পিনাকী চিরকূটটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে বারবার দেখতে লাগল । সুমনাকে দেখাল । তুলিও দেখল এক ঝলক । শঙ্করপুরের সেই হোটেলে বসেই পিনাকীর মাথায় তখন রুদ্রেশ্বর শিবমন্দিরের প্ল্যান ঘুরতে লাগল ।
পিনাকী ল্যাপটপ অন করল ।ইউএসবি ডেটাকার্ড সাথে ছিল । ইন্টারনেটের সিগন্যালও ভালো পেল । সুমনাকে বলল সত্যি ইন্ডিয়া আজ কত এগিয়েছে বলোতো! কোন প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে শঙ্করপুরে বসে আছি আমরা তবুও বিশ্ব আমাদের এই মূহুর্ত্তে হাতের মুঠোয় । এবার গুগলে গিয়ে খুঁজতে বসল |প্রথমে রুদ্রেশ্বর শিবমন্দির, তারপরে রুদ্রপ্রয়াগ .. এই তো অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদীর সঙ্গম । পিনাকী চিত্কার করে বলল "ইউরেকা" ! আমরা তো পুজোর ছুটিতে প্ল্যান করছিলাম কেদার-বদ্রীর । চলো তাহলে রুদ্রেশ্বর শিবমন্দিরও ঘুরে আসা যাবেখন । গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে বঙ্গোপসাগরের তীরে এসে ভিড়েছে জিনীর বোতলে ভরা চিরকূট । আর যেহেতু পিনাকীরা সেই চিরকূট পেয়েছে তাই সেই দায়বদ্ধতায় জিনীর শেষ কথাগুলো রাখার চেষ্টা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল । অসুস্থ জিনীর শেষ ইচ্ছে । মৃত মেয়েটার ইচ্ছেপূরণ করতেই হবে । তাদের তুলির মত ছোট্ট একরত্তি মেয়ে হয়ত জিনী । কে জানে তার বয়স কত ? কচি হাতে কাঁচ অক্ষরে লেখা । সবুজ কালিতে । স্কুল ও যেত হয়ত । ফুরিয়েওছে এতদিনে স্কুল যাওয়া জিনীর । কত রুদ্রাক্ষ হয়ত ঝরে পড়ে গেছে জিনীর বাগানে । জিনীর মা বাবা হয়ত কত দুঃখে সে বাড়ি ছেড়ে চলেই গেছে । জিনীও হয়ত আবার জন্মে গেছে এতদিনে । কিম্বা রুদ্রাক্ষ গাছটা শুকিয়ে গেছে জিনীর দুঃখে , জিনীর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কষ্টে। সেই কবে চিরকূট হাতে লিখে বোতলবন্দী করে জিনী পাঠিয়েছে । ভাসিয়েছে নদীর জলে । আর ভাসতে ভাসতে সেই বোতল এসে ভিড়েছে শঙ্করপুরের বঙ্গোপসাগরের উপকূলে । ছুঁয়েছে তুলির পা । কত শহর পেরিয়েছে সেই চিরকূট । কত জল গড়িয়ে এসেছে গঙ্গা থেকে সাগরে । জিনীর অসুস্থতা বেড়ে গিয়ে চরমে পৌঁচেছে । কিন্তু সেই চিরকূট সম্পূর্ন টাটকা ভাবে হাজির হয়েছে পিনাকী-সুমনার সংসারে । চিরকূটটি সযত্নে পার্সে ভরে রাখল পিনাকী।
ট্রেন ছেড়ে দিল দিল্লির উদ্দেশ্যে । দিল্লি থেকে গাড়িভাড়া করে কেদারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তারা । সুমনা আর তুলিও যাচ্ছে সাথে । আর সেই সাথে জিনীর চিরকূটের কথা রাখার ইচ্ছে রয়েছে । জিনী আজ হয়ত বেঁচে নেই কিন্তু জিনীর সেই চিঠি অনেক ঝড়বাদলে, বড় বড় দুর্যোগের মুখে পড়েও যখন পিনাকীর হাতে এসে পড়েছে তখন জিনীর কথা তাকেই রাখতে হবে । রুদ্রেশ্বর শিবমন্দিরে গিয়ে সেই ফলটা পিনাকী দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করবে কিন্তু যদি সত্যি মন্দির না থাকে কিম্বা গাছটা যদি খুঁজে না পায় সে ! অথবা গাছ হয়ত পাবে কিন্তু যদি ফল না থাকে সে গাছে !কিম্বা জিনীর গ্রাম যদি খুঁজে না পায় তারা ! রাজধানী এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর এইসব চিন্তা মাথায় এল পিনাকীর । বাতানুকূল কামরায় চোখ রেখেও স্বস্তি নেই তার । দিল্লি থেকে হরিদ্বারে পৌঁছল তারা । হরকি পৌরীতে গঙ্গার বরফঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে তুলি তো যারপরনাই মহা খুশি । একরাত সেখানে থেকে পরদিন হৃষিকেশ । সন্ধ্যেবেলায় গঙ্গার তীরে সূর্যপ্রণাম সেরে মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে ফুলের ভেলা ভাসিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে গঙ্গারতি দেখল ওরা । নদীর জলে ভেসে চলল সার সার আলোর খেয়া । ফুলের জলসায়, আলোর মালায় মা গঙ্গা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন ওদের চোখের সামনে । লছমনঝুলা দেখতে গেল ওরা তিনজনে । শরতের নীল আকাশ আর কুচো কুচো পেঁজা তুলোর মেঘ তখন লছমনঝুলার আকাশে ।লছমনঝোলায় চড়ে মায়ের হাত ধরে দুলতে দুলতে যেতে যেতে তুলির খুব মজা হল । বিশাল ঝুলন্ত সেতুর ওপর থেকে বিশালাকার মহসীর মাছকে গঙ্গাবক্ষে হারিয়ে যেতে দেখল। পয়সা ফেলে পুণ্যি কুড়োচ্ছে কত মানুষ মত্স্য অবতারের দর্শনে ।