খেলাঘরখেলাঘর

ডিটেকটিভ



আমাদের বিকেলের ফুটবল খেলা মাটি হল।
আজ দুপুরেই আমাদের সামনের বাড়িটা থেকে একটা সাইকেল চুরি গেছে। এরকম অবস্থায় আমাদের তো আর বসে থাকা চলে না। আমরা আবার রওনা দিলাম আমাদের আস্তানার দিকে। পিন্টুটা দেখি কানের কোনে একটা পেন্সিল গুঁজে রেখেছে। কেন কে জানে, হয়তো মাঝে মাঝে ওর ছোট্ট নোটবইতে কিছু লিখবে বলে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওকে ছুতোর মিস্তিরির মত দেখাচ্ছে ঠিক। আমি ওর পদ্ধতির সাথে ঠিক একমত হতে পারছি না। কিন্তু একা একাও কিছু করতে পারব না ভেবে চুপচাপ দেখে যাচ্ছি।
ও আমাদের আস্তানায় পৌঁছেও কিছু করল না। চুপচাপ একটা জানলার বক্সে সিমেন্টের স্ল্যাবটার ওপরে উঠে বসে বলল, ‘আমাকে আরকটু ভাবতে দে।’
আমি পায়চারি করতে করতে ভাবছিলাম যে চুরি করছে সে কি আর আমাদের পাড়ার কোন লোক হবে? তাহলে তো সে আগেও চুরি করত বা এতদিনে ধরা পড়ে যেত। আর যে চুরি করে তাকে চুরি করা জিনিস কোথাও তো নিশ্চয়ই লুকিয়ে রাখতে হয়। হয়তো নিজেকেও কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকতে হতে পারে। এমন সময় ধড়মড় করে একটা আওয়াজ পেলাম। চমকে ওঠার সাথে সাথে কেন জানি না খুব ভয়ও পেয়ে গেলাম। এই সব মুহুর্তে পিন্টুকে আমার খুব দরকার। ও খাতা নামিয়ে রেখে বলল, ‘টুবলু, ভয় পাসনি। নে হাত ধর।’ এইভাবে আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার পিছনের দিকে। এখানে আমরা বড় একটা আসি না। সিঁড়ির তলায় একটু অন্ধকার ঘুপচি মত, আর তার ওপাশে সেপটিক ট্যাঙ্ক। আমরা একটু করে এগিয়ে দেখলাম একটা লোক, জড়সড় হয়ে।
পিন্টুই সাহস করে বলল, ‘কে তুমি? এখানে কি করছ?’
লোকটা খনখন করে মাথা নীচু করে বলল, ‘আমি চোর বাবু। আমি একটু ঘুমিয়েছিলাম এইখেনে। তোমাদের গলার শব্দে জেগে গিয়ে পালাচ্ছিলাম-’
পিন্টুর সাথে থেকে আমারও সাহসে বুক ফুলে উঠছিল। তাছাড়া লোকটা আমাদের মত দুজন ক্ষুদে গোয়েন্দাকে দেখে ভয় পাচ্ছে দেখে আরো যেন সাহস বেড়ে উঠল। বললাম, ‘পালানো বের করছি তোমার। তোমাকে আমরা পুলিশে দেব।’
লোকটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বাবু, তোমরা কাউকে বলে দিওনি। ওরা আমাকে পুলিশে দিবেনি। পিটাইয়ে মেরে ফেলবে-’
পিন্টু বলল, ‘এত ভয় তো চুরি কর কেন?’
‘পেটের দায়ে বাবু। ফ্যাকটিরিতে কাজ করতাম আগে। সে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ছিলাম এক সেলাইয়ের দোকানে। হপ্তাখানিক আগে সেখান থেকেও তাড়ায়ে দিল-’
‘তাই বলে চুরি করবে?’
‘আর করবুনি বাবু। চুরি আমি কোনদিন করিনি। কি নিয়েচিই বল তোমরা বাবু। এর বাড়ি থেকে চাদর, ওর বাড়ি থেকে বাসন।’
‘কেন আর আজকের সাইকেলটা?’
‘ও সাইকেল নিয়ে পালাচ্ছিলাম তখন একটা কুকুর তাড়া করল বলে পুকুরের পাশে কচুবনে ফেলে এইচি। চুরির জিনিস কি করব তাই ই জানিনে বাবু। দু একটা জিনিস এই বাড়ি পড়ে রইচে। চুরি আর করবুনি। কিন্তু তুমি ধরিয়ে দিলে ওরা খুব মারবে আমায়-’




সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হল আমার। কালকে প্রথম বাড়িতে না বলে আমরা এত বড় একটা কাজ করেছি। কিন্তু কালকে চোরটার কথা শুনে খুব মায়া লাগছিল।
ওকে পুলিশে দেব কি? ওই চেহারায় কি আর মার খাওয়ার জন্য আর কিছু বাকী আছে? আমি আর পিন্টু একবার চোখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলাম। আগেও দেখেছি আমাদের যতই ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হোক না কেন, দরকারের সময় আমরা খুব সহজেই একজন আরেকজনের মনের কথা খুব বুঝে নিতে পারি। ঠিক করলাম লোকটা যখন বলছেই চুরি আর করবে না তখন মনে হল ওর পালানর ব্যবস্থা করতে হবে আর এই ঘটনাটা বড়দের কাউকে জানান হবে না।
তবে তার আগে কিছু খাবার জোগাড় করতে হবে। ও নাকি দুওদিন কিছু খায়নি। তবে বেশিক্ষন সময় আমাদের লাগল না। বাদামভাজা ছিল আমার পকেটে। পিন্টুদের বাড়িটাও কাছেই। ও নিয়ে এল খাওয়ার জল আর একটু চকলেট। সেইসঙ্গে আমাদের জমান টাকার ফান্ড থেকে লোকটাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে বলল, ‘অনেক চুরি করেছ। এইবেলা চুপি চুপি বিদেয় হও।’
আর আমি বললাম, ‘এক মিনিট। চুরির জিনিসগুলো এখানেই রেখে যাও।’
বিছানায় শুয়েই শুনতে পেলাম বেশ হইচই হচ্ছে বাড়িতে। হওয়ারই কথা। আমাদের কাজের পিসি বাড়ির পাঁচিলের পাশে খুঁজে পেয়েছে মার বেডকভার আর কাকার জুতোটাও। অন্যান্য হারান জিনিসও এক এক করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এখান ওখান থেকে। সাইকেলটা তো আমরা উদ্ধার করেছিলাম কালকেই।
ঘুম ভেঙে গেলেও আমার উঠতে ইচ্ছে করল না। পৃথিবীর সেরা ডিটেকটিভদেরও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। শুয়ে শুয়ে দেখলাম জানলার ফাঁক দিয়ে রোদের ঝিকিমিকি এসে পড়ছে জানলার কোনে। বড় সুন্দর এই সকালটা।  

 

অভ্র পাল
কারডিফ, ওয়েলস্‌, যুক্ত রাজ্য