তিস্তা নদীর ধারে একটা সুন্দর জায়গায় গিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে। নদীর জলে অস্তগামী সূর্যের গোলাপি ছায়া পড়েছে, মিষ্টি একটা হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে। কিকু গাড়ির বনেটে ঠেস দিয়ে মনোরম দৃশ্যটা দেখছিল। দু'জন ভদ্রলোক কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছিলেন। এদিকে এগিয়ে আসছেন গুটিগুটি। সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোকের হাতে একটা ক্যামেরা। বাদামি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকের কাঁধে চামড়ার একটা ব্যাগ। বোধ হয় ল্যাপটপ রয়েছে সেই কালো রঙের ব্যাগটিতে।
বাদামি পাঞ্জাবি এগিয়ে এসে কৃষ্ণ মহম্মদের গায়ে আলতো করে হাত রেখে বললেন, এই গাড়িটা কি আপনার?
কিকুর বাবা জবাব দিলেন, হুঁ, কেন বলুন তো?
এত পুরোনো মডেলের এই স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড এমন চকচকে কন্ডিশনে আছে, এ তো জাস্ট ভাবা যায় না মশাই! একসময় রাজা মহারাজা শ্রেনীর মানুষেরাই এই গাড়িতে চাপতেন। ভদ্রলোক হেসে বললেন, কে কিনেছিলেন এটি?
কিকুর বাবা বললেন, নাইনটিন সিক্সটি এইটে আমার বাবা কলকাতা থেকে কিনে এনেছিলেন গাড়িটা। উনি আর নেই। এখন এর দেখভাল আমিই করি।
ভিন্টেজ কার র্যালিতে কখনও নিয়ে গিয়েছেন একে? বড় বড় সিটিগুলোতে তো আকছার এই র্যালি হয়। এমন টিপটপ কন্ডিশনের গাড়ি সেখানে গেলে তো প্রাইজ জিতে নেবেই!
নাহ্ নিয়ে যাওয়া হয়নি কখনও, কিকুর বাবা বললেন।
উতসুক ভদ্রলোক ভেতরে উঁকি দিয়েছেন একবার। উত্তেজিত স্বরে বললেন, ভেতরে ওটা কী যন্ত্র?
কিকুর বাবা হেসে ফেললেন, ওটা গ্রুন্ডিগ- এর ছোট একটা স্পুল রেকর্ডার। আমার বাবা খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। লং ড্রাইভে যাবার সময়ে ওই যন্ত্র দিয়ে গান শুনতেন। তবে এখন ওটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমাদের এদিকে তো ভালো মেকানিক নেই, তাই ঠিক করানো হচ্ছে না।
বাদামি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক নমস্কারের ভঙ্গী করে বললেন, আমি মর্নিং হেরান্ড কাগজে আছি, আমার নাম তথাগত রায়। ওঁর নাম শশাঙ্ক বাগচি। উনি আছেন যুগের যাত্রী কাগজে। আমরা দুজনেই কলকাতা থেকে এখানে এসেছি ইলেকশান কভার করতে। আজ সকাল থেকে বুথে বুথে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা দু'জন। আঙুল উঁচিয়ে একটা স্কুল দেখিয়ে বললেন, ওই বুথটায় এসেছিলাম আমরা।
কিকুর বাবা নিজের কব্জির দিকে তাকিয়ে বললেন, সাড়ে পাঁচটা বাজল। ভোটের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে, আপনাদের কাজও তো তবে শেষ।
ভোট শেষ হলেই কি আর নিষ্কৃতি আছে আমাদের? শশাঙ্ক মজা করে বললেন, খবরের কাগজের লোকের কি আর কাজ শেষ হয় কখনও !
তথাগত হো হো করে হাসলেন, স্নিফার ডগের সঙ্গে আমাদের কোনও ফারাক নেই, ভোটের খবরের পাশাপাশি ক্রিস্পি এক্সক্লুসিভ খবরও খুঁজি আমরা।
শশাঙ্ক বলেন, নিন মশাই, আপনারা হাজব্যান্ড ওয়াইফ দুজন গাড়ির ভেতর একটু বসে পড়ুন প্লিজ। মাই ডিয়ার বয়, তুমি একটু এদিকে এসে দাঁড়াও। আমি জাস্ট একটা ফোটো তুলে নেব। হাহা, দারুণ মজাদার একটা স্টোরির গন্ধ খুঁজে পেয়েছি।
কিকুর মা অবাক হয়ে বললেন, স্টোরি? কীসের স্টোরি?
শশাঙ্ক হেসে বললেন, কাল সকালে মর্নিং হেরাল্ড আর যুগের যাত্রী - এই দুটো খবরের কাগজ দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। আসলে তেতাল্লিশ বছরের পুরনো একটা বনেদী গাড়িকে যদি এমন একটা মফস্বল শহরে এমন টিপটপ কন্ডিশনে দেখতে পাওয়া যায়, তবে সেটা কি মুচমুচে খবর নয়?
তথাগত তাড়া দিলেন, সূর্য ডুবে যাবে এক্ষুনি। আর দেরি করবেন না, প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন।
রাতে উত্তেজনায় ঘুম হয়নি কিকুর। বাড়ির বারান্দায় ওত পেতে ছিল ভোরবেলা থেকে। রাজুদাদা সকালের খবরের কাগজ নিয়ে আসতেই ছোঁ মেড়ে কাগজটা নিয়ে বসল কিকু। ঠিকই তো, মর্নিঙ হেরাল্ড-এর ভেতরের পাতায় দিয়েছে খবরটা! কৃষ্ণ মহম্মদের ছবি সমেত। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসে জানলা দিয়ে মুখ বের করে হাসছেন বাবা। পেছনের জানলায় মায়ের মুখ। গাড়ির বাইরে দুটো জানলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিকু। তার ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে শেষ বিকেলের এক চিলতে আলো।
লাফাতে লাফাতে কাগজটা নিয়ে বাবাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে কিকু। বাবা চোখে চশমাটা সেঁটে স্মিতমুখে দেখছেন কাগজটা। এদিকে মা-ও চোখ-টোখ কচলে বিছানা থেকে উঠে পড়েছেন কিকুর হৈ চৈ শুনে। এমন সময়ে বেসফোনটা বাজল শব্দ করে। কিকুই ধরেছে ফোনটা। ওপারে পিকলুদার গলা, অ্যাই কিকু, আজকের যুগের যাত্রী দেখেছি? কৃষ্ণ মহম্মদের সঙ্গে সঙ্গে তোদের তিনজনেরও ছবি দিয়েছে!
পিকলুদার ভোম্বল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখা হল না, বড্ড আফশোস রয়ে গেল কিকুর। সে শান্ত গলায় বলল, শুধু যুগের যাত্রী নয়, মর্নিং হেরাল্ডেও রয়েছে খবরটা। আমার কাছে খবরের কাগজটা আছে। পরে একসময়ে আমি গিয়ে তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসব'খন।
কিকুর মনে যেমন খুশির একটা ঢেউ উঠেছে, পাশাপাশি একটা খচখচানিও রয়ে গিয়েছে তার ভেতর। মা-বাবার সঙ্গে তার ছবি ছাপা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার নাম তো নেই কোথাও। আসলে তারা তিনজন তো উপলক্ষ মাত্র। আসল হিরো তো কৃষ্ণ মহম্মদ। তাকে কেন্দ্র করেই তো করা হয়েছে স্টোরিটা। এই ছবিতে তার নিজের কৃতিত্ব কোথায়?
জিওগ্রাফিতে কিকু পড়েছে যে চাঁদের নিজস্ব আলো নেই। সূর্যের আলোতেই আলোকিত হয় সে। কৃষ্ণ মহম্মদ একটা বড় শিক্ষা দিল আজ। স্কুল লিভিং এক্সামে তাকে এমন মার্কস পেতে হবে যাতে কাগজে শুধু ছবি নয়, তার নামও যেন ছাপে। কিকু স্থির করল, না, চাঁদ নয়, তাকে এবার সূর্য হয়ে উঠতে হবে।