শুধু পিকলুদার মুখে ঝামা ঘষে দেবে বলেই এবার পড়াশোনা নিয়ে খুব খেটেছিল কিকু। তার ফলও মিলেছে হাতেনাতে। অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়ে নতুন ক্লাসে উঠেছে কিকু। মা খুব খুশি। বাবা বাড়িতে এসেছেন ছুটিতে, বাবাও কিকুর পিঠে চাপড় মেরে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সেদিন বড়পিসির বাড়িতে গিয়ে রেজাল্টশিট দেখিয়ে এসেছে কিকু। বড়পিসি- পিসেমশাইও অনেক আদর করলেন, মিষ্টি খাওয়ালেন কিকুকে।
পিকলুদাকে খবরটা না শুনিয়ে শান্তি নেই কিকুর। খুঁজে খুঁজে ওদের বাড়ির পেছনদিকের এঁদো জমিটায় পাওয়া গেল তাকে। ইংরেজি ওয়াই শেপের একটা পেয়ারা গাছের ডাল আর একটা সাইকেলের টায়ারের ছেঁড়া টিউব নিয়ে গুলতি বানাচ্ছিল পিকলুদা। কিকুর রেজাল্টের খবর শুনে সে কি হাসি তার। খ্যা খ্যা করে হেসে পিকলুদা বলল, ওসব রেজাল্ট-টেজাল্ট দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। কাগজে যেদিন তো ছবি বেরোবে সেদিন এসে দেখাবি। তার আগে নয়।
ভারী মন নিয়ে বাড়ি ফিরছিল কিকু। আজ পথেঘাটে বেশ একটা উতসব উতসব পরিবেশ। আজ ভোটপর্ব চলছে এখানে। তাদের গলির মোড়ের স্কুলটায় ভোটকেন্দ্র বসেছে। এখনও প্রচুর লোকজন লাইন দিয়ে আছে ভোট দেবার জন্য। দু'জন জওয়ান বুথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক নিয়ে। দূর থেকে ভিড়টাকে দেখল কিকু। তারপর হাঁটা দিল বাড়ির দিকে।
গ্যারাজঘরে বড় একটা হোসপাইপ দিয়ে কৃষ্ণ মহম্মদকে স্নান করাচ্ছিলেন কিকুর বাবা। তার কুচকুচে কালো রঙ চকচক করছিল রোদ্দুর লেগে। উনিশশো আটষট্টি সালে এই স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড গাড়িটিকে কলকাতা থেকে কিনে এনেছিলেন কিকুর দাদান। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন। স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটির গায়ের রঙ কালো বলেই হয়ত মজা করে কিকুর দাদান তার এমন নাম দিয়েছিলেন।
কিকু তার বাবার কাছে শুনেছে যে কাজী নজরুল ইসলাম একজন হিন্দু ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের প্রথম সন্তানের নাম ছিল কৃষ্ণ মহম্মদ। জন্মের পর পরই অবশ্য সেই ছেলেটি মারা যায়। কিকুর দাদান নজরুলের খুব ভক্ত ছিলেন। সারাদিন গুন গুন করে নজরুলগীতি ভাঁজতেন, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি। কালো রং-এর গাড়িটার নাম কৃষ্ণ মহম্মদ দেবার পেছনে আসল কারণ হয়ত তাঁর নজরুল প্রীতি। তিনি চলে গিয়েছেন পৃথিবী থেকে, কিন্তু তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে আছে কৃষ্ণ মহম্মদের সঙ্গে। সে কারণে গাড়িটিকে বিক্রি করার কথা ভাবতেও পারেন না কিকুর বাবা।
কৃষ্ণ মহম্মদের অবশ্য যত্নের কোনও ত্রুটি হয় না এ বাড়িতে। এমনিতে গাড়িটিকে পথে নামানো হয়না বড় একটা। তবে কিকুর বাবা ছুটিতে এলে গাড়িটাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখেন যতটা সম্ভব। গাড়িটাকে রানিং কন্ডিশনে রাখার জন্য একটু আধটু রাস্তাতেও নিয়ে যান। কালো রঙের গর্বিত মোরগের মত যখন পথ চলে কৃষ্ণ মহম্মদ, তখন সবাই ফিরে ফিরে দেখে তাকে।
কিকু গ্যারাজঘরের সামনেটায় এসে দাঁড়াল। তার মনটা একটু ভার ভার, মুখে মেঘের ছায়া। কিকুর দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবা বললেন, যাও, তাড়াতাড়ি স্নান সেরে তৈরি হয়ে নাও। একসঙ্গে খাব। বিকেলে সবাই মিলে বেরোব আমরা, কৃষ্ণ মহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে। রাতে বাইরে কোথাও খেয়ে আমরা বাড়ি ফিরব। এবার পরীক্ষায় ভাল করেছ, এটা তাই তোমাকে স্পেশ্যাল ট্রিট!
বাবা অনেকদিন মা-কে বলেছেন গাড়ি চালান শিখে নিতে। কিন্তু মায়ের ড্রাইভিং নিয়ে কোন উতসাহ নেই। কিকু মনে মনে ঠিক করে রেখেছে যে আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলেই সে বাবার কাছ থেকে গাড়ি চালান শিখে নেবে।
বিকেলে কৃষ্ণ মহম্মদের সওয়ারি হয়ে চলেছে তিনজন। বাবা ড্রাইভ করছেন। পাশে মা। পেছনে কিকু। বাবা কিকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা গাড়ি একজন প্রাণবান মানুষের মতই রহস্যময়। একটা গাড়ির কলকব্জা, ইঞ্জিনের মধ্যে সিলিন্ডারগুলির পরপর ফায়ারিং, তার টাইমিং কম্প্রেশন - এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে যে শক্তিটা তৈরি হচ্ছে, সেই জোরটা ট্রান্সমিশনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে গাড়ির অ্যাক্সেলে, গাড়ির চাকায়। একজন স্প্রিন্টারের মতই এই গাড়িও সেভাবেই দৌড় শুরু করে। বুঝলে, সামনে দাঁড়িয়ে এ জিনিষ দেখাটাও একটা শিক্ষা। আ লেসন্ অফ লাইফ।