খেলাঘরখেলাঘর

ভূতোর ভূত-২

শনিবার সন্ধ্যে থেকেই আমরা মনে মনে রোমাঞ্চিত হতে লাগলাম।বারবার ঘড়ির দিকে নজর রাখতে লাগলাম।কথা ছিল রাতে খেয়ে দেয়ে সোজা শোয়ার ঘরে ঢুকে যাবো।আমি আর খোকনদা রাতে এক ঘরে শুই।রাত সাড়ে দশটা হবে কি আমরা দাদা-ভাই বের হবো ভূত দেখার অভিযানে।আগে থেকে কথা ছিল যে রবি আমাদের সঙ্গে যাবে।পোড়ো বাড়িতে যাবার সময় মাঝ পথ থেকে ওকে সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হবে।ও ঠিক রাত সাড়ে দশটা থেকে নিজেদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকবে।
রাত সাড়ে দশটা বাজলো,আর দেরী করা যায় না--ধীরে ধীরে আমরা দরজা খুলে পা টিপে টিপে রাস্তায় এসে নামলাম। বাড়ির কেউ জানবার কথা নয়।আমরা জানি এসব কথা জানাজানি হলে সবাই আমাদের ভূত দর্শনে বাধার সৃষ্টি করবে।তাই আমাদের চারজন বাদে পঞ্চম ব্যক্তিকে এ কথা জানানো যাবে না।
রাস্তার লাইট পোস্টের টিমটিমে আলোগুলি জ্বলছিল।আলোগুলি অনেক চেষ্টাতেও যেন রাস্তা আলোকিত করতে পারছিল না।আকাশে চাঁদ মামার চিহ্ন নেই।আর থাকবেই বা কি করে--আজ অমাবস্যা,তার ওপর শনিবার!ভূত বিশ্বাসী লোকেরা বলে যে ভূত প্রেতদের জাগরণ নাকি এই দিনেই হয়!
নিজের ছায়া দেখেই ভয় পাচ্ছিলাম।ভয়ে খোকনদার এক হাত ধরে রাখলাম।দাদাকেও ভয়ে অনেক সংকুচিত মনে হল।রাস্তা ভালো দেখা যাচ্ছিল না।দু লাইট পোস্টের মাঝখানটায় জাগায় জাগায় অন্ধকার দানা বেঁধে রয়েছে।
--‘দাঁড়া’,খোকন দা বলে উঠলো,‘রবি আসবে’।ডাকার প্রয়োজন হল না,রবি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।আর বেশী দূর না--তবে ভূতুড়ে বাড়ির সামনের লাইট পোস্টের বাল্ব জ্বলছিল না।এত অন্ধকার যে রাস্তা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না।তিন জনে ভূতুড়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সবার হাত সবাই ধরে আছি।সবার গায়ে সবার গা ঘেঁষে আছে।সামনে অন্ধকার,বাড়ি ঘর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।কেবল ভূত বাড়ির সীমারেখায় এক অনুজ্জ্বল আলো ছায়ার সরল রেখার মত ঘিরে ছিল।চিহ্নিত বাড়ির সীমানা যেন মানচিত্রের মত আমাদের চোখের সামনে ভেসে আছে!
রবি ফিস ফিস,চাপা স্বরে বলে উঠলো,‘লাঠি,টর্চ সঙ্গে আনতে হতো না?’
--‘না,ভূতো মানা করেছে--ও সব হাতে থাকলে নাকি ওরা দেখা দেয় না’,খোকনদার গলার স্বর মনে হল হাওয়ায় ভেসে আসছিল।
কয়েক মিনিট পরের কথা—হঠাৎ দেখি সাদা সাদা ছবির মত কতগুলি ছায়া এসে পড়ল ভূতুড়ে বাড়ির দেওয়ালে!আর একি!বিরাট এক কঙ্কাল নেচে উঠলো!তার মধ্যেই দেওয়াল ধরে লোকেরা ছুটে কোথায় চলে গেলো!শব্দ নেই--তবু মনে হল ভূতেরা কিছু বলে চলেছে।সাদা ছায়াগুলি প্রকাণ্ড বড় বড়--পনের বিশ হাত লম্বা লম্বা—ভূতের মত দু মিনিট ঘুরে বেড়াল।
ইতিমধ্যে আমার পা কাঁপতে শুরু করেছে--চার দিকে অন্ধকার দেখছিলাম।খোকনদাকে জড়িয়ে ধরে কিছু যেন বলতে চেষ্টা করলাম।পারলাম না। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার ওপর অনেকগুলি মাথা ঝুঁকে আছে!ভূতোকে দেখে আমি,‘ভূত’,বলে চীত্কার করে উঠলাম!
--‘না,না,কিচ্ছু না,ভূত বলে কিছু আছে নাকি!ভয় পেও না তুমি’,বয়স্ক একজন আমায় কথাগুলি বলছিল।
--‘কেমন লাগছে এখন?’খোকনদা আমায় বলে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিলাম,বললাম,‘ঠিক আছি’।
এক বয়স্কা মহিলা এক গ্লাস দুধ এনে আমার সামনে ধরে বললেন,‘নাও বাবা!এটুকু খেয়ে নাও।খুব দুর্বল তুমি!’
জানতে পারলাম ভূতোদের বাড়িতে আমি।এতক্ষণ ভূতোর মা,বাবা আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন।দুধ খেয়ে অনেকটা সুস্থ হলাম।খোকনদাকে বললাম,‘চলো বাড়ি যাই।’
--‘যেতে পারবি তো?’ভূতো তির্যক হেসে বলে উঠলো,আর ‘ভূত দেখবি না?’
--‘না,না’,যেন অস্ফুট চীৎকার বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।
হাসল ভূতো,তারপর ওর পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে বলল,‘দেখ আবার আমি ভূত দেখাচ্ছি।’ও মোবাইলের প্রজেক্টর সেট করে ভিডিওর মত চালিয়ে দিল।আর আমাদের সামনে ভূতোদের ঘরের দেওয়ালে ভেসে উঠলো সেই কঙ্কাল,সেই ভূতগুলি--যেগুলি আমরা পোড়ো বাড়ির দেওয়ালে দেখে ছিলাম।এবার প্রথমটা ভয়ে থমকে গিয়েছিলাম,সঙ্গে সঙ্গে ভূতো বলে উঠলো,‘সিনেমা যেমন দেখিস আমি আমাদের ব্যালকনি থেকে তোদের এমনি করে ভূত দেখাচ্ছিলাম রে!এই মোবাইলে প্রজেক্টর সিস্টেম লাগানো আছে—প্রজেক্টর হল সিনেমা দেখানোর মেশিন।
রবি,তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,আচ্ছা--সেই জন্যে আমি ওই সময় তোদের ব্যালকনি থেকে টর্চের মত কিছু জ্বলে থাকতে দেখে ছিলাম!
ভূতোর ভূতের রহস্য উদ্ঘাটিত হল।আমরা চুপি চুপি ঘরে ফিরে ঘুমের কোলে ঢলে গেলাম।



                                      

তাপসকিরণ রায়
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ


তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।