খেলাঘরখেলাঘর

FacebookMySpaceTwitterDiggDeliciousStumbleuponGoogle BookmarksRedditNewsvineTechnoratiLinkedin

এক্সট্রা

স্কুলের সামনের মাঠে জোর ফুটবল খেলা চলছে দু’দলের – তুবড়ি ভার্সেস রকেট। সাইড লাইনের পাশে গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে আছে রাজু। খুব মন খারাপ তার। তাকে কেউ খেলতে নেয় না। একমাত্র যদি কেউ চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বেরিয়ে আসে তখন ওর ডাক পড়তে পারে। কিম্বা হঠাৎ যদি বল মাঠের বাইরে অনেক দূরে চলে যায় তো বড় দাদারা বলতে পারে – ‘যা এক্সট্রা, বলটা কুড়িয়ে নিয়ে আয়।’ তখন একটু বলটা ছোঁয়ার সুযোগ পাবে। এছাড়া আজকের মত রোজ রোজ সারা টিফিন টাইম বলের দিকে তাকিয়ে চাতক পাখির মত বসে থাকা। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে যায় এক একদিন।

হঠাৎ একটা বল জোরে শট মারল ক্লাস এইটের মানস। লাফাতে লাফাতে বলটা ঢুকে গেল পশ্চিমের বাগানে। আর সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল – ‘এক্সট্রা, বলটা নিয়ে আয়।’
‘সমীর কে বলো।’
‘তুই যাবি কি যাবি না। না গেলে কিন্তু আর খেলতে পাবি না।’
ইচ্ছে ছিল না একটুও। কিন্তু খেলতে পাওয়ার লোভে হাঁটা দিল রাজু। মাঠের পশ্চিম দিকের এই বাগানটা রায়দের। বেশ বড়সড় একটা জঙ্গল যেন। সেই বাগানের মাঝখানে রায়দের একটা অনেক পুরনো পোড়ো বাড়ি আছে। কেউ কত কাল সেখানে বাস করেনা কে জানে। বাড়িটার দিকে তাকালেও কেমন একটা গা ছম ছমে ভয় করে রাজুর। আজও বুক ঢিপ ঢিপ করছে। তাও এগোচ্ছে সে।

বাগানের ভারী লোহার গেটটা খুলতে বাঁ হাত ঠেকালো। কিন্তু বেশী জোর দেওয়ার আগেই একটা বিশ্রী ক্যাঁ-চ আওয়াজ করে গেটটা খুলে গেল। মাথা নিচু করে ঢুকে যায় রাজু। কোনভাবেই বাড়িটার দিকে চোখ পড়ে যায় ও চায় না। ভেতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় যেখানে বলটা পড়েছিল। কিচ্ছু চোখে পড়ে না। আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে। মাঠ থেকে উঁচু ক্লাসের দাদাদের নির্দেশ আসে – ‘ঐ যে কয়েত বেলের গাছটার তলায় দ্যাখ। ’

রাজু দেখল। কিচ্ছু নেই। কয়েত বেল, সবেদা গাছ, আম গাছ সব মিলিয়ে বন হয়ে আছে। নীচটায় বিস্তর ঘন ঝোপ। সেখানে অনেক বিছুটি গাছ। গায়ে লেগে গেলেই এমন কুটকুট করবে। সাবধানে এগোয় রাজু। এপাশে বড় গাছগুলোর গায়ে ইয়া বিশাল বিশাল মাকড়সার ফাঁদ আর তাতে বড় বড় লোমশ মাকড়সা ফাঁদ পেতে রয়েছে। কে জানে এদের মধ্যে কেউ টারান্টুলার বংশধর কিনা। যদি একটা কামড়ায় তাহলে স্পাইডার ম্যান হয়ে যেতে পারে ও। তখন আর কোন কিছু ভয় পাবে না রাজু। নানা রকম ভাবতে ভাবতে ও এগোতে থাকে। হঠাৎ পা পিছলে যায়।

গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতে থাকে। কি জানি কতক্ষণ একটা অন্ধকার সুরঙ্গ বেয়ে ও পড়ছিল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। ওর রোগা পটকা শরীরটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চোখের চশমাটা বুঝি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। তারপর এক সময় ধপাস করে পড়ল কোথাও। চোখ খুলে দেখে একটা সবুজ আলো চারিদিকে। কিছুতেই রাজু বুঝতে পারছে না এ কোথায় এসে পড়ল। কোথা থেকেই বা সবুজ আলোটা আসছে। তারপরে খেয়াল হল রাজুর বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পাশে যে এক্সট্রা আঙ্গুলটা আছে সেই আঙ্গুলের নখটা থেকে সবুজ আলো ঠিকরে বেরচ্ছে। রাজু এত অবাক হল যে ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই আঙ্গুলটার ওপর ওর এতদিন ভীষন রাগ ছিল – একে তো আঙ্গুলটা কোন কাজের নয় তার ওপরে ক্লাসে এটার জন্যে সবাই ওকে আলাদা করে রাখে। স্কুলের ছোট বড় সবাই ঐ এক্সট্রা আঙ্গুলের জন্যে ওকে ‘এক্সট্রা’ বলে ডাকে। একদিন এত দুঃখ হয়েছিল যে মাকে রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছিল যে ডাক্তার কাকুকে বলে আঙ্গুলটা কেটে বাদ দিয়ে দিতে। মা বলল, ‘ভগবান যখন এটা দিয়েছে তোকে তখন নিশ্চয় কোন একটা ভালো উদ্দেশ্য আছে। বড় হলে একদিন ঠিক বুঝতে পারবি’। এখন মনে মনে রাজু ধন্যবাদ দেয় মাকে। ভাগ্যিস এটা মা বাদ দিতে দেয়নি। তাই এই অন্ধকারে একটু আলো দেখা যাচ্ছে। না হলে বুঝতেই পারত না কোন দিকে যাবে।

হাল্কা সবুজ আলোর মধ্যে দেখল একটা দরজা। ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তক্ষুনি দরজাটা ম্যাজিকের মত খুলে গেল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখে একটা অন্য পৃথিবী। জ্যোৎস্নার মত নরম আলো চারিদিকে। সেই আলোতে সব কিছু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে সে। একটুও ভয় করছে না ওর। ও ঘুরে ঘুরে চারিদিক দেখলো। যতদূর চোখে পড়ে মনে হল কেমন উঁচু নিচু পাহাড়ি জায়গা। চারিদিকে অনেক সরু সরু বাঁশ গাছের জঙ্গল। মাঝে মাঝে জলা জায়গা। কিছু বড় বড় আকাশ ছোঁয়া লম্বা মোটা মোটা গাছ। সেই রকম একটা গাছের গুঁড়ির মধ্যের এক কোটর থেকে একটা অন্য রকম আওয়াজ পেয়ে উঁকি মারে রাজু। দেখে কিছু অদ্ভুত দর্শন ছোট ছোট সাইজের প্রানী। তিনটে বাচ্চা মা-এর গা ঘেঁসে ঘুমাচ্ছে আর মা প্রানীটা কি সব আওয়াজ করছে । ওকে দেখেই মা প্রানীটা উঠে বসল। ডাক দিল ওর বন্ধুদের–‘দ্যাখো এসে গেছে আমাদের বন্ধু। তোমরা যে যে দেখা করতে চাও চলে এসো তাড়াতাড়ি।’

মুহুর্তের মধ্যে বাঁশ বন আর জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো শয়ে শয়ে সেই অদ্ভুত দর্শন প্রানী। বিড়ালের থেকে একটু বড় আকারের। প্রায় সবার গায়ের রঙ লালচে কমলা ঘেঁষা। পা গুলো কালো। মুখে, চোখে, কানে সাদা ছোপ ছোপ। কেউ কেউ তাদের পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে খানিকক্ষন। মোটা লোমশ লেজ। ডগায় গোল গোল দাগ।  সবাই এসে ওকে ঘিরে ধরল। বলল, ‘সুস্বাগাতম বন্ধু। আমাদের দেশ তোমার কেমন লাগছে?’
‘বেশ ভালো লাগছে।’
ওদের কথার উত্তর দিয়ে রাজু নিজেই চমকে গেল খুব। ও কী করে এই সব প্রানীদের ভাষা বুঝতে পারছে? আর কথাও বলতে পারছে? রাজু জিজ্ঞাসা করে – ‘তোমরা কি আমাকে চেন? তোমরা কে? আমি কখনো তোমাদের মত প্রানী দেখিনি।’
তখন একজন খুব বয়স্ক প্রানী ঐ ভীড় ঠেলে এগিয়ে এলো। ওকে বলল সামনের উঁচু জায়গাটায় উঠে যেতে। রাজু উঠে গিয়ে একটা ঢিপিতে বসে। বয়স্ক প্রানীটাও উঠে গিয়ে পাশে বসে। বলতে শুরু করে –
‘আমরা লাল পান্ডার বংশধর। এই পান্ডা রাজ্যে আমি রাজা। এদের ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। কিন্তু সম্প্রতি আমরা একটা বিপদে পড়েছি। তুমি আমাদের সাহায্য করলে আমরা সেই বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারি।’
‘আমি? আমি কি করে তোমাদের সাহায্য করব?’
‘তুমি কি খেয়াল করেছ যে তোমার হাতেও ছটা আঙ্গুল আছে আমাদের মত। যে সব মানুষের হাতে আমাদের মত ছটা আঙ্গুল থাকে তাদের বিশেষ ক্ষমতা থাকে। তারা আমাদের দেশে এলে আমাদের ভাষা বুঝতে পারে। তারা আমাদের দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওই ছ’নম্বর আঙ্গুলের নখ থেকে সবুজ আলো বেরোয়। আর আমাদেরও ছ’নম্বর আঙ্গুলের নখ থেকে সবুজ আলো বেরোয়। তাতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের এক বন্ধু এসেছে এই দেশে।’  
রাজু খেয়াল করল সত্যি ওদের সবার হাতে ছটা আঙ্গুল। আর সেই এক্সট্রা আঙ্গুলের নখ দিয়ে ওর মতই হাল্কা সবুজ আলো বেরচ্ছে।   
ও বলল, ‘আমি তোমাদের জন্যে কিছু করতে পারলে খুব খুশী হব। বল কি রকম সাহায্য চাও তোমরা।’
‘বলব সব। আগে তুমি কিছু খেয়ে নাও। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমার খুব খিদে পেয়েছে।’
সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল রাজুর । ওরা অনেক ফল আর নরম নরম হাল্কা সবুজ ছোট কাঠির মত কিছু এনে দিল। ও অবাক হয়ে ভাবল এগুলো কি খাওয়া যাবে। তাও মুখে পুরল একটা। আহা কী সুন্দর নরম মিষ্টি খেতে সবুজ কাঠি গুলো। ফল গুলোও খুব সুস্বাদু। সব খাবার এক নিমেষে শেষ করে ফেলল। তার পর উঠে গিয়ে ঝর্নার জল খেল।  

তখন পান্ডা রাজা বলল চলো দেখবে চলো। ওকে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল ওদের দেশ। মা পান্ডারা কেমন কাঠি আর পাতা দিয়ে গাছের কোটরে বাসা বেঁধেছে। ছোট পাণ্ডা গুলোর গায়ে তেমন লোম নেই। কিছু ছোট পান্ডার গলায় আর লেজে কেমন ঘা মতো হয়েছে।
তাই দেখে রাজু বলল -‘পান্ডা রাজা, ওদের গায়ে ঘা কেন?’
‘বন্ধু, ওটাই ওদের অসুখ। বেশ কিছু বছর ধরে ছোট ছোট পান্ডার এই অসুখ হচ্ছে। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওরা মরে যাচ্ছে। তাই পান্ডাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই ভাবে চললে আর কয়েক বছর পরে লাল পান্ডা বিলুপ্ত হয়ে যাবে । তুমি যদি কোনভাবে এর ওষুধ এনে দিতে পারো তাহলে আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে।’
‘আমি চেষ্টা করব। কিন্তু কি করে বুঝবো যে কোন ওষুধে তোমাদের এই অসুখটা সত্যিই সারবে?’
পান্ডা রাজা খানিকক্ষন ভাবল। তারপর একটা খুব ছোট্ট বাচ্চা পান্ডাকে ডাকল। বলল – ‘এর নাম ভিন্ডি। এর মা বাবা কেউ নেই। সবাই এই অসুখে মারা গেছে। এরও গায়ে ঘা হয়েছে। একে তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও। কোন ওষুধের সন্ধান পেলে সেটা আগে এর গায়ে লাগিয়ে দেখবে। যদি এর ঘা সেরে যায় তাহলে বুঝতে পারবে তুমি ঠিক ওষুধ খুঁজে পেয়েছ। তখন বেশী করে ঐ ওষুধ নিয়ে ভিন্ডিকে সঙ্গে করে এখানে এস। আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।’
সঙ্গে সঙ্গে খুশী মনে ভিন্ডি লাফিয়ে ওর গায়ে উঠে ওর ঢোলা প্যান্টের পকেটে ঢুকে পড়ল।
‘কিন্তু এখানে আবার আসব কি করে?’
‘কেন? যে ভাবে এসেছ সে ভাবেই। বাগানের গেটের লোহার দরজাটায় তোমার এক্সট্রা আঙ্গুলটা ঠেকাবে আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে যাবে। তারপরে সবেদা গাছের নীচে আসবে। বিছুটি গাছ বাঁচিয়ে ডান দিকে হেঁটে আসবে। যেখানে অনেক লাল লাল ছোট ছোট ফলের গাছ আছে। তার ফুল গুলো দেখবে উলটানো কলসির মত। ওখানে এসে দাঁড়ালেই তুমি এখানে এসে পৌঁছে যাবে।’
‘আচ্ছা। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব পান্ডা রাজা।’

পান্ডা রাজা তখন ওকে পাহাড়ের এক গুহাতে নিয়ে গেল। সেখান একটা বিশাল গর্ত দেখিয়ে বলল – ‘এই গর্ত দিয়ে গড়িয়ে যাও। যেখানে ছিলে সেখানে পৌঁছে যাবে।’
রাজু সবাই কে বিদায় জানিয়ে সেই গর্তে ঢুকে পড়ল। এইবার আর ওর ভয় করল না। নখ থেকে বেরনো আলোতে ও সুরঙ্গটা বেশ ভাল দেখতে পাচ্ছিল। একটুও তালগোল পাকালো না শরীরটা। বেশ স্লিপে চড়ার মত করে নেমে এল আস্তে আস্তে।

বেরিয়েই দেখে সবেদা গাছটা আর তার নীচে সেই লাল ফলের গাছটা। তার ফুল গুলো সত্যি উলটানো কলসির মত।  সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজল ঢং ঢং করে। এক ছুটে রাজু ঢুকে গেল স্কুলে। ক্লাসে সারাক্ষণ খুব সাবধানে নড়াচড়া করল। সিট থেকে একবারো উঠলো না। কেউ যদি দেখে ফেলে পকেটের ভিন্ডিকে। পাশে বসে অরিত্র ফিসফিস করে জিগ্যেস করল – ‘তুই বাগানে ঢুকে কোথায় ভ্যানিস করে গেলি? শেষে মিহিরদা গিয়ে বলটা কুড়িয়ে আনল।’
‘আমি ওই দিকে কটা পাকা সবেদা পড়েছিল সেগুলো কুড়োতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবগুলো পাখিতে খাওয়া বিচ্ছিরি।’
 


স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় স্কুল বাস থেকে নেমে বাড়ি না ঢুকে সোজা বাড়ির কাছের একটা পার্কে গেল রাজু। সেখানে গিয়ে একটা বড় ঝাউ গাছের আড়ালে বসল। টিফিনটা খাওয়ার সময় হয়নি আজ। মা দেখলে বকবে। টিফিনটা ভিন্ডির সঙ্গে ভাগাভাগি করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে হবে। তাছাড়া ভিন্ডির সঙ্গে অনেক আলোচনাও আছে। কী ভাবে ওষুধ খুঁজবে তার কোন আইডিয়া আসছে না মাথায়।

পকেটে হাত দিয়ে ভিন্ডিকে বার করতে যায় রাজু । দেখে কিচ্ছু নেই। পকেট ফাঁকা। কোথায় গেল। পকেটেই তো ছিল। মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় রাজুর। তখন ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কুঁই কুঁই শব্দ পায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খোলে। দ্যাখে ব্যাগের ভেতরে ভিন্ডির চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।
‘আরে ভিন্ডি। তোকে না দেখতে পেয়ে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘স্কুলে অনেক ছেলে দেখে ভয় পেয়ে  তোমার ব্যাগে ঢুকে পড়েছিলাম।’
ভিন্ডি ওর গা ঘেঁষে বসে। দুজনে মিলে ভাগ করে টিফিন খায় আর গল্প করে।

টিফিন খাওয়া শেষ হলে রাজু ভিন্ডিকে জিজ্ঞেস করে - ‘কী করে জানা যায় বলতো কী ওষুধে তুই ভালো হবি?’
ভিন্ডি বলে - ‘দেখি ঐ হুলো বিড়ালটা কিছু জানে কিনা। চলো ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি।’
দুজনে যায় হুলো বিড়ালের কাছে। ‘বিড়াল ভাই, বিড়াল ভাই, তোমার একটু সাহায্য খুব দরকার।’
হুলো বিড়ালটা পেট ভরে খেয়ে সবে একটা হাসনুহানার ঝোপের মধ্যে একটু ঘুমাচ্ছিল। রেগে গিয়ে বলে –
‘বিরক্ত কোরো না এখন। দেখছ না ঘুমাচ্ছি।’
‘তুমি না সাহায্য করলে আমি বাঁচব না। দেখো আমায় গা। কেমন সব লোম উঠে যাচ্ছে। তুমি এর ওষুধ জানো?’ ভিন্ডি নিজের গা দেখায়। হুলো বেড়াল তখন সামনের ডান পা দিয়ে চোখ রগড়ে উঠে বসল। বলল –
‘আমি কী আর জানি? তবে ঐ কাঠবিড়ালীটা জানতে পারে। চলো ওর কাছে যাই তিনজনে।’
পার্কের এক কোনে এক ঝাঁকড়া কাঠবাদাম গাছের নীচে কাঠবিড়ালীটা তখন ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছিল। ওরা কাছে গিয়ে বলল – ‘কাঠবিড়ালী, একটু দাঁড়াও ভাই। আমাদের কিছু কথা বলার আছে।’
‘আমি খাবার জোগাড় করায় খুব ব্যাস্ত আছি। দেখতে পাচ্ছ না?’
‘আমরা তোমায় বাদাম কুড়িয়ে দিই যদি?’
‘না না সে তোমরা পারবে না। আচ্ছা বলো কি দরকার।’
সব শুনে কাঠবিড়ালী বলে – ‘আমি এসবের খবর রাখিনা। চলো দেখি ঐ কাঠঠোকরাটা জানে কিনা।’
কাঠঠোকরাটা একমনে গাছের গুঁড়িতে ঠক ঠক করে গর্ত করে পোকা ধরে খাচ্ছিল। সে বিরক্ত না হয়ে সব মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল – ‘কাকেরা খুব বুদ্ধিমান হয়। কাকগুলো জানলেও জানতে পারে। চলো সবাই মিলে ওদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করি।’
সবাই মিলে যায় কাকেদের কাছে। এক ঝাঁক কাক বট গাছের মাথায় বসে গল্প গুজব করছিল। তারা সব শুনে  ভয়ানক জোরে কা কা করে সবাই কে জানিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে -  ‘কেউ কি জানো এর ওষুধ?’
এক কাক বলে – ‘একজন জানতে পারে। হুতুম প্যাঁচা। খুব জ্ঞানী আর অনেক বয়স তার। পার্কের পেছন দিকে একটা অর্জুন গাছ আছে। তার কোঠরে সে থাকে । ওর কাছে যাও।’
সবাই মিলে গেল প্যাঁচার কাছে। প্যাঁচা শুনলো খুব গম্ভীর হয়ে। তারপরে বলল – ‘জটিল সমস্যা। আমি পাখিদের অসুখের ওষুধ জানি। কিন্তু জন্তু জানোয়ারদের অসুখের সম্বন্ধে খুব বেশি জানিনা। তবে একটা গোপন খবর দিতে পারি। প্রত্যেক অমাবস্যার রাত্রে এই পার্কে জন্ত জানোয়ারদের সভা হয়। তারা তাদের সুবিধে অসুবিধে নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। অনেক জ্ঞানী গুনী জন্তু জানোয়াররা আসে। তোমরা সেই সময় এসে কথা বলে দেখতে পার।’
‘এ তো দারুন ব্যাপার। ঠিক আছে তাই আসব। এমন সুযোগ হারানো যাবে না।’
‘তবে সভা শুরু হয় অনেক রাত্রে। সভায় সভাপতি থাকে এক শেয়াল। সে তিনবার হুক্কা হুয়া বলে ডাকে। তারপরে শুরু হয় আলোচনা। তোমরা এই আওয়াজটা শুনতে পেলেই পার্কে চলে আসবে। ঘুমিয়ে পড়ো না যেন।’

রাজু আর ভিন্ডি প্যাঁচা, কাঠঠোকরা, কাঠবিড়ালী, হুলোবিড়াল আর সব কাকেদের কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি এসে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা দেখল ভালো করে। আর মাত্র দুদিন পরেই অমাবস্যা। ঠিক করল প্যাঁচার কথা মতো ওরা সেই দিন পার্কে যাবে।



অমবস্যার দিন রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাজু আর ভিন্ডি দুজনে জেগে বসে রইল বিছানায়। ঘরের একটা জানলা খুলে রাখল যাতে শিয়ালের ডাক শুনতে পায়। এপাশে রাত বাড়তে থাকে। ঘুমে চোখ বুজে আসছে রাজুর।  মাঝেমাঝেই ঘুমিয়ে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছে ভিন্ডির গায়ে। ভিন্ডির চোখে ঘুম নেই। বসে বসে চীনা বাদামের খোলা কড়মড় করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাদাম খাচ্ছে সে। রাজু উপায় না দেখে ভিন্ডির মতো চীনাবাদাম খেতে শুরু করল। হঠাৎ হুক্কাহুয়া ডাকে চমকে গেল রাজু। তারপর গুনে গুনে ঠিক তিনবার হুক্কা হুয়া ডাক দিয়ে থেমে গেল শেয়ালটা। তখন চুপিচুপি দুজনে বেরল বাড়ি থেকে। রাজুর হাতে একটা টর্চ। রাস্তা খুব অন্ধকার। দেখল রাস্তায় কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, খরগোস, হনুমান, কাঠবিড়ালী আরো কত রকমের প্রানী। সবাই চলেছে পার্কের দিকে। অন্যদিন হলে রাজু এত রাত্রে বাড়ির বাইরে বেরোনার কথা ভাবতেই পারত না। কিন্তু আজ সব কিছু অন্যরকম।

পার্কের কাছে পৌঁছতেই দেখল দুটো ভয়ংকর দেখতে বিশাল চেহারার কুকুর গেটে পাহারা দিচ্ছে। তারা প্রথমে রাজুকে ঢুকতে কিছুতেই অনুমতি দিচ্ছিল না। তারপর ভিন্ডি ওদের অনেক করে বোঝালো যে রাজু ওর বন্ধু। রাজু সাহায্য করেছে বলেই আজ ও এখানে আসতে পেরেছে। তখন কুকুর দুটো নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে নিল। তারপর বলল –‘একমাত্র একটা শর্তে ঢোকার অনুমতি দিতে পারি। ভেতরে গিয়ে একটা কথাও বলা চলবে না রাজুর।’

সেই শর্ত মেনে নিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকলো। দেখল সভা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ভেতরের বড় ফুটবল খেলার জায়গাটায় গোল হয়ে সবাই বসে আছে। আশে পাশের গাছের কোন ডালও খালি নেই। কয়েক শো প্রানী। রাজু সবার নাম ও জানে না। কারো কারো ছবি দেখেছে শুধু। একজন মোটাসোটা বয়স্ক শেয়াল মাঝখানে বসে কিছু বলছে। রাজু আর ভিন্ডি গিয়ে সামনের দিকে বসল। সবাই ওদের দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
ভিন্ডি বলল – ‘চিন্তা করোনা। ওরা এই সভায় কোন দিন কোন মানুষকে আসতে দেখেনি। তাই খুব অবাক হয়েছে।‘
শেয়ালটা নিজের বক্তব্য শেষ করেই ভিন্ডিকে ডাকল। ভিন্ডি গিয়ে সব কথা বলল। শিয়ালটা আরো কয়েকটা শেয়ালের সঙ্গে আলোচনা করে নিল। তারপর বলল - ‘নিম।’
ভিন্ডি বলল – ‘নিম?’
শিয়ালটা বলল – ‘নিম গাছ খুব উপকারী। নিমের গাছের পাতা, ফল, ফুল, ছাল থেকে অনেক রকম ওষুধ তৈরী হয়। তোমরা কি জানো আফ্রিকাতে নিম গাছকে বলে মারোবাইনি। যার মানে এমন গাছ যা চল্লিশটা অসুখ সারাতে পারে। যাও গায়ে নিম পাতার রস গায়ে লাগাও। আর রোজ দু চারটে করে নিম পাতা চিবিয়ে খাও। সব অসুখ সেরে যাবে।’

রাজু শুনে খুব খুশী হল। এত সোজা ওষুধ। নিম গাছ তো অনেক আছে। পার্কের মধ্যেই আছে বেশ কয়েকটা। শেয়ালকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে এল ওরা।

পরদিন সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে পুকুরের ধারের নিম গাছ থেকে এক মুঠো কচি পাতা তুলে আনে রাজু । দু হাতের চেটোর মাঝে নিম পাতা রেখে থেঁতলে রস বার করে লাগিয়ে দেয় ভিন্ডির গায়ে। দুটো পাতা ওর মুখে দিয়ে বলে – ‘নে, চিবিয়ে খেয়ে নে।’
ভিন্ডি নিম পাতা চিবিয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে - ‘ইস কী বিচ্ছিরি তেতো খেতে।’
‘কিন্তু খুব উপকারী। এটাই তোর ওষুধ। লাফাস না। খেয়ে ফেল।’
এই ওষুধ চলল রোজ। তিনদিনের দিন পুরো সেরে গেল ভিন্ডির অসুখ। তাই দেখে রাজু আর ভিন্ডির খুশির সীমা রইল না।

পরদিন সকালে স্কুল যাওয়ার সময় রাজু একটা বড় প্যাকেট ভর্তি নিম পাতা আর একটা বড় প্যাকেট ভর্তি নিমের ফল ঢুকিয়ে নিল ব্যাগে। ভিন্ডিকে পুরে নিল প্যান্টের পকেটে। তারপর স্কুলের টিফিনের সময় সবাই যখন খেলায় ব্যাস্ত, তখন চুপি চুপি ঢুকলো রায় বাগানে। গেটে ওর এক্সট্রা আঙ্গুলটা ঠেকাতেই খুলে গেল দরজা। তারপর এসে দাঁড়ালো সবেদা গাছের তলায় সেই লাল ফলের গাছটার কাছে।  আর সঙ্গে সঙ্গে হুস করে ঢুকে গেল সুড়ঙ্গে। সবুজ আলো বেরতে থাকল ওর আর ভিন্ডির নখ থেকে।

ওকে আর ভিন্ডিকে দেখে পান্ডা রাজা আর তার দেশের সবাই খুব খুশী হল। ভিন্ডির অসুখ সেরে গেছে দেখে ওদের চোখ গুলো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। ও নিম পাতার প্যাকেটটা দিল পান্ডা রাজা কে। আর জলা জায়গার চারপাশে ছড়িয়ে দিল সব নিম গাছের ফল। বলে দিলো – ‘এই ফলগুলো থেকে গাছ জন্মাবে। গাছ একটু বড় হলে পাতা তুলে পাতার রস লাগাবে গায়ে। আর রোজ দুটো একটা পাতা তুলে খাবে। যখন ফল ধরবে এই গাছে পাকা ফল ঝরে ঝরে পড়বে, তখন সেই ফল নিয়ে গিয়ে ফেলে দিও সব জলা জায়গার আশে পাশে। এইভাবে একদিন এই গাছ পান্ডা রাজ্যের চারিদিকে ছেয়ে যাবে। তোমাদের কোন দিন আর পাতার অভাব হবে না। আর অসুখও হবে না।’
সবাই খুব খুশি হল। ওকে অনেক ধন্যবাদ জানালো। বলল মাঝে মাঝে ঘুরে যেতে পান্ডা রাজ্যে।

কাজ সেরে রাজু ফিরে এলো স্কুলে। খুব মন কেমন করতে লাগল ভিন্ডির জন্যে। কদিনে বেশ বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে মন খারাপ করে বসে রইল রাজু। আর ঠিক তখনই পকেট থেকে ভিন্ডি বেরিয়ে টেবিলে উঠে বলে – ‘তোমার মনখারাপ কেন?’
‘আরে, তুই কোথা থেকে এলি?’
‘আমি তো পালিয়ে এসেছি এখানে তোমার সঙ্গে থাকব বলে।’  
‘কিন্তু পান্ডা রাজা জানতে পারলে খুব দুঃখ পাবে। রেগেও যাবে হয়তো।’
‘আমি পান্ডা রাজাকে বলেই এসেছি। এখন চলো দুজনে পার্কে গিয়ে একটু খেলে আসি। আর কাঠবিড়ালী, প্যাঁচা, কাঠঠোকরা, হুলো বিড়ালদের সঙ্গে দেখা করে আসি।’

রাজু আর ভিন্ডি দুই বন্ধুতে দারুন সময় কাটে এখন। ভিন্ডি বাঁশ তেমন খেতে পায় না। কিন্তু নানা রকম ফল, বাদাম, মুরগীর ডিম আর পোকামাকড় খেয়ে দিব্যি খুশীতে আছে। দিনের বেলা রাজু স্কুলে গেলে ভিন্ডি অনেক ঘুমায় আর বিকেলে রাজু স্কুল থেকে ফিরলে সারাক্ষন রাজুর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। রাত্রেও জেগে থাকে অনেক্ষন। এখনো রাত জাগা অভ্যেসটা যায়নি। সময় পেলে ওরা মাঝে মাঝেই ঘুরে আসে পান্ডা রাজ্যে। তখন পেট ভরে বাঁশ খেয়ে আসে ভিন্ডি। রাজুকে এখন কেউ এক্সট্রা বলে ডাকলে আর দুঃখ হয়না ওর। ওরা তো কেউ জানেনা ওর লুকোন ক্ষমতাটা।

 

রুচিরা
বেইজিং, চীন