খেলাঘরখেলাঘর

 

সরোজিনী


উত্তরাখন্ডের গঙ্গার ধার ঘেঁষে ঘেঁষেই চলতে হয় কেদার-বদ্রীর পথে । কখনো নদী দৃশ্যমান কখনো এঁকে বেঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার ধরা দেয় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে । অনেক পথ গাড়ি চলে ওরা পৌঁছল পাহাড়ের ছোট্ট শহর দেবপ্রয়াগে যেখানে অলকানন্দা নদী এসে গঙ্গার হাত মিলিয়েছে ।দেবপ্রয়াগে   গঙ্গার ঘোলা জল আর অলকানন্দার স্ফটিকস্বচ্ছ জলের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে । আবার পরদিন পাহাড় বেয়ে পথচলা দেবপ্রয়াগ থেকে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে । অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম স্থল তীর্থক্ষেত্র রুদ্রপ্রয়াগ । রুদ্রপ্রয়াগে এসে গাড়ির চালক তাদের গাইড করল। রুদ্রপ্রয়াগে রাস্তার  দ্বিভাজন স্পষ্ট । একটি পথ কর্ণপ্রয়াগ হয়ে অলকানন্দার ধার দিয়ে সোজা চলে  গেছে বদ্রীনাথে আর অন্য পথটি মন্দাকিনীর  কূল ঘেঁষে কেদারনাথে । ড্রাইভার বলল "সাব্, আপলোক রুদ্রপ্রয়াগ মে রুদ্রেশ্বর টেম্পল ঘুম কে আইয়ে" পিনাকী হতচকিত হ'ল । পথশ্রমের ক্লান্তি আর হিমালয়ের ছবি তুলতে তুলতে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল । হঠাত রুদ্রেশ্বর টেম্পলের নাম শুনে চমকে উঠল সে । নদীতে নেমে হাত মুখ ধুয়ে সুমনাকে বলল "চলো, এবার আমরা দেখে আসি জিনীর বাড়ি আর রুদ্রাক্ষ গাছ"
মন্দিরে গিয়ে সুমনা পুজো দিল । মন্দিরের পুরোহিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল বাঙালী এক পুরোহিত এখানে থাকতেন বটে  তবে এখন শুধু ওনার এক আত্মীয় থাকেন । 
পাহাড়ের কোলে একটুকরো সমতল মাটি । ছোটছোট কয়েকঘর গ্রাম আর লাগোয়া জমিতে ভুট্টার ক্ষেত । মোটমাট সবুজ আর নীলে মিলেমিশে একাকার । সুমনা বলল, কি সব আগবাগডুম বোতল ভেসে এল,  কাগজ পেল, আর তার উদ্দেশ্যে মরিচীকার মত দৌড়চ্ছ ! তার চেয়ে চল রুদ্রপ্রয়াগ দুচোখ ভরে দেখি আরো কিছুক্ষণ ;  ঠিক আছে বাবা একটু খুঁজতে দাও জিনীর বাড়ি আর ঐ রুদ্রাক্ষ গাছটা । আমাদের ড্রাইভারতো বলেছে এখন দুঘন্টার আগে সে স্টার্ট করবে না এখান থেকে । বলতে বলতে ভুট্টার ক্ষেত পাশে রেখে ওরা যেতে লাগল । হঠাত সুমনা একটা গাছের নীচে কি একটা শুকনো ফল দেখে সুমনা বলে উঠল " দেখোতো এটা কি ফল?" পরক্ষণেই বলল, না,না রুদ্রাক্ষ এমন তো হয়না ।  কেদারে যাবার রাস্তায় গৌরীকুন্ডে  সে রাতে তাদের থাকার ব্যাবস্থা । পেলনা খুঁজে জিনীর বাড়ি সেদিন  । মন্দিরে ফিরে এসে শুনল " গৌরীকুন্ড যাবার পথে ভীষণ ধ্বস নেমেছে আর একটি বাস উল্টেছে তাই আজ সন্ধ্যের মধ্যে আর যাত্রা করা ঠিক হবে না । গাড়ির ড্রাইভার বলল । আর যারা ঐ পথে যাচ্ছিল তারা সকলেই বাসের মধ্যে কিম্বা গাড়ির মধ্যে রাত কাটাবে । ভাগ্যিস ওরা মন্দিরে এসেছিল তবু কিছুটা বিশ্রাম আর আশ্রয়ও পাবে । মন্দিরের মধ্যে দালানের ভেতরে আজ রাত থাকা যাবে । অনুমতি দিলেন পুরোহিত ।  সাথে কিছু শুকনো ফল ছিল আর মন্দিরে ঠাকুরের প্রসাদ হিসেবে কিছু পুরী আর মোহনভোগ খেয়েই রাত কাটাতে হল । গাড়িতে কিছু গরম জামাকাপড়, চাদর ছিল  আর একটা করে কম্বল পাওয়া গেল মন্দির থেকে  ।   খেয়ে দেয়ে কম্বল পেতে আর পর্যাপ্ত গরম জামাকাপড় পরেই শুয়ে পড়ল তিনজনে । আর শোয়া মানেই ক্লান্তির ঘুম, পথশ্রমের বিরাম । চোখ ঢুলে এল তিনজনের ।  
পিনাকী তখন সেই এক কথা ভেবে চলেছে। জিনী আর তার রুদ্রাক্ষ ।শীতের রেশ নিয়ে  ছোট্ট তুলি পিনাকীর কোলের ওম নিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন ।পাশে সুমনাও গভীর ঘুমে কাতর ।    পিনাকী তুলির গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে  তুলির ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে একঝলক দেখল । আবার চাপড়ে দিল একটু । 

ঘুমের দেশে, পিনাকীর চোখে তখন হিমালয়ের নৈসর্গিক  দৃশ্য । তুষার শৃঙ্গের হাতছানি আর মধ্যে মধ্যে অন্তঃসলিলা গ্লেসিয়ারের বহমানতা । কোথাও সবুজ কোনিফেরাস গাছ কোথাও ফার্ণের সবুজ হাতছানি । পিনাকী স্বপ্নরাজ্যে তখন । সব পেয়েছির দেশে । অদ্ভূত ভালোলাগায়.. 
বাবাই, বাবাই কতদিন থাকবে এখানে ?
আমরা তো কাল সকালেই র‌ওনা দেব কেদারের পথে ।
তাই বুঝি? বাবাই জানো, আমার এখানে থাকতে মোটেই ভালো লাগছিল না ।
কেন রে? এত সুন্দর পাহাড়ি প্রকৃতি, ঠান্ডা ঠান্ডা জলবায়ু ।   
আমার পুরো নাম সরোজিনী  । বাবা আদর করে ডাকত জিনী বলে । আমি তোমাদের কত খুঁজেছি এতদিন ধরে । আমার ঐ বোতল তোমরা না পেলে কি আমার কাছে ছুটে আসতে । দেখ কেমন কায়দা করে তোমাদের এতদূরে নিয়ে এলাম । আমি তোমাদের তুলি হয়েই ফিরে এসেছি আবার । তুলিকে শিবমন্দির দেখিয়ে নিয়ে গেলে এতেই আমার শান্তি । তোমাদের আর কষ্ট করে রুদ্রাক্ষ খুঁজতে হবেনা আমার জন্যে । তুলিকে রুদ্রেশ্বর দর্শন করিয়ে নিয়ে গেলে তাতেই আমি খুশি হলাম ।   কাল সকালে রাস্তা খুলে গেলে তোমরা কেদারের পথে রওনা দিও । আমার সরোজিনী হয়ে বাঁচা হয়ে উঠল না তাই তুলি হয়ে ফিরে গেলাম তোমাদের কাছে...

পিনাকী ধড়মড়িয়ে উঠে বসল । ভোর হতে অনেক বাকী তখনো । তাহলে? এতকথা সে কার সাথে বলছিল এতক্ষণ ? না কি তার মনের ভুল ? না , ভুল তার হয়নি কিছু । সে স্বপ্ন দেখছিল মন দিয়ে ।  রুদ্রপ্রয়াগের প্রবল  ঠান্ডাতেও ঘামে ভিজে একসার পিনাকী । 
পিনাকী উঠে মন্দিরের চাতালে একটা চক্কর কেটে এল । চোখে মুখে জল দিয়ে আবার ঘুমোতে হবে । এখনো রাতের অনেকটাই বাকী । মনে একটা খটকা, একটু বিস্ময় আর একটু প্রাগ্‌জন্ম-পরজন্ম টানাপোড়েন । আর রুদ্রাক্ষ? সেটার কি হবে ? পিনাকী একটুও এসব পাথর,শেকড়-বাকড় ধারণে বিশ্বাসী নয় । কিন্তু জিনীকেও যে অবিশ্বাস করতে মন চায়না তার ।   এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এল । মন চাইল সুমনাকে তক্ষুণি সব বলে ফেলে ...মানে তার স্বপ্নের কথা । পরক্ষণেই মনে হল না, কাল আবার ভোরে বেরুনো আছে । তার স্বপ্নের গল্প না হয় গাড়িতে যেতে যেতেই বলবে । তুলির গায়ের চাদর যথারীতি সরে গেছে  । পায়ে মোজা পরিয়ে শোয়ানো হয়েছিল । একটা পায়ের মোজা তার হাতের মুঠোয় । টুপির উলের ফিতেটা হিসেবমত মুখের মধ্যে । ছোট্টবেলার অভ্যেস তো । কোনো ছাড়ান ছেড়েন নেই ।  মেয়েটার কচি, নরম সরম মুখের দিকে চেয়ে পিনাকীর আরো মায়া হল ।
সকাল হতেই তাদের তৈরী হবার তাড়া ।
...
ওরা  রওনা দিল গৌরীকুন্ডের পথে, কেদারনাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে । পিনাকীর চোখে তখন পাহাড়ের ঝর্ণার দুধসাদা ফেনিল জলরাশি আর হিমালয়ের সৌন্দর্য আর আগের রাতের স্বপ্নের   গ্লেসিয়ার বেয়ে একটাই মুখ তুলি, তুলি আর তুলি । 




ইন্দিরা মুখার্জি
কলকাতা

 

 

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।