কাঁচের বোতল ভাসতে ভাসতে চলল । হিমালয়ের ঠান্ডা বরফগলা জলে, গঙ্গার ওপর দিয়ে । বড় বড় শহরের কোল ঘেঁষে, গঙ্গার ঘোলা জলের মধ্যে দিয়ে । স্রোতের আনুকুল্যে, ঝড়ে, বৃষ্টিতে ডুবে গিয়ে আবার ভেসে উঠে চলতে লাগল নদীর খুশিতে, জলের খেয়াল-ডিঙিতে করে । কুমীরের মুখের সামনে দিয়ে, শুশুকের নীচ দিয়ে, কখনো নীল দিগন্তরেখা ছুঁয়ে, কখনো পাহাড়ের বুড়ি ছুঁয়ে ।কখনো কাঁচের মত স্বচ্ছজলের ঢেউতে ওঠানামা করছে সে। কখনো ঘোলাজলে সাঁতরাতে গিয়ে ওষ্ঠাগত প্রাণ তার। কোথাও খাড়ির মুখে আটকে গেছে । কোথাও পলির বুকে আবদ্ধ হয়েছে । একটানা আটকে গেছে বহুবছর । আবার বাণের জল তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে উত্তরনদীপথ বেয়ে দক্ষিণ নদীবাড়িতে । সূদুর উত্তরাঞ্চলের গঙ্গার বুকে নাকানি চোবানি খেতে খেতে পরিশ্রান্ত কাঁচের বোতল অবশেষে অক্ষত অবস্থায় এসে ভিড়ল গঙ্গার মোহনায় দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের নোনাজলের সখ্যতায় । নিজের শরীর দিয়ে অনুভব করেছে গঙ্গার স্বচ্ছ থেকে ঘোলা জলের স্পর্শ ।
পূর্ণিমার রাতে শঙ্করপুরের নির্জন বালুকাবেলায় বিচ-কোম্বিং করতে বেরিয়েছিল ওরা তিনজন । তুলি তার মা বাবার হাত ধরে হাঁটছিল । ঢেউ এসে সজোরে আছড়ে পড়ছে । পাযের পাতার মধ্যে বালি ঢুকে একাকার । জল সরে যাচ্ছে । আবার আসছে ঢেউ । পুরীর মত বড় ঢেউ নয় তবুও সমুদ্র তুলির বড্ড প্রিয় । পাহাড়ের গতি নেই আছে একঘেয়েমি আর সমুদ্র যেন কথা বলে তার জলের উচ্ছ্বাসকে সাথে নিয়ে । খলখল করে গেয়ে যায় তার ঢেউ নিয়ে। ঢেউগুলো যেন ঘাগরার কুঁচি দুলিয়ে নেচে নেচে বয়ে যায় বালি, নুড়ি-পাথরকে চুমু দিয়ে । হঠাত তুলির পায়ে এসে ঠেকল কি একটা যেন । অন্ধকারে সে ভয় পেয়ে মায়ের আঁচল ধরে বলে উঠল " উরিবাবারে! এটা আবার কি ? " দেখে একটা বড় কাঁচের বোতল ।পিনাকী সেটি কুড়িয়ে তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। চাঁদের রূপোলী আলোয় বোতলের মধ্যে একট একটা সাদা কাগজের অস্তিত্ত্ব টের পেল পিনাকী। হোটেলে ফিরে এসে সেই বোতলটা দেখেই সুমনা আঁতকে উঠল। তুলি বলল "এমা, এটা কেন এনেছ বাবা" পিনাকী ততক্ষণে সেই বোতল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । কাঁচের বোতলে কাঁচের ছিপি আর মুখটা আষ্টেপৃষ্টে গালা দিয়ে সিল করা । খোলা গেল অনেক চেষ্টার পর সেই বোতল আর তার ভেতরে একটা কাগজের টুকরো পাওয়া গেল । " তুলি হোটেলের বিছানায় শুয়ে তখন টিভি দেখছিল মায়ের সাথে । পিনাকী বোতলের মধ্যে থেকে কাগজটা কেয়ারফুলি বের করে আনল ।
সবুজকালিতে লেখা, বড় বড় করে, মোটা অক্ষরে, যতনে লাইন টানা..
"অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর দোয়াবে আমার বাড়ি । রুদ্রেশ্বর শিবমন্দিরের পুরোহিতের মেয়ে আমি । আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে । আমার বাড়ির উঠোনে একটা রুদ্রাক্ষ গাছ পুঁতে গেলাম । গাছটা বাড়ছে । গাছের ফল আমাদের গ্রামের রুদ্রেশ্বর শিবমন্দিরে গিয়ে দিয়ে এলেই হবে । আমার সাথে দেখা হবে না কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারব । দিও কিন্তু ফলটা । ইতি তোমাদের জিনী"