খেলাঘরখেলাঘর

অনেক দিন আগের কথা – বেয়াল্লিশ / তেতাল্লিশ বছর তো হবেই। ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়ে এদিক ওদিক চাকরির এ্যাপ্লিকেশন পাঠাচ্ছি তবে সবই কোলকাতার আশে পাশে – মার হাতের রান্না আর সকাল বিকেলের পাড়ার রোয়াকের আড্ডা ছেড়ে খুব একটা দূরে যাবার একেবারেই ইচ্ছে নেই। সেই সময় এমনিতেই ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির বাজার খুব একটা সুবিধের ছিলো না তার উপর ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিরাং-এর অবস্থা ছিলো আরো খারাপ। যাও বা দু একটা ডাক পেলাম প্রথম রাউন্ডেই আউট তবে আমার মাথা ব্যথা খুব একটা ছিলো না – বাড়িতে মার হাতের ভালো মন্দ রান্না খেয়ে আর আড্ডা মেরে দিন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো।

বাবা বোধহয় আমার মতি গতি বুঝতে পেরেছিলেন – একদিন সন্ধ্যেবেলা আড্ডা মারতে বেরুচ্ছি বাবার গম্ভীর গলার ডাক এলো, ‘খোকা শুনে যা।’

গলা শুনে মনে হলো গতিক ঠিক সুবিধের নয় – ভালো ছেলের মত গুটি গুটি পায়ে হাজির হতে বাবা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে আমাকে একটু ভালো করে দেখে নিয়ে গম্ভীর গলাতেই বললেন,
‘তোর ব্যাপারটা কি বল তো? ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কি স্রেফ বাড়িতে বসে থাকবি?’
‘না, মানে, চাকরির এ্যাপ্লাই তো করছি – লাগছে আর কোথায়।’
‘দ্যাখ্‌ খোকা, সবাই জানে তোদের লাইনে পশ্চিমবঙ্গ কেন পূর্ব ভারতেই ভালো চাকরি নেই। আমাদের দেশের যে কোন জায়গায় চাকরি করার জন্য তৈরি হ। মায়ের আঁচলের তলায় আর কত দিন এ ভাবে থাকবি? কাল থেকে রোজ স্ট্যাটসম্যান কাগজটা ভালো করে দেখবি চাকরির জন্য – মনে থাকবে তো?’

আমি তো বাধ্য ছেলের মত মাথা কাত করে হ্যাঁ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম তবে বাবা আর ছেলের ভরসায় না থেকে নিজেই নেমে পড়লেন ছেলের চাকরির খোঁজে ফলে বাধ্য হয়েই বোম্বে, ত্রিভান্দ্রম, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী, ইত্যাদি নানা জায়গাতে এ্যাপ্লিকেসন পাঠানো শুরু করতে হলো। কিছু দিন পর আমার এ্যাপ্লিকেসন পেয়ে এক কেন্দ্রীয় সরকারের সংগঠন জানালো ওরা ভারতবর্ষের নানা জায়গাতে ইন্টারভিউ নিয়ে কোলকাতাতেও আসছে - তখন আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। যথা সময়ে ইন্টারভিউ হয়ে গেলো – খুব একটা খারাপ হয় নি তবে ওরা ফিরে গিয়ে খবর জানাবে। এর মধ্যে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার রিসাল্টও বেরিয়ে গিয়েছে – ভালো নম্বর পেয়েই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। প্রায় মাস দেড়েক পর হঠাৎ ওই কেন্দ্রীয় সংগঠনের চিঠি এসে হাজির – আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে – পনের দিনের মধ্যে হায়দ্রাবাদে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হবে। চিঠি দেখেই তো মাথায় বাজ পড়েছে – পাকিস্থানের বাইরে আমাদের দেশে মানে দক্ষিণ ভারতে যে একটা হায়দ্রাবাদ শহর আছে সেটা প্রথম জানলাম – সে তো বিদেশ বিভুঁই। শেষ সম্বল হিসাবে মার দিকে করুণ চোখে তাকালাম – মা তো রীতিমত কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে ছেলে ওই মাদ্রাজীদের মধ্যে কোথায় থাকবে, কী খাবে সেই চিন্তাতে। তবে বাবার কথা খুব পরিষ্কার – কেন্দ্রীয় সরকারের এত ভালো চাকরি যখন পেয়েছে ওখানেই যেতে হবে – বলেই ট্রেনের রিজার্ভেসনের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। বাধ্য হয়ে দিন দশেকের মধ্যে মা, বাবা, বন্ধু বান্ধব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চড়ে বসলাম হায়দ্রাবাদের ট্রেনে। স্টিম ইঞ্জিন – প্রায় চল্লিশ ঘন্টা লাগবে পৌছাতে – মনে হলো কালাপানি বোধ হয় এর থেকে ভালো ছিলো – এ তো নির্বাসন।

ট্রেন চলেছে দুলকি চালে – নামে এক্সপ্রেস হলেও প্রচুর স্টেশনে থামছে - খড়্গপুর পৌছাতেই চার ঘন্টার উপর নিয়ে নিলো। কামরার বেশির ভাগ যাত্রীই দক্ষিণ ভারতীয় এবং এদের ভাষা বোঝা অসম্ভব। এবার বুঝতে পারলাম কোলকাতাতেও এত মাদ্রাজী থাকে – আসলে কোলকাতার অনেকের মতই আমারও ধারণা ছিলো যে বিন্ধ্য পর্বতের ওধারের সমস্ত অধিবাসীই মাদ্রাজী। অল্প সময়ের মধ্যেই সহযাত্রীরা সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলেন এবং ওদের কয়েক জনের মতে মাদ্রাজী কথাটা বলা উচিত নয় – ওটা একটু অপমানকর - অন্ধ্রের অধিবাসীরা তেলেগু, কর্ণাটকের অধিবাসীরা কন্নড়, তামিলনাডুর অধিবাসীরা তামিল, কেরালার অধিবাসীরা মালয়ালী এবং এই নামেই ওদের পরিচয়। বুঝতে পারলাম নিজেদের দেশ সম্বন্ধে আমরা কত কম জানি। কথা বলার মাধ্যম ইংরেজী অথবা হিন্দী যার কোনটাতেই এই কোলকাতা সন্তানের বিশেষ দখল নেই অতএব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীর সাথে অল্প স্বল্প হিন্দী ও প্রচুর বাংলা মিশিয়ে চালিয়ে যেতে হলো ফলে মাঝে মাঝেই অনেক সহযাত্রীর মুখে হাল্কা মুচকি হাসি দেখা দিয়েই সরে গেলো। দেখলাম যারা অনেক দিনের কোলকাতার অধিবাসী তারা বেশ ভালো বাংলা বলেন এবং ওরাই আমার সাথে বেশির ভাগ সময় গল্প করছিলেন এবং এই কোলকাতাবাসীকে নিজেরই দেশের দক্ষিণ ভারত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করছিলেন। হায়দ্রাবাদে হিন্দী খুব বেশি চলে শুনে তো আমার অবস্থা খারাপ – ওই ভাষা কোলকাতাতে শুধু মাত্র রেল স্টেশনের কুলিদের সাথেই ব্যবহার করেছি আর সেটাও প্রায় নব্বই ভাগ বাংলা মিশিয়ে। পরের দিন সকালে ট্রেন ভাইজাগ বা ভিসাকাপত্তনম স্টেশনে আসতেই দেখি খাবার পাল্টে গিয়েছে – ইডলি, বড়া আর কিসের একটা চাটনি – ম্যাগোঃ। দুপুরে ভাতের সাথে কি সব তরকারি যার বেশির ভাগই মুখে দেওয়া যায় না আর টক দৈ – পুরো কামরা টক দৈএর গন্ধে ভরে গিয়েছে – মনে হলো অন্নপ্রাসনের ভাতও উঠে আসবে। বাধ্য হয়ে স্টেশন থেকে কলা আর পাওরুটি দিয়ে সকাল, দুপুর আর রাত্রি চালাতে হলো। তারপর দিন ভোরে সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশন – জানলাম হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ জোড়া শহর। স্টেশনের পাশে একটা ছোট খাটো হোটেলে আপাততঃ থাকার ব্যবস্থা করে দৌড়ালাম নতুন চাকরিতে যোগ দিতে।

এই অফিসটা শহর থেকে অনেকটা বাইরে যাকে বলে লোক চক্ষুর অন্তরালে এবং শহর থেকে শুধু মাত্র সকালে ও বিকেলে বাস যায় তার মানে অফিস কাটতে হলে মাইল তিনেক হাঁটতে হবে। যাই হোক প্রথম দিকে একেবারে নতুন বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা আর কাজের ট্রেনিং – নতুন ধরনের কাজ করতে খুবই ভালো লাগছে। ভারতের নানা প্রদেশের অনেক ছেলেও আমারই মত কাজে যোগ দিয়েছে – অতএব ইংরেজী ও হিন্দীই হলো একমাত্র যোগযোগের মাধ্যম। আমার বাংলা মেশানো ইংরেজী এবং একেবারে বাংলা উচ্চারনে হিন্দী শুনে অনেকেই হাসছে আবার কয়েক জন ভুল ঠিক করে দিলো – ধীরে ধীরে জমে উঠলো বন্ধুত্ব। হিসেব করে দেখলাম চাকরির দিক থেকে এর চেয়ে ভালো কাজ ও মাইনে পাওয়া আমার কল্পনার বাইরে। সব থেকে বড় কষ্ট খাওয়া দাওয়া – সকালে হোটেলে পাওরুটি জ্যাম খেয়ে এলেও দুপুরে ক্যান্টিনে ভাতের সাথে লাল লঙ্কার প্রচণ্ড ঝাল সম্বর আর টক দৈ দেখলেই চোখ ফেটে জল আসতো আর রাত্রে আবার পাওরুটি, জ্যাম আর কলা তাই বাঙ্গালীর ছেলে মাছের ঝোল ভাতের জন্য মুখিয়ে থাকতাম – পকেটে এত পয়সা নেই যে রোজ মোগলাই না হলে চাইনিজ খাবো। ফলে এই খাওয়া আমাকে প্রায় পাগল করে তুললো – খাবার দেখলেই বাবার উপর প্রচণ্ড অভিমান হতো জোর করে বাড়ি ও কোলকাতা ছাড়া করার জন্য। হাতে কয়েক দিনের ছুটি জমলেই এদিক ওদিক ম্যানেজ করে সপ্তাহ খানেকের জন্য পালাতাম কোলকাতাতে – ট্রেনে রিজার্ভেসন থাক বা না থাক। তাও যাতায়াতেই চার দিন কেটে যেতো তবুও দু দিন তো মার হাতের রান্না খেতে পারতাম। আমার খাওয়ার কষ্ট শুনে মা প্রত্যেকবারই কেঁদে ভাসাতো তবে বাবার এক কথা – এত ভালো চাকরি এদিকে কোন দিনও পাবে না অতএব কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না।

এই রকমই একবার মহালয়ার আগের দিন রওয়ানা দিয়েছি কোলকাতার দিকে – পুজোর আগের ভিড়ের জন্য কোলকাতার সোজা ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায় নি তাই হায়দ্রাবাদ থেকে অন্য ট্রেনে ভোর বেলা বিজোওয়াড়া এসে ট্রেন পাল্টেছি – কোন রকমে বসার রিজার্ভেসন জোগাড় হয়েছে – তাই সই। রাত্রে কলা পাওরুটি খেয়ে বসে বসেই ঝিমুচ্ছি – টিকেট চেকার বড় আলোগুলো নিবিয়ে দিয়েছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার – আজ তো মহালয়া অমাবস্যা – অন্ধকার তো হবেই। রাত প্রায় দশটা নাগাদ একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতে সেই ঝাঁকুনি ও লোকের চেঁচামেচিতে চোখ খুলে দেখি আমার সামনের সিটে এক ভদ্রলোক আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কোন স্টেশনে উঠেছেন বুঝতে পারলাম না – আমাকে চোখ খুলতে দেখে মুচকি হাসলেন। ভদ্রলোককে কোন দিনও দেখেছি বলে মনে পড়লো না – খুবই সাধারণ চেহারা – গালে তিন চার দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি – পরনে এদিককার লোকের মত ভাঁজ করা সাদা ধুতি আর সাদা হাফ সার্ট – কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। তবে ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে – কামরার অল্প আলোতে মনে হলো চোখ দুটো খুবই উজ্জ্বল – সাধারণের থেকে হয়তো একটু বেশি। ওর মুচকি হাসির উত্তরে আমাকেও একটু হাসতে হলো ব্যাস ভদ্রলোক নিজে থেকে হিন্দী ও ইংরেজী মিশিয়ে আলাপ শুরু করে দিলেন – নাম বললেন সূর্যনারায়ণ রাও – গুন্টুরের ওধারে একটা ছোট শহরের বাসিন্দা, ইত্যাদি ইত্যাদি – মনে হলো কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। জানালেন সামনেই গোদাবরী নদী – বলতে বলতে একটা ছোট স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালো – হকারের আওয়াজ – এত রাত্রেও কফি আর পকৌড়া বিক্রি হচ্ছে – লোক জনের ওঠা নামার চেঁচামেচি – এর পরই শুরু হবে গোদাবরী নদীর বিরাট ব্রিজ। অনেকবার এই রাস্তায় যাতায়াত করে মোটামুটি বেশির ভাগ স্টেশনের নাম জানা হয়ে গিয়েছে সেই সাথে কোন নদী বা বড় স্টেশন কখন আসবে ইত্যাদি।

এর মধ্যেই সূর্যনারায়ণ রাও বলে চলেছেন গোদাবরীর বর্ণনা – এখানকার লোকের কাছে দেবী – এর জলেই অন্ধ্র প্রদেশের এই এলাকায় এত বেশি ধান হয় তাছাড়াও অন্যান্য ফসলও প্রচুর হয়। এখন তো চার দিকে বালির চড়া আর তার মাঝ দিয়ে সরু করে নদীর তিন চারটে ধারা – লোকে হেঁটেই পারাপার করে এমন কি গরুর গাড়িও নদী পেরিয়ে ওপাড়ে যায়। বর্ষাকালে আবার এই নদী ভয়াবহ রূপ নেয় – এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না – দু কূল ভাসিয়ে নিয়ে যায় – সেটা অবশ্য আমিও দেখেছি আর তখন ট্রেন খুব ধীরে ধীরে নদীর ব্রিজ ক্রস করে। সূর্যনারায়ণ রাও এত কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু আমার কেমন যেন অস্বস্থি লাগছিলো – দেখছি আশে পাশের যাত্রীদের কোন ভাবান্তর নেই যেন ওরা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না অবশ্য বেশির ভাগ যাত্রীই অকাতরে ঘুমাচ্ছে – তবুও কেমন যেন ব্যাপারটা। ট্রেন ছাড়ার পর টিকেট চেকার ঘুরে গেলেন নতুন কোন যাত্রী উঠেছে কিনা দেখতে – সূর্যনারায়ণ রাওকে কেমন একটা অদ্ভুত চোখে একটু সময় দেখে কামরার অন্য দিকে নিজের সিটে বসলেন তবে মনে হলো ওর নজর আমাদের দিকে স্থির হয়ে আছে। ট্রেন ছাড়ার পরই দেখি সূর্যনারায়ণ রাও কেমন যেন ছটফট করতে শুরু করেছেন যেন অনেক কথা বলার বাকি রয়ে গিয়েছে কিন্তু সময় বড় অল্প।

‘এই দেবী গোদাবরীই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন তবে ওকে দেখার মত সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়েছে। একমাত্র মহালয়া অমাবস্যার ঠিক মাঝ রাতে উনি জলের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ান – অপূর্ব সেই দৃশ্য – জানো আজই সেই রাত্রি।’

বলতে বলতে গোদাবরী ব্রিজ এসে গেলো – ট্রেন ব্রিজে ওঠার ঘট্‌ ঘট্‌ ঘটাং আওয়াজ শুরু হতেই সূর্যনারায়ণ রাও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন,
‘চলে এসো, এত ভালো সুযোগ হাত ছাড়া করবে না – দেবী দর্শনের এর থেকে ভালো সময় আর নেই – তাড়াতাড়ি এসো।’

বলে নিজে এগিয়ে গেলেন কামরার অন্য দিকের দরজায় – কি যেন এক অমোঘ আকর্ষণে আমিও পেছন পেছন চলে এলাম সেই দরজাতে। ভদ্রলোক দরজা খুলে বাঁ দিকের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন – দরজার অন্য দিকের রড ধরে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম ওর পাশেই। ট্রেন ঘটাং ঘটাং করে বিরাট ব্রিজের স্প্যানগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে – কামরার আলো নদীর জলে বিচিত্র সব ছবি এঁকে চলেছে – চারদিকে নিঃছিদ্র অন্ধকার – মাঝে মাঝে কোন নৌকার আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে অনেক নিচে নদীর বুকে – যাত্রীদের ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা টুং টাং আওয়াজ তুলছে ব্রিজের স্প্যানে লেগে। হঠাৎ সূর্যনারায়ণ রাও বলে উঠলেন,
‘ওই তো, ওই তো দেবী হেঁটে বেড়াচ্ছেন জলের উপর দিয়ে – দ্যাখো, দ্যাখো ঠিক নদীর মাঝখানে। আহাঃ, কী অপূর্ব সুন্দর লাগছে দেবীকে – চলো, চলো দুজনে দেবীকে প্রণাম করি – এই সুযোগ জীবনে আর দ্বিতীয় বার পাবে না।’
বলেই বরফের মত ঠাণ্ডা হাতে আমার বাঁ হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নদীর দিকে আর সেই টানে আমার রডে ধরা ডান হাত খুলে গিয়ে শরীর ট্রেনের বাইরে বেরিয়ে গেলো – পা দুটো ট্রেনের দরজা থেকে প্রায় হাওয়াতে উঠে গিয়েছে – মনে হলো সূর্যনারায়ণ রাওএর সাথে আমিও হাওয়াতে ভেসে যাবো নদীর দিকে। হঠাৎ কে যেন আমার কোমরের বেল্ট ও জামার কলার ধরে প্রচণ্ড জোরে টেনে ছিটকে ফেললো ট্রেনের ভিতরে – দুজনে গড়িয়ে পড়লাম বাথরুমের সামনের জায়গাতে আর কোন কিছুতে গোত্তা খেয়ে আমার মাথার পেছনটা আলুর মত ফুলে উঠলো। কোন রকমে উঠে দেখি ট্রেনের টিকেট চেকার তখনও মেঝেতে পড়ে – ভদ্রলোকের মনে হলো হাতে বেশ ভালো রকম চোট লেগেছে। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে সব কিছু ভুলে ভদ্রলোক মহা আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘বাঁচিয়ে দিয়েছি, বাঁচিয়ে দিয়েছি আপনাকে ওই প্রেতাত্মার হাত থেকে। বছর পাঁচেক আগে এই মহালয়া অমাবস্যার রাতে ব্যাটা এই ট্রেনের এই কোচ থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গোদাবরী নদীতে আত্মহত্যা করেছিলো। তারপর প্রতি বছর এই মহালয়া অমাবস্যার রাতে এই ট্রেনের একই কোচ থেকে কোন এক যাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটা নদীতে ঝাঁপ দেয়। আমি অনেক বছর ধরে এই ট্রেনের টিকেট চেকার – ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিলাম – তাই আজ সবাইকে নজরে রেখেছিলাম। আপনার সাথে ওই লোকটা বা ওর প্রেতাত্মাকে কথা বলতে দেখে সন্দেহ হয় বলে আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম তাই আজ আপনাকে বাঁচাতে পারলাম। হয়তো আপনার মায়ের আশীর্বাদ তাই বেঁচে গেলেন।’