খেলাঘরখেলাঘর

ঘুড়ীর গল্প
 

বাড়ির চারিদিকে কুয়াশা ঘিরে রয়েছে...আর পিপলি রোজ সকালে ক্যালেন্ডার দেখে মিলিয়ে নিচ্ছে সরস্বতী পুজো কবে। কিন্তু তোমার মনে প্রশ্ন উঁকি মারতেই পারে পিপলি রোজ কেনো ক্যালেন্ডার দেখে দিন গুনছে। সরস্বতী পুজোর আনন্দ তো আছেই...তার সাথে আছে ঘুড়ি ওড়ানোর এক দারুন মজা। পিপলি তার ছোড়দাকে ফোন করে বলেছে কাঁচের শিশি গুঁড়োতে, পিসিকে বলেছে কাঁচা বেল পাড়তে। বাবাকে বলেছে ঘুড়ি আর সুতো কিনতে আর পাড়ার সবাই যাকে দুষ্টু ছেলে বলে চেনে সেই টুপাইকে বলেছে 'টিপনি' দিতে। এমা টিপনি মানে জানো না?

আচ্ছা ঠিক আছে আগে তোমাকে মাঞ্জা সম্বন্ধে একটু জ্ঞান দিই। প্রথমে কাঁচ গুঁড়ো করতে হয় তারপর সাবু ভিজিয়ে রেখে সেই সাবু জাল দিতে হয়  একে 'মাড়' বলে। মাড় ঠান্ডা হলে এর মধ্যে কাঁচের গুঁড়ো, পছন্দ মতো রঙ আর বেলের আঠা মেশাতে হয়। যে মন্ডটি তৈরী হয় সেটা মাঞ্জার প্রধান উপাদানের একটি। এরপর যে ভালো সুতো তুমি ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য ঠিক করে রেখেছো সেই সুতো এই মন্ডের সাথে মাখাতে হয়। এটা কিন্তু একা একা করা যায় না। দুজন লাগবেই। একজন লাটাই ধরবে আর একজন মাড় মাখাবে।সব সুতোতে মাড় মাখোনো এবং লাটাই গোটানোর পর সেই মাড় মাখা লাটাই এই কনকনে শীতের রাতে খোলা আকাশের তলায় রেখে দিতে হবে। সারা রাত লাটাইয়ের গায়ে শিশির বসবে। সুতো গুলো শিশিশের স্নিগ্ধতায় চনমনে হয়ে উঠবে। তারপর দিন সকালে ঘন কুয়াশার মধ্যে সেই মাড় মাখানো সুতো লাটাই থেকে খুলে দুটো বাঁশের খুঁটির সাহায্যে এদিক-ওদিক লম্বালম্বি ভাবে লাগানো হবে।সেই লাগানোর সময় লাটাই ধরে থাকবে একজন আর আর অপর জন সেই সুতোতে টুকরো কাপড় দিয়ে ধরে টিপনি দেবে। যে যত টিপনিতে ওস্তাদ পাড়ায় তার চাহিদা অনেক। পিপলি তাই টুপাইকে বেছে নিয়েছে। টুপাই অবশ্য এসেই তার পাকাপাকা কথায় পিপলির মাথা খারাপ করে দিয়েছে..."এমা মেয়েরা আবার কেউ ঘুড়ি ওড়ায় নাকি?...এ আবার কি রে বাবা...আচ্ছা ক্যাডবেরি যখন দিবি বলেছিস তখন না হয় দিয়েই দেব...কিন্তু ভোর বেলায় উঠতে হবে...তখন দেখিস...আবার প্যানপ্যান করিস না যেন।"

পিপলি তাই এখন থেকে ভোরবেলা ওঠা প্র্যাকটিস করবে বলে বাবার মোবাইলে এ্যালার্ম দিয়ে রাখছে। কিন্তু এই কনকনে ঠান্ডায় কার আর উঠতে ভালো লাগে। এ্যালার্ম বেজে যায় আর পিপলি ঘুমের মধ্যে টুক করে বন্ধ করে দেয় মোবাইল। টুপাই এই কদিনে ঘুড়ি বিশেষজ্ঞদের মতো হাবভাব করতে শুরু করে দিয়েছে। পিপলিকে বলেছে " শুধু ঘুড়ি ওড়াবো...ঘুড়ি ওড়াবো বলে...ধেই ধেই করে নাচলেই তো আর হবে না। ঘুড়ি সম্বন্ধে একটু আধটু পড়াশুনোও করতে হবে। পিপলি ভাবে হুম টুপাই যেন কত পন্ডিত। টুপাই ঘুড়ির নাম শোনায় পিপলিকে। আর পিপলি মনে রাখার চেষ্টা করে ঘুড়ির নাম...ময়ূরপঙ্খী,চৌখুপি,মুখপোড়া,হাঁড়িকাঠ,চাঁদিয়াল আরো কত কি...। এদের মধ্যে পিপলির সবচেয়ে ভালো লাগে ময়ূরপঙ্খীকে। আর টুপাইয়ের পছন্দ চাঁদিয়াল। সেটা আবার 'একতে'না 'দুতে'। ও বুঝতে পারলে না? এগুলো ঘুড়ির আকার। দোকানীকে গিয়ে টুপাই সব বিস্তারিত বলে। তারপর দেখে শুনে যাচাই করে ঘুড়ি কেনে। পিপলিও আস্তে আস্তে একটু একটু করে শিখছে।আর মনে মনে ভাবছে বাবাকে বরং বারণ করে দেবে ঘুড়ি আর সুতো কিনতে। সে বরং নিজেই টুপাইয়ের সাথে গিয়ে কিনে নিয়ে আসবে। সেদিন বাড়ির ছাদে একটা সাদা কাগজের ঘুড়ি পড়ে ছিলো। সকালে গাছে জল দিয়ে গিয়ে পিপলি ঘুড়িটাকে দেখলো আর পাশের বাড়ির টুপাইকে তক্ষুণি হাঁক পেড়ে দেখালো। টুপাই এমন ভাব দেখালো যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়। বললো" আরে এটাতো 'চিনে'বাচ্চারা ওড়ায়। তোর কাজে লাগবে।" পিপলির রাগ হলো। পাড়ার পাঁচুর দোকানে গিয়ে আরো কয়েকটা ঘুড়ির নাম জেনে নিলো...সব চেয়ে পছন্দ হলো 'সিকিতে'।
ঘুড়ির দোকান

শীতের দুপুরে ঠাম্মার সাথে ছাদে রোদ পোহাতে বসে পিপলি কত আলোচনা করে ঘুড়ি নিয়ে। আর ঠাকুমা জানায় আরো মজার নানা খবর।
"আচ্ছা বলতো মানুষ কেনো ঘুড়ি ওড়ায়?"
"কেনো আনন্দ পাওয়ার জন্য।"
"ঠিক বলেছিস। আসলে নিজেরা তো আর উড়তে পারে না তাই ঘুড়ির সাথে মনটাকে উড়িয়ে দিয়ে মজা পায়।"
বিকেল বেলা ছোড়দা কাঁচের গুড়ো দিতে এসে আরো চারটে জ্ঞান দিয়ে গেলো। "জানলি পিপলি চীন থেকেই মনে হয় আমাদের দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর বাতিকটা আসে।শুধু আমাদের দেশে নয় অন্য দেশেও। অনেক কাল আগে ঘুড়ি উড়িয়ে সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে সাঙ্কেতিক ভাষায় কথাবার্তা বলতো...সন্ধি কিম্বা যুদ্ধ ঘোষণাও
করতো।" 
ঘুড়ি ওড়ানো
 
 
ছোড়দার কাছ থেকে দেশ বিদেশের ঘুড়ি ওড়ানোর আরো নানান মজাদার  খবর জানতে পারলো পিপলি। থাইল্যান্ডে নাকি ঘুড়ি ওড়ানোর আটাত্তর রকম নিয়ম আছে ! ১৭৬০ সালে জাপানে ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কারন লোকজন কাজ কর্ম ফেলে রেখে বড় বেশি ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল ! পৃথিবীর প্রথম ঘুড়ি তৈরি হয়েছিল প্রায় ৩০০০ বছর আগে, গাছের পাতা দিয়ে। চীনা আর জাপানিরা ড্রাগন, মাছ, প্রজাপতির মত দারুন দেখতে সব ঘূড়ি বানাতে ওস্তাদ! ঘুড়ির  থেকেই কিন্তু ধীরে ধীরে এরোপ্লেন এর ভাবনা বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে। এক-দুটি দেশ পাদে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ঘুড়ি ওড়ানো একটা জনপ্রিয় খেলা। আর সবথেকে মজার খবরটা হল- ঘুড়ি ওড়াতে হতে মোটেও খুব জোর হাওয়ার প্রয়োজন নেই।খুব ভালো হল এইসব জানতে পেরে। এইবার পিপলিও টুপাইকে বেশ খানিকটা চমকে দিতে পারবে!
 
 তেকোনা ঘুড়ি
তেকোনা ঘুড়ি
 
অক্টোপাস ঘুড়ি
অক্টোপাস ঘুড়ি
 
ড্রাগন ঘুড়ি
ড্রাগন ঘুড়ি
 
ছোড়দাকে চা করে দেয় পিপলির মা। তার সঙ্গে ঘরে বানানো কেক আর জয়নগরের মোয়া। চায়ে চুমুক আর কেকে কামড় বসিয়ে চোখ গোল গোল করে ছোড়দা আবার বকতে শুরু করে..."ঘুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ ঘটনা। ঘুড়ি উড়িয়েই আমেরিকার বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্যাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)বিদ্যুত ও বজ্রপাতের মধ্যে বিদ্যুতের অস্তিত্ত্ব প্রমান করেছিলেন। তাঁর সেই ঘুড়িটা অবশ্য তোর ময়ূরপঙ্খীর মতো কাগজের ছিলো না। সেটা ছিলো রেশমের কাপড় দিয়ে তৈরী। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের এক মেঘলা দিনে তাঁর সেই রেশমী ঘুড়ির মাথায় জুড়ে দিলেন একটা লোহার তার। আকাশের বিদ্যুত ঝলকের মধ্যে সেই ঘুড়ির তার দিয়েই তিনি প্রমান করেছিলেন আমাদের তৈরী তড়িতের সাথে আকাশের বিদ্যুতের কোনো পার্থক্য নেই। ঘুড়ির মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হলো এই শক্তি ঈশ্বরের কোনো রোষ অথবা অপদেবতার কোনো অভিসন্ধি নয়। বিদ্যু এমনই একশক্তি যাকে ছাড়া আমাদের সভ্যতা একেবারে অচল।" ছোড়দা থামলো। মোয়ার শেষ টুকরোটা মুখে পুরলো আর মা এসে ঘরের লাইট জ্বাললো। কারণ ঠাকুমা এবার সন্ধ্যে দেবে।

সকালে অনেক ঠান্ডা হওয়া সত্ত্বেও পিপলির ঘুম ভাঙলো এলার্মের আগেই। সবে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আর তো কয়েকদিন পরেই সরস্বতী পুজো।
টুপাই এর ট্রেনিং কাজে লাগলো কিনা বোঝা যাবে সেইদিন। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পিপলি মুখ ধুতে গেলো।

 
 
প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়
বালি, হাওড়া
 
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া