খেলাঘরখেলাঘর

Maradona title
তোমার স্কুলে যাওয়ার পথে কিম্বা বাবা মার সাথে বেড়াতে যাওয়ার সময় কখোনো কি চোখে পড়েছে ছেঁড়া জামা...ধুলো গা...করুণ মুখের কোনো ছোট্টো বাচ্চাকে? যে সারা সকাল কাজ করছে অথবা আপন মনে খেলে চলেছে ফুটপাথের ধারে। একটু খেয়াল কোরো, নিশ্চই দেখতে পাবে। কখোনো সেও হয়তো ফিরে দেখবে তোমাকে, চাইবে তোমায় বন্ধু করতে।
 
ভাবছো তো কেন বলছি এতো সব কথা। আসলে ঠিক এরপর থেকে বেশ কিছুক্ষণ আমরা এমন একটা মানুষের সঙ্গে থাকবো,সময় কাটাবো, যার ছোটোবেলাটা কেটেছিলো ভিলা ফিওরিতোর ফুটপাথে খুব কষ্টের সঙ্গে। উস্কোখুস্কো চুল,খালি গা,ঢোলা হাফপ্যান্ট। ছেলেটাকে সবাই চিনতো। কারণ একটু রুটির লোভ দেখালেই ছেলেটা অসাধারণ খেলতো। কোনো হারা খেলা জিতিয়ে দিতো অনায়াসে। ডিমান্ড বাড়ছিলো ছেলেটার। ফুটপাথের রাস্তা থেকে পাশের পাড়া...তার পাশের পাড়ায় ডাক পড়ছিলো। আর অবাক হয়ে সবাই দেখছিলো ওই অতটুকু ছেলেটার খেলার ছন্দ। কিছুদিনের মধ্যেই সবার মুখে মুখে ফিরতে থাকলো পিবে-ডি-অরো...পিবে-ডি-অরো। মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় করলে যার অর্থ সোনার ছেলে।
 
 এইতো সেদিন কলকাতায় এসে ছিলেন সেই সোনার ছেলে মারাদোনা। গোটা শহর মেতে ছিলো তাঁকে নিয়ে। ফুটবলের জাদুকর উজার করে দিলেন তাঁর সব ভালোবাসা এই শহরকে। বারবার বললেন আমি তোমাদেরই লোক। আর কলকাতা বললো, তুমি আমাদের সোনার ছেলে।
 
ভিলা ফিওরিতো আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আয়ারসের একটা বস্তির নাম। যেখানে ড্রাগ মাফিয়া থেকে চোরাকারবারি সবার অবাধ যাতায়াত, বলা যায় বিচরণ ক্ষেত্র। মারপিট,খুন-রাহাজানির নিত্য নতুন ঝামেলা। বস্তিটা যেন একটা নরক। এখানেই জন্ম দিয়েগোর। পুরো নাম দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা। কলকাতায় মারাদোনা সাংবাদিক সন্মেলনে জানালেন তাঁর নামের রহস্য। আসলে তাঁর বাবার নাম দিয়েগো আর মায়ের নাম আরমান্দো। দুইয়ে মিলে দিয়েগো আরমান্দো। দিয়েগোরা আটজন ভাইবোন। বাবা মাকে নিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা দশজন। একে রোজ ভরপেট খাওয়া জোটে না। তারপর দশজনে ভাগ করে খাওয়া। ঠিক এমন এক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছিলেন ফুটবলের সেরার সেরা মারাদোনা।
 
ভাবছো তো কি করে এটা সম্ভব হলো। আমি বলোবো, নিরলস চেষ্টা আর ফুটবলকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। কাজেই ঢোলা হাফপ্যান্টের সেই উস্কোখুস্কো ছেলেটার জীবনের প্রতিটা বাঁকে যে রূপকথার ছোঁয়া থাকবে তা মনে হয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র তিন বছর বয়সে ফুটবলের সাথে প্রথম পরিচয়। মারাদোনার কোনো এক তুতো ভাই তাঁর দিকে খেলার জন্য ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ফুটবল। সেই প্রথম থেকেই সারাদিনের এমনকি রাতের ঘুমোনোর সঙ্গীও ওই চামড়ার গোলকটা। এর পিছনে কি ছিলো কোনো সঙ্কল্প,জেদ? মারাদোনা বলেছেন...তার থেকেও অনেক বেশি-ভালোবাসা। ফুটবলকে ভালোবাসা। তাঁর জীবনের সুখ,দুঃখ,হতাশা,ভালোবাসা...এমনকি বাঁচাটাও ওই ফুটবলকে ঘিরে। টিভিতে নিশ্চই দেখেছো বুকের বাঁদিকে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত বারবার চাপড়াচ্ছেন। ওটার মানে কি জানো?"আমি আছি আমার হৃদয় দিয়ে...আমার এই হৃদয় তোমার জন্য...তোমাদের জন্য।"
 
 
ভাবতে পারো মোহনবাগান মাঠের ঘাসে জীবনে প্রথম পা রাখলেন, সেই ঘাস পাগলের মতো চুমু খেলেন-একবার নয় বারবার। পৃথিবীর যে কোনো মাঠকেই মারাদোনা এমন তীব্র ভালোবাসতে পারেন। কারণ ভিলা ফিওরিতো তাঁর পিছু ছাড়ে না কখোনো। আর ছাড়বেই বা কি করে? আর্জেন্টিনার মানুষ যে তাঁর নামে একটা চার্চ বানিয়েছেন। সেই চার্চে ফুটবলের ভগবান মারাদোনার পুজো হয়। ২৫ শে ডিসেম্বর নয় পালিত হয় ৩০ শে অক্টোবর মারাদোনার জন্মদিন। সেই দিন তাঁর নামে প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হয়। কি দারুন মজার না ব্যাপারটা। মারাদোনা শিশুদের ভালোবাসেন। তাদের দুঃখে কাঁদেন গোপনে, ভেতরে ভেতরে। এক ধূসর শৈশবকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বলেই কি বারবার ফিরে যাওয়া শৈশবে? কেমন শিশুর মতো আনন্দে আটচল্লিশ বছরের মারাদোনা বলে উঠলেন," মা বলেছে আমিই সেরা...অতএব এটা নিয়ে আর কোনো প্রশ্নই হয় না...পেলে নয় আমি সেরা।" আরো কয়েকটা দৃশ্য যা আমি কোনো দিনও ভুলবো না... মারাদোনা গিয়েছেন মহেশতলায়। ইন্ডিয়ান ফুটবল স্কুলের উদ্বোধন হবে। ছোট্ট রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে চে গুয়েভারার ছবি উপহার নেওয়ার পরে তাঁর আনন্দের জোয়ার। বারবার জড়িয়ে ধরলেন রাজর্ষীকে। চুমু খেলেন।
 
মোহনবাগান মাঠের বাইরে ছমিনিট অপেক্ষা করে নির্দেশ পাঠালেন,"পুলিশ সরিয়ে নিন। আমি শিশুদের সঙ্গে, জনতার সঙ্গে যেমন খুশি খেলবো।" এরপর বাকিটা তো ইতিহাস। আসলে মারাদোনার উপমা কোনোদিন কোনো খেলায় তৈরী হয় নি, আর হবেও না। এমনই তীব্র তাঁর উপস্থিতি। যিনি নিজেকে নিংড়ে ভালোবাসতে পারেন। ভালোবাসাতে পারেন। এক বর্ণময় সাফল্যের কাহিনী মারাদোনা। সেই বস্তির ছেলেটা...সেই পিবে-ডি-অরো আজ ফুটবলের ভগবান। আমদের ভালোবাসার এক স্বপ্ন।
 
 
লেখা - উপালি
ছবি - রনি রায়
কলকাতা