সে অনুষ্ঠিত প্রথম অলিম্পিকে এক গ্রীক দৌড় বীর এই ম্যারাথন দৌড় জিতে তাঁর দেশবাসীকে গর্বিত করেছিলেন। তুমি নিশ্চই জানো আধুনিক অলিম্পিকের মূল লক্ষ্য শুধু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহ করা নয়-খেলাধুলোর মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জাতির মধ্যে মৈত্রী, প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ত্ব গড়ে তোলা।



দৌড় প্রতিযোগিতা


যে খেলা শুরু হয়েছিলো নিছক বিনোদনের জন্য...যে খেলার স্মৃতিতে ছিলো আদিম জীবনের কষ্টকর  রেশ...ছিলো যুদ্ধের এক করুণ কাহিনী...সেই খেলাই আজ দেশ-কাল-গন্ডির সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপ্ত। খেলার ইতিহাস বিশাল। লিখিত আকারে যা আছে অলিখিত থেকে গেছে অনেক কিছু। সেই সব জানা-অজানা নানান কথা নিয়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো আগামী সংখ্যায়। ততদিনে তুমি আরো কিছু নতুন খেলা শিখে নাও। ভালো থেকো।

 

প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়
বালী, হাওড়া

ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
 
এস-এক্স-সি