খেলাঘরখেলাঘর

ম্যারাথন মোকাবিলাম্যারাথন দৌড় নাকি খুব লম্বা, তাবড় তাবড় দৌড় বীরেরাই নাকি শেষ করতে পারে না-এইসব বলে বন্ধুরা আমাকে খুব ভয় দেখিয়েছিলো।

কত লম্বা?
তা সে ২৬ মাইল ২৮৫ গজ, মানে ২৬ পূর্ণ ৭/৩২ মাইল, মানে কিনা ৪২ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার হবে। বাপরে!প্রাণের মধ্যে একটা বিষম খেলাম। তবে ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে,ম্যারাথনের চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ফেলেছি। ফেদিপ্পিদেস বলে এক গ্রীক যোদ্ধা নাকি ম্যারাথনের যুদ্ধে ওই রকম দৌড়ে গতায়ু হয়েছিলেন। এরপরে কি আমার পালা? আর তাও তো উনি পুরোটা দৌড়োন নি,১৮৯৬ সালের অলিম্পিকেই যখন এই দৌড় অন্তর্ভূক্ত হলো তখন অবধি তাঁরা দৌড়োতেন মোটে ২৪ দশমিক ৮৫ মাইল।

সাতপাঁচ ভেবে দেখলাম গভীর জলে যখন পড়েইছি তখন একটু হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরানোর চেষ্টা করি। এই ভেবে ম্যারাথন নিয়ে ভারী পড়াশুনো করতে লাগলাম আর লেংটির মতো একটা হাফ প্যান্ট কিনে ফেললাম। অথচ এত কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও আমার দৌড়ের কোনো উন্নতি হলো না। ঠিক এমন একটা সন্ধ্যাবেলায় ম্যারাথনের কথা ভাবছি আর উলটো দিকের দোকান থেকে এই ভরা বৃষ্টিতে কিছু তেলেভাজা আনার উদ্যোগ করছি, এমন সময় সেই কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে আমার এক বন্ধু এসে বললো-কিরে দৌড়তে যাবি? নাকি আজকের প্র্যাকটিস অলরেডি হয়ে গেছে? তোর তো সামনে আবার ম্যারাথন। এইসব কথা শুনে বড়ই বিপদে পড়লাম। মনে মনে নিজেকে ছি ছি করে বেরোলাম জাহাজঘাটার সামনেটায় দৌড়োতে। কিন্তু দৌড়োবো কি? হাঁসফাঁস করছি, শীত লাগছে, আঙুল অবশ হয়ে গেছে, কানের লতিতে যন্ত্রণা করছে, কোমর চুলকোচ্ছে, নাকের ডগা অসাড়,মনে হচ্ছে এক্ষুণি ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলি। কিন্তু লোকজনের সামনে তো এসব চলে না, কোনোক্রমে কিছুদূর গিয়ে আর পারছি না বলে দু-ঘন্টা বাদে দাঁড়িয়ে পরে দেখি সবে কুড়ি মিনিট হয়েছে। মাথা মুছতে মুছতে ভাবলাম,এবারে কিছু একটা করতেই হচ্ছে, দৌড়ের আর মোটে আড়াই মাস বাকি।

দেখলাম রাতে একা শীতের মধ্যে দৌড়োনোর আইডিয়াটা ভালো। শুধু ঠান্ডা না লাগলেই হলো। এটা সেই ভদ্রলোকের মতন, যিনি নাকি সব সময় এক সাইজ ছোটো চটি কিনতেন যাতে বাড়ি ফিরে চটিটা ছাড়তে ভারি আরাম লাগে। আমারও তেমনি, কষ্টের মধ্যে দৌড়লে আসল দিনে হেসে খেলে বেরিয়ে যাবো। শুরু হল দৌড়। কুড়ি মিনিট থেকে পঁচিশ মিনিট,তারপরে আধ ঘন্টা, একঘন্টা-আস্তে আস্তে সময় বাড়াচ্ছি-রোজই একটা জায়গায় এসে মনে হয়, আর না, এইবারে ঠিকরে পড়বো, সেইখানে চোখের জলে নাকের জলে এক হয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে তবে শেষ করি। ইতিপূর্বে একবার দুম করে প্রচুর দৌড়োতে গিয়ে হাঁটুতে টান লেগে দেড় মাস কিছু করতে পারিনি। আর আরেকবার জিমে দৌড়োতে গিয়ে পায়ের বারোটা বাজাতে বাকি রেখেছিলাম। জিমে দৌড়ানোর মেশিন যে পায়ের পক্ষে কি খারাপ সে আর কি বলবো। পয়সা দিয়ে পায়ের লোকসান। তার চেয়ে রাস্তায় গাড়ি চাপা না পড়ে দৌড়ানো ভালো। সবচেয়ে ভালো নাকি ঘাসে দৌড়ানো। কিন্তু আমি ঘাস পাচ্ছি কোথায়? জ্ঞানের কথা থাক, একদিন শনিবার ভোরে ভাবলাম একটা লম্বা দৌড় দেয়া যাক। দৌড়োতে দৌড়োতে কখন যে ফিরেছি তার তার খেয়াল নেই, দম প্রায় শেষ, মাথা কাজ করছে না, রাস্তার ধুলো ধোঁয়ায় মুখে এক পরতা কালি পড়ে গেছে, চোখে ঘাম ঢুকে জ্বালা করছে। পা গুলো মনে হচ্ছে আর পায়ের জায়গায় নেই। ঘড়িতে দেখলাম তিন ঘন্টা দশ মিনিট। নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ালাম শাবাশ! শাবাশ!

ভরসা হলো। আমিও হয়তো শেষ করবো। ঘন্টার পর ঘন্টা হা হাঁ করে দৌড়োলেই কিন্তু চলে না। ওটা করতে গিয়েই প্রতি একশোটার মধ্যে অন্তত পঁচিশটা লোক শেষ করতে পারে না। প্রায় স্লো মোশানে শুরু করে বডি ধীরে ধীরে গরম করে এমন স্পীড নিয়ে যেতে হবে যে তখন আর নতুন করে কোন কষ্ট হবে না। রাস্তা যত ঢালে যাবে গতি তত বাড়বে আর চড়াই যত হবে গতি তত কমবে। হাঁফ ধরলেই দৌড়োতে দৌড়েতেই রেস্ট। আর ক্ষিদে তেষ্টা তো একটু একটু আছেই। বেশি খাবার বা জল খেয়ে কত লোক যে বমি করে ভাসিয়ে দেয় তার ইয়ত্তা নেই। আবার কিছু লোক ঠিক তার উলটো, জল-খাবার কিছুই খায় না ফলে কিছুক্ষণ পরে মাথা ঘুরে মাটিতে ঠিকরে পড়ে। ওই সময় চিনি জাতীয় জিনিসে খুব চট করে এনার্জি পাওয়া যায়। তাই হাঁটতে হাঁটতে এক মিনিটে অল্প জল আর কিশমিশ, বা ছোট চকোলেট খেলে মনে হয় যেন ভেতর থেকে কেউ একটা ব্যাটারি চালু করে দিলো। ওই এক মিনিটে কিচ্ছু সময় নষ্ট হয় না। বরং মনে হয়, এই তো, এইবারে অনায়াসে আরও আধ ঘন্টা দৌড়ে নেবো। কিন্তু সাবধান, বেশি দৌড়োলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হুহু করে কমে যায়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই এই সময়ে জ্বর, সর্দি কাশি, পায়ে চোট। তাই পা যদি বলে, শোনো, আর পারছি না, তাহলে তার কথা শুনে হাল্কা দেওয়াই ভালো। কুড়ি মাইলের পর পায়ের কথা শুনে লোকজন খামোখা স্পিড বাড়াতে গিয়ে মাটিতে পড়ে থেকে হাহুতাশ করে। আর একবার থেমে গিয়ে পা যদি জমে যায়, তবে সব পন্ড।

আমি দেখে চেনার চেয়ে ঠেকে শিখি বেশি।তাই একগাদা ভুলচুক করে আর তার খেসারত দিয়ে শেষমেষ দৌড়টাকে একটা পর্যায়ে এনে ফেললাম। এমনকি দৌড়ের আগের রবিবার  কুড়ি মাইল দৌড়ে দেখলাম, হ্যাঁ, কষ্ট হচ্ছে বটে কিন্তু পারছি। তারপরে এক সপ্তাহ টুকটাক সাঁতার এইসব-ওতে চোট লাগে কম। ম্যারাথনের আগের রাতে তেড়ে ভাত খেলাম। ওটাই আমাকে পরের দিন গ্লাইকোজেন হয়ে পেশীতে চটজলদি এনার্জি দেবে। খুব মন দিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম যে আমি হাসতে হাসতে দু আঙুলে ভিকট্রি সাইন দেখিয়ে লাইন পেরোচ্ছি। তখনো বুঝিনি কপালে কি আছে।