খেলাঘরখেলাঘর

 

মাঁসিয়ার প্যাঁরি

যাই হোক ন'মামা ফিরে এলে দেখা গেলো বাবার কথাই ঠিক – ন'মামা বেশ পালটে গিয়েছে। সুট, টাই আর জুতো ছাড়া বাড়ির বাইরে একেবারেই যায় না। অফিসের বাইরে পাজামা পাঞ্জাবী ছিলো ন'মামার প্রিয় পোষাক সেটাও আলমারিতে উঠে গেলো – বাড়িতে এখন ড্রেসিং গাউন ছাড়া নিজের ঘরের বাইরেও বেরোয় না।  আমাকে সারাক্ষণ বোঝাতে লাগলো ফরাসিদের মত লোক হয় না – ওদের ভাষাও কি মিষ্টি – একেবারে বাংলা ভাষার মত নরম – কোথায় লাগে তোদের খটমটে ইংরেজি। জীবনে উন্নতি করতে হলে ওদের মত কথা বলতে হবে, খাওয়া দাওয়া করতে হবে, ওদেশের শিক্ষিত লোকের মত থুতনিতে দাড়ি রাখতে হবে তবেই না ওদের সমান হওয়া যাবে। বাবা ন'মামার নতুন রূপ দেখে মুচকি হেসে মাকে বললেন,
‘পল্টুর মাথার গুবরে পোকাটা আবার নড়েছে মনে হচ্ছে – দেখা যাক জল কত দূর গড়ায়।’ 
ফিরে আসার তিন চারদিন পর মনে হলো ন'মামা থুতনির দাড়ি কামাচ্ছে না – আসলে আমার মামা বাড়ির দিকে ছেলেদের দাড়ি গোঁফ খুবই পাতলা তাই ন'মামার এই নতুন উন্নতি আমাদের বুঝতে একটু সময়ই লেগেছে। সকালে জলখাবারের সময় নমামার থুতনির দিকে বাবার নজর পড়তে হাসি চেপে বাবা বেশ গম্ভীর মুখেই বললেন,
‘পল্টু, তোমার দাড়ি কামাবার ব্লেডটা বোধহয় ভোঁতা হয়ে গিয়েছে তাই ঠিক ভাবে কামানো হচ্ছে না। থুতনিতে দেখছি গোটা দশেক লোম রয়ে গিয়েছে।’
ন'মামা বলতেও পারছে না ওটা কি – মুখ নিচু করে কোন রকমে জল খাবার খেয়ে টেবিল থেকে পালালো। পরে আমাকে বোঝালো,
‘বুঝলি, ফরাসিদের মত হবার জন্য এটা আমার প্রথম পদক্ষেপ।’

দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে ন'মামা বাংলা ও ইংরেজী বলাতে ‘ট’, ‘ঠ’, ‘ড’ এর  বদলে ‘ত’, ‘থ’, ‘দ’ ব্যবহার করতে শুরু করলো – কারণ হলো ফরাসিরা এমনি করেই নরম ভাবে উচ্চারণ করে। আমার সাথে বেশীর ভাগ সময় ওই ভাবে কথা বলা শুরু করাতে ওর বাংলা কথা বুঝতেই বেশ অসুবিধাতে পড়ে গেলাম, ইংরেজী তো দূরে থাক। বাবা পেছনে লাগেন বলে ন'মামা বড় জামাইবাবুর কাছ থেকে সব সময়ই দূরে দূরে থাকে আর মার সাথে এভাবে কথা বলতে গিয়ে ধুম বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে ফিরে এলো। দু তিন দিন পরই দেখি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মুখ কাঁদো কাঁদো করে নিজের ঘরে বসে আছে। জিজ্ঞেস করতে যা বললো তার মর্মার্থ হলো অফিসে ওর ওই ফরাসি-বাংলা আর ফরাসি-ইংরেজী বলা নিয়ে বস্‌ ভীষণ বকেছেন – বলেছেন এর পর এভাবে কথা বললে একশ টাকা করে ফাইন করবেন। বাকি সহকর্মীরাও খুব পেছনে লাগছে বিশেষ করে অনিন্দিতা বলে মেয়েটা – ওকে ভুল করে বলে ফেলেছিলো পরিমলের থেকে প্যাঁরি নামটা অনেক বেশী ফরাসি ঘেঁসা আর প্যারিসে যে কোম্পানিতে গিয়েছিলো তার রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা ওকে ওই নামেই খুব মিষ্টি করে ডাকতো। সেটা অনিন্দিতা অফিসে সবার কাছে ফাঁস করে দেওয়াতে এখন অফিসে সবাই ওকে মাঁসিয়ের প্যাঁরি বলে ডাকতে শুরু করেছে। খুব দুঃখের সাথে ন'মামা বললো,
‘বুঝলি, এদেশে কেউ অন্যকে জীবনে উন্নতি করতে দেবে না। আরেঃ, ফরাসিদের মত হওয়ার এগুলোই তো প্রথম ধাপ। দুশো বছর ধরে ব্রিটিশদের শাষণে থেকে তোরা ইংরেজী ছাড়া আর কিছুই শিখলি না। পয়সা কড়ি থাকলে ঠিক প্যারিসে চলে যেতাম – ওটাই হলো আসল শিল্পী ও জ্ঞানী গুণীর জায়গা। দেখিস নি ইতিহাসের বইতে পৃথিবীর তাবড় তাবড় শিল্পীরা প্যারিসেই ডেরা বেঁধেছিলো। আমাদের দেশেরও কত শিল্পী ওখানে আছে।’  
অফিসে জরিমানার ভয়েই হোক বা অনিন্দিতার পেছনে লাগার জন্যই হোক ন'মামা আবার ‘ট’, ‘ঠ’, ‘ড’তে ফিরে গেলো আর আমিও নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। ভাষা নিয়ে এই পাগলামিটা আমার পক্ষে হজম করা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো।