খেলাঘরখেলাঘর

“এমনি করে তো আর ঘরে বসে থাকা যায়না অনিফিশ, পাপাঙ্গুলের ধর্মই হল জীবনের স্রোতে বয়ে চলা।” সন্ধ্যেবেলা বসে ছিল পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ সেই ছোট্ট হোগলা পাতার ঘরে। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে, পূর্ণিমার আলোয় পাপাঙ্গুলের সবুজ দেশকে ভারী অদ্ভুত সুন্দর দেখাছে।

অনিফিশ প্রশ্ন করলো - “পাপাঙ্গুল ধর্ম কি?”
পাপাঙ্গুল অনিফিশের দিকে তাকিয়ে বলল – “ভাল প্রশ্ন করেছ, ধর্ম কি…? আমি সেই কবে দেশ ছেড়ে পারি দিয়েছি সমুদ্রের পথে। কত আজানা দেশ দেখলাম, কত রকমের মানুষ; তারা কেউ নিজেকে হিন্দু বলে, কেউ বলে মুসলিম, কেউবা খ্রীস্টান, তো কেউ পার্শি। তারপর তার মধ্যেও কত ভেদা-ভেদ।। কিন্তু আমি তাদের ধর্ম তো আজও বুঝে উঠতে পারলাম না অনিফিশ! আমার মতে কি জানো, জীবনের একটাই ধর্ম - ভালোবাসা। যদি তুমি সবাইকে ভালবাসে আপন করে নাও, দেখবে সব ধর্মের রঙ এক হয়ে গেছে।”

কথাটা অনিফিশের ভারি মনে ধরল। সে অনেকক্ষন চুপ করে থাকল। অনিফিশ তো এসব কিছুই জানে না। তার দুনিয়াটা শুধুই মজা, শুধুই খেলা আর সাঁতার কাটা। পাপাঙ্গুলের কাছে এসে সে অনেক কিছু নতুন জিনিস জানতে পারল। পাপাঙ্গুল তাকে বলল-“অনিফিশ, কাল থেকে আমাদের আবার যাত্রা শুরু, আবার আমরা নতুন দেশের খোঁজে, নতুন আবিষ্কারের জন্যে ভাসবো একসাথে।” এই কথাটা শুনে অনিফিশ খুব খুশি হল। সেও তো পাপাঙ্গুলের মতই জল খুব ভালোবাসে, তাই কথাটা শোনার পর তার মনে একটা ফুর্তি সুড়সুড়িয়ে উঠল। আর সেই আনন্দে সারা রাত ঠিক করে ঘুমতেই পারল না।

খুব ভোরে যখন সূর্যের আলো ফোটেনি, অনিফিশ চোখ খুলতেই দেখল পাপাঙ্গুল একেবারে তৈরি। সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল-“আমারা কি এখুনি বেরিয়ে পরব পাপাঙ্গুল?” পাপাঙ্গুল বলল-“হ্যাঁ। আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে পরব। আমার যাওয়ার আগে এই পিছুটান ভাল লাগে না। সব্বাই আসবে, কত কথা, কত প্রশ্ন, ঘরের ফেরার কথা…আমিতো জীবনের অভিযানে এই প্রশ্নগুলো চাই না অনিফিশ।” অনিফিশ কিছুই বুঝল না, শুধু ছোট্ট করে বলল “ও...”

এরপর দুজনে মিলে সেই সমুদ্রে পারে এসে চরে বসলো তাদের ছাঁকনিতে। পুব আকাশে তখনও সুয্যি মামা ওঠেনি। চারিদিকে একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আমেজ। ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় পাপাঙ্গুল তার ছাঁকনির পাল ছেড়ে দিল। সেই হাওয়ায় ফুলে উঠল তাদের সব্জেটে রুমাল। পাপাঙ্গুলের ছাঁকনি ছুটে চলল অজানার উদ্দেশ্যে।

এমনি করে পেরিয়ে গেল পুরো তিনটে দিন আর দুই রাত, অনিফিশ তো মাঝে মাঝে সমুদ্রে সাঁতার দিতে দিতে ছাঁকনির সাথে চলেছে। সমুদ্রের নিল জলে গা ভাসিয়ে অনিফিশ তো বেজায় খুশী। তোমাদের তো আগেই বলেছি সাঁতার কাটা অনিফিশের শখ। সে সাঁতার কেটে একটুও ক্লান্ত হয় না। পাপাঙ্গুলের ছাঁকনি তখন হাউয়ায় লেগে তরতড়িয়ে বয়ে চলেছে উত্তরের দিকে। হটাৎ চোখে পরল একটা ছোট লাল বিন্দু। পাপাঙ্গুলের কৌতুহলি চোখ আটকে গেল সেখানে। সে অনিফিশকে বলল “অনিফিশ তাড়াতাড়ি ছাঁকনিতে চরে বস।” অনিফিশ মনের আনন্দে সাঁতার কাটছিল। পাপাঙ্গুলের উত্তেজিত গলা পেয়ে সে চমকে উঠে এক লাফ মেরে ছাঁকনিতে চড়ে বসলো।

“পাপাঙ্গুল,পাপাঙ্গুল,কি হয়েছে?” অনিফিশ তার গোল গোল চোখগুলো করে এদিক সেদিক তাকাল, কিন্তু কিছুই তো চোখে পরল না। পাপাঙ্গুল বলল-“ওই দূরে একটা ছোট লাল বিন্দু দেখতে পাচ্ছ?” অনিফিশ তার গোল গোল চোখ দুটো আরও গোল গোল করে মাথাটা এদিক অদিক করে বলল-“কই, কই, নাতো। কোথায়?” পাপাঙ্গুল কিছু না বলে, তার ছাঁকনিটাকে সোজা সেদিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে পাল ছেড়ে দিল। তখন দুপুর হয়ে বিকেল নেমেছে।। সুয্যিমামা আর কিছুক্ষণ পরেই চলে যাবে ঘুমের দেশে। তাই পাপাঙ্গুল যত তাড়াতাড়ি পারল ছাঁকনি টা টানতে লাগলো। রাত্রি নামার আগে মনে হয়না পৌঁছতে পারবে সেই অজানা লাল দ্বীপে। তবু ভোরের আলো না ফুটতেই যদি পৌঁছান যায়, একটু শান্তভাবে আবিস্কার করা যাবে। পাপাঙ্গুল তার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে ভোরের বেলা সময়টাই সবচেয়ে ভালো। এইসময় পরিবেশটা কেমন শান্ত-স্নিগ্ধ থাকে। আর মানুষের মনও এই সময় ভালো থাকে। আর কোনওকিছু শুরু করা বা আবিস্কারের এটাই উপযুক্ত সময়। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যেন আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। অনিফিশ এদিকে একফাঁকে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল পাপাঙ্গুল খেয়াল করেনি। সেও তার নিজের খেয়ালে মগ্ন ছিল। অনেকক্ষণ অনিফিশের আওয়াজ না পেয়ে ছাঁকনির দিকে তাকিয়ে দেখে-ওমা! অনিফিশ তো ঘুমিয়ে কাদা। ছাঁকনির এক কোণে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। পাপাঙ্গুল মজা করার জন্যে একটা পালক নিয়ে অনিফিশের ঘাড়ের কাছে একটু সুরসুরি দিয়ে দিল। তাতে সে খুব চমকে উঠে লেজ ঝাপটা দিয়ে তিরিং করে লাফিয়ে উঠল। তাই না দেখে পাপাঙ্গুল হাসতে হাসতে বলে “আরে কি হল, এই ত আমি।” অনিফিশ গা ঝারা দিয়ে সোজা হয়ে বলল, “লালদ্বীপে পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে??” পাপাঙ্গুল-“আর বেশি দেরি নেই, ভোর না হতেই পৌঁছে যাব ঠিক।”

দেখতে দেখতে রাত গভীর হল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে জোরে জোরে হাওয়া দিতে শুরু করল। আর সেই হাওয়ায় পাপাঙ্গুলের ছাঁকনির সবজেটে রুমাল উঠল ফুলে ফেঁপে। হাওয়া লেগে পাপাঙ্গুলের ছাঁকনি সাই সাই করে এগিয়ে যেতে লাগলো। আর কোথা থেকে যেন একরাশ কালো মেঘ এসে ছেয়ে ফেলল গোটা আকাশ। চাঁদমামাও ঢাকা পরল মেঘের আড়ালে। চারিদিকে ঘন কাল অন্ধকার। তারই মাঝে ছুটে চলেছে পাপাঙ্গুলের ছাঁকনি। অনিফিশের বুকটা ধিব-ধিব করছে।যদিও সে জানে পাপাঙ্গুল সাথে থাকলে তার আর ভয় নেই। তবু মন কি টা বোঝে? এইটুকু জীবনে সে কতটুকুই বা দুনিয়া দেখেছে...

তখন রাত প্রায় শেষের দিকে। পাপাঙ্গুল বুঝতে পারল আর বেশি দেরি নেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে তারা। দূর থেকে একটা আবছা অন্ধকার দ্বীপ মনে হচ্ছে,খুব স্পষ্ট না। কিছু কুয়াশা কিম্বা বৃষ্টিতে ভেজা একটা জলছবির মত। আকাশে লাল রঙ ধরতে সুরু করেছে, নিরেট অন্ধকারও যেন ফিকে হয়ে আসছে। টুপ টাপ করে দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পরতে শুরু করল। পাপাঙ্গুল আরো জোরে হাল টানতে সুরু করল আর খুব কাছেই চলে এল দ্বীপ টার। একটু একটু করে বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। তারই মধ্যে হটাৎ করে কোথা থেকে একঝাঁক তীর এসে লাগতে সুরু করল ছাঁকনির গায়ে, হুঁকোর পালে আর রুমালে...আর ছোট ছোট ক’টা গোল ভেলার মত নৌকা এসে ঘিরে ধরল পাপাঙ্গুলের ছাঁকনি। বৃষ্টির আলো আধাঁরির মধ্যে বুঝে উঠতেই পারেনি তারা কখন যেন তাদের ঘিরে ফেলেছে অদ্ভুত কতগুলো জীব।


অনন্যা দত্ত
কলকাতা