খেলাঘরখেলাঘর

কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান


ছুটি পড়েছে স্কুলে। চার বন্ধু কিংশুক, কেকা, কাবেরী আর কোজাগর রোজ বিকেলে ক্যারাটে শিখতে যায় কাছাকাছি এক ক্লাবে। সেখান থেকে ফিরে জড়ো হয় পার্কে। একটু খেলাধূলো আর অনেকটা আড্ডা মেরে সন্ধ্যের সময় যে যার বাড়ি ফেরে। পার্কটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যে ‘সুচেতনা’ রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স, এদের সবার বাড়ি সেখানেই।

আজ পার্কে ঢুকে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করে রেখেই কেকা বলল
-    একটা মুশকিলে পড়েছি।
-    কিরকম মুশকিল?
-    সারাদিন গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে না, টিভি দেখতেও ইচ্ছে করে না। পছন্দসই অন্যরকম কিছু একটা কাজ চাই। কী করা যায় বলতো?
কিংশুকও মুখ ব্যাজার করে বলল
-    হ্যাঁ আমারও ঐ একই মুশকিল। ভিডিও গেমস খেলতেও ইচ্ছে করে না আজকাল। কিছু ইন্টারেস্টিং কাজ পেলে খুব ভালো হত।
কাবেরী বলল
-    আমারও একই দাবী। ভালোলাগে না রোজ এই একঘেঁয়ে ছুটি কাটাতে।

কোজাগর ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে তড়বড়িয়ে বলে উঠল
-    কেকিকোকা?
সবাই মিলে জিগ্যেস করল
-    কেকিকোকা? এটার মানে কি?
-    কেকিকোকা মানে কে কি ধরনের কাজ চাস, কোন সময় কাজ করতে চাস, কোথায় বসে কাজ করবি, কাজের জন্যে কাদেরকে সঙ্গে চাস ইত্যাদি প্রভৃতি আর কি। মানে কোনো বিষয় নিয়ে যা যা প্রশ্ন করা যেতে পারে সেগুলোকে এককথায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায় – ‘কেকিকোকা’।

কিংশুক কোজাগরের পিঠে একটা বিশাল চাপ্পড় মেরে বলল
-    ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।
-    কেকিকোকা?
-    মানে?
-    এইতো বললাম মানেটা। আবার বলে দিতে হবে? মানে আইডিয়াটা কেন ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট হল তো কি হল, কোন কাজে লাগতে পারে আইডিয়াটা, কারই বা কাজে লাগবে ইত্যাদি প্রভৃতি ।
-    ওহ তাই বল। হ্যাঁ হ্যাঁ কাজে লাগবে। আমাদের সবার কাজে লাগবে।

কেকা, কাবেরীও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
-    বল, বল। শিগ্রী বল। কিভাবে কাজে লাগতে পারে?
-    শোন আমরা একটা দল মানে একটা গ্রুপ বানাতে পারি। তার নাম হবে ‘কেকিকোকা’।
-    কি করব আমরা সেখানে?
-    নাম যা বলছে তাই। মানে কোজাগর যেমন বলেছে সেই রকমই। আমরা যে কোন লোকের নানান কি, কেন, কোথায়, কারা, কিভাবে এই সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
-    দেব বললেই দেওয়া যাবে নাকি। আমরা কি সব প্রশ্নের উত্তর জানি?
-    আরে জানিনা তো কি জেনে নেওয়া যাবে। আমার কম্পিঊটার আছে। ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই।
কেকা বলল
-    তাছাড়া আমরা আমাদের বাড়িতে বড়দেরও জিগ্যেস করে জেনে নিতে পারি। আমার বাড়িতে একটা বিশাল লাইব্রেরী আছে সেখানে এমন কোন বই নেই যা নেই।
কাবেরী বলল
-    আমাদের ক্যারাটে ক্লাবের পাশে ‘জ্ঞান পাঠাগার’ নামের যে লাইব্রেরীটা আছে তার আমি মেম্বার। দরকার পড়লে সেখানেও যেতে পারি আমরা।
-    গ্রেট। তাহলে আর কি। চল নেমে পড়ি। কি রে কোজাগর তখন থেকে তুই চুপ যে। নতুন আইডিয়াটা কেমন লাগল বললি না তো।

কোজাগর বলল
-    আইডিয়াটা যে ব্রিলিয়ান্ট সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ‘কেকিকোকা’ নামের কিন্তু আরও একটা মানে আছে। এই নামটার মধ্যে আমাদের সবার নামের প্রথম অক্ষরটা লুকিয়ে আছে। কেকার ‘কে’, কিংশুকের ‘কি’, কোজাগরের ‘কো’ আর কাবেরীর ‘কা’ মিলিয়ে ‘কেকিকোকা’।

কারো মাথায় এটা আসে নি আগে। সবাই বুঝতে পেরে খুব উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো
-    তাই তো! হুররররে...
কোজাগর বলল
-    ‘কেকিকোকা’-র সঙ্গে ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’-এর ‘দ্য গ্রেট’-এর মতো ‘দ্য মুশকিল আসান’ জুড়ে দিলে কেমন হয়। আমরা লোকেদের মুশকিল আসান করতে চাই। আর সেই সঙ্গে নিজেদের সময় কাটানোর মুশকিলেরও আসান হবে।
-    ‘কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান’। জমাটি নাম।
-    দুর্দান্ত ! গ্রুপের নাম তাহলে এটাই ফাইনাল করা হল।

সবাই একবাক্যে মেনে নিল।



কিংশুকদের বাড়িতে ওর পড়ার ছোট্ট ঘরটা ‘কেকিকোকা’-র অফিস ঘর হিসেবে চিহ্নিত করা হল। এই ঘরে একটা কম্পিউটার আছে। এটা একটা বিশাল উপরি পাওনা ওদের। বাড়ির লোকেরা কেউ কোন আপত্তি করল না। বরং নিশ্চিন্ত হল যে ছেলেমেয়েগুলো সাইকেল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে না বেড়িয়ে ঘরবন্দী কাটাবে কিছুক্ষন।

কম্পিউটারে ছবি এঁকে ‘কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান’ লিখে পোস্টার বানালো কিংশুক। সঙ্গে জুড়ে দিল তাদের নতুন অফিসের ঠিকানা সহ ম্যাপ। আর কাবেরীর ফোন নাম্বার। ওদের মধ্যে একমাত্র কাবেরীরই নিজস্ব মোবাইল আছে। নতুন একটা ইমেল আইডি বানিয়ে সেটাও জুড়ে দিতে ভুললো না। তারপর লিখল

‘প্রশ্ন আছে কিন্তু উত্তর জানা নেই? যোগাযোগ করুন। ফ্রী সার্ভিস।

‘ফ্রী সার্ভিস’ নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল সবাই। কিন্তু ঠিক করা হল আপাততঃ কিছুদিন বিনা পয়সাতেই কাজ করে অভিজ্ঞতা বাড়ানো হবে। লোকজনের আস্থা অর্জন করতে পারলে নিজেদের মনোবল বাড়বে। তখন কিছু পারিশ্রমিক নেওয়া চলতে পারে। সেই মতো পোস্টারও বদলে দেওয়া হবে তখন।

তারপর ছাপিয়ে বার করল সেই পোস্টার। সাদাকালো প্রিন্টারে ছাপানো বলে দেখতে একটু ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিল। কাবেরী আর কোজাগর সঙ্গে সঙ্গে রং তুলি নিয়ে বসে গেল। আধঘন্টায় কুড়িটা পোস্টার দেখতে ঝকঝকে আকর্ষনীয় হয়ে উঠলো। তারপর যে যার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে পোস্টার, আঠা, সেলোটেপ, কাঁচি ইত্যাদি যা যা লাগতে পারে। পার্কের সব দিকের গেটে, পার্কের মধ্যে বড় বড় কয়েকটা গাছের গায়ে প্রথম পোস্টার আঁটা হল। তারপর কমপ্লেক্সের বাইরে চৌরাস্তার মোড়ে কয়েকটা আর বিশুদার মুদির দোকানের গায়ে, কাগজ ও ম্যাগাজিনের স্টলের পাশের লাইট পোস্টটায়। টেলিফোন বুথের সামনে। আরো যেখানে যেখানে নজরে পড়ল লাগিয়ে দিল।

আজকের মতো কাজ শেষ। সবার মনেই এখন ‘কেকিকোকা’ টাইপের অনেক প্রশ্ন জমে উঠেছে। পোস্টার তো লাগানো হল। কিন্তু পোস্টারটা কারো কি নজরে পড়বে? কারো কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে? কেউ কি আসবে? কেউ কি ফোন বা ইমেল করবে? করলেও কবে করবে? এসবের উত্তর ওদের জানা নেই। একমাত্র সময়ই বলতে পারে কি হবে। তাই এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা।

চৌরাস্তার মোড়ে সুদীপ কাকুর রোলের দোকানটা চোখে পড়তেই সবার খুব রোল খিদে পেয়ে গেলো। চারটে এগরোল অর্ডার দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ কোজাগর বলল
-    দ্যাখ বিশুদার মুদির দোকানের বাইরে একটা লোক আমাদের পোস্টারটা খুব মন দিয়ে দেখছে।

সবাই তাই দেখে খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল। কিংশুক বলল
-    চল চল লোকটির সঙ্গে কথা বলে দেখি। কি ভাবছেন কিছু যদি জানা যায়। কেকা, কাবেরী তোরা রোলটা নিয়ে আয়।

কোজাগর আর কিংশুক রাস্তা পেরিয়ে ভদ্রলোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ভদ্রলোকটি এক মনে তাকিয়ে রয়েছে পোস্টারের দিকে। কি যেন ভাবছেন। খুব চিন্তাচ্ছন্ন মুখ।
-    কিছু ভাবছেন কাকু?
-    আচ্ছা, এই পোস্টারটা আগে তো চোখে পড়েনি কখনো।
-    হ্যাঁ আজই মারা হয়েছে। আপনার কি জানার মতো কোন প্রশ্ন আছে?
-    আছে। কিন্তু কোন কাজ হবে মনে হয় গেলে? ফ্রীতে সার্ভিস দেবে বলেছে। ভরসা করা যাবে?
-    ফ্রীতে যখন সার্ভিস দেবে তখন তো আপনার হারানোর কিছু নেই। টাকা পয়সা তো আর মার যাচ্ছে না। বরং লাভ হলেও হতে পারে। একটু দেখুনই না হয় বিশ্বাস করে।
-    তা অবশ্য মন্দ বলোনি। তোমরা জানো কোথায় এদের অফিস?
-    আসলে আমরা চারবন্ধু মিলে এই গ্রুপটা ফর্ম করেছি। আপনি যদি আমাদের ভরসা করতে পারেন তাহলে আমরা আমাদের অফিসে গিয়ে বসে কথাবার্তা বলতে পারি।

ভদ্রলোক একথা শুনে ভীষন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এত বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে দেখে বিশেষ ভরসা করলেন বলে মনে হল না। ততক্ষনে কেকা আর কাবেরীও রোল নিয়ে হাজির হয়েছে। সবাই মিলে চেপে ধরল।
-    কাকু, আমাদের ওপর একটু ভরসা করে দেখুন। ক্ষতি হবার তো কিছু নেই।
ভদ্রলোক একটু ইতস্ততঃ করে বললেন
-    ঠিক আছে। চলো তোমাদের অফিসে গিয়ে বসে কথাবার্তা বলা যাক।

ভদ্রলোকের বাইক রাখা ছিল সামনেই। বাইকে স্টার্ট দিলেন। ওরা চারজনে সাইকেল চালিয়ে আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।






সবাই মিলে ঢুকলো ওদের অফিস ঘরে। কেকা ভদ্রলোককে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল বসার জন্যে। কিংশুক ভেতর থেকে এক গ্লাস জল এনে দিল।

কোজাগর শুরু করল কথাবার্তা
-    কাকু, আপনার নামটা একটু বলুন।
-    আমার নাম মিহির মজুমদার।
-    আপনার প্রশ্ন কি?
-    আমার বাড়ির পোষা কুকুর বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ ভ্যানিস করে গেল কি করে?

কিংশুক ততক্ষনে তার কম্পিউটার অন করে ফেলেছে। লিখতে শুরু করেছে তাদের ‘কেকিকোকা দ্য মুশকিল আসান’-এর প্রথম প্রজেক্টের সব খুঁটিনাটি।

নাম - মিহির মজুমদার।
প্রশ্ন - বাড়ির ভেতর থেকে পোষা কুকুর হঠাৎ কোথায় ভ্যানিস করে গেল?

কোজাগর জানতে চাইল – কী কুকুর?
-    স্পিৎজ। ছোট্ট সাদা কুকুর। নাম জিমি।
-    কোন দিন ও কোন সময় ঘটেছে ঘটনাটা?
-    তিনদিন আগে। দুপুর বেলা। বাড়িতে আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। কুকুরটাও বাড়িতেই ছিল। ঘুম থেকে উঠে থেকে কুকুরটাকে আমরা আর কেউ দেখতে পাইনি।
-    বাড়িতে কে কে ছিলেন সেই সময়?
-    সবাই ছিলাম। আমি, আমার স্ত্রী সুমিতা, দুই মেয়ে রিয়া আর দিয়া, আমার বয়স্ক মা আর বাবা।
-    কুকুরটাকে কেউ চুরি করতে পারে কি? কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?
-    না, সেরকম কখনো মনে হয়নি।
-    ঘরের দরজা কি খোলা ছিল? কেউ উঠে আসতে পারে ওই সময়?
-    না। নিচের মেন দরজা বন্ধই ছিল।
-    আচ্ছা, আমরা কি আপনার বাড়িটা গিয়ে একবার দেখে আসতে পারি।
-    নিশ্চয়। এখনই চলো আমার সঙ্গে।

ওনার বাড়ি চৌরাস্তার খুব কাছেই। ওরা সবাই গিয়ে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল সবকিছু। মিহিরবাবুর দোতলা বাড়ি। পাশাপাশি অনেকগুলো একইরকম বাড়ি। নিচে ওনার বয়স্ক মা বাবা থাকেন। ওপরে থাকেন উনি, ওনার স্ত্রী আর দুই মেয়ে। মেয়েরা ছোট। দিয়া হাঁটতে শিখেছে সবে। রিয়া স্কুলে যায়। ক্লাস টু তে পড়ে। ছাদে অনেক ফুলগাছের টব। সব কিছু ভাল করে দেখল ওরা। কিছু মাথায় এলো না কারো। সবার সঙ্গে কথা বলে শুধু একটা নতুন খবর পেল। মিহিরবাবুর মা বললেন ওনার আলমারির চাবিটাও সেদিন থেকে খোওয়া গেছে। উনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ঘুম এসে যেতে চাবিটা বিছানাতেই খবরের কাগজের ওপরে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। উঠে থেকে আর চাবিটা দেখতে পাচ্ছেন না।
মিহির বাবু বললেন
-    মা ওরকম প্রায়ই এটা সেটা হারিয়ে ফেলে। আসলে কোথাও নিশ্চয় যত্ন করে তুলে রেখেছে। এখন আর মনে পড়ছে না। এই ব্যাপার নিয়ে তোমাদের ভাবার কিছু নেই। দুদিন পরেই ও চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে।

যাইহোক কুকুরের একটা ফটো নিয়ে ওরা বাড়ি ফিরে এলো।




বাড়িতে এই নিয়ে অনেক আলোচনা চলল চার বন্ধুর মধ্যে। চাবি হারানোর সঙ্গে কুকুর হারানোর কোন সংযোগ খুঁজে বার করতে পারল না কেউই। তাই চাবি হারানোর ব্যাপারটা আপাততঃ গুরুত্ব না দিয়ে ককুর রহস্য ভেদ করাই প্রথম লক্ষ্য বলে ঠিক করল ওরা।

কেকা বলল
-    আমরা তো আশেপাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি কেউ দেখেছে কিনা কুকুরটাকে।
-    আশেপাশে তো অনেক বাড়ি। কটা বাড়িতে যাবি?
-    অন্ততঃ ঐ ব্লকটার সব বাড়ি।

সেই মতো ওরা বেশ কয়েকটা বাড়িতে খোঁজ নিল। কেউ তেমন কিছু বলতে পারল না।

মন খারাপ করে সবাই এসে জড়ো হল পার্কে। কি করা যায় বুঝে উঠতে পারছে না। ফটোটা হাতে নিয়ে চারজনে আলোচনা করছে। হঠাৎ একটা মহিলা এসে বললেন,
-    এই কুকুরটাকে কি তোমরা খুঁজছ? আমি এরকম একটা সাদা কুকুর দেখেছিলাম।
একটুকরো আশার আলো দেখে সবার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো
-    কবে? কোথায়?
-    দু-তিন দিন আগে। রাস্তার ধারে চুপ করে বসে ঝিমোচ্ছিল। মনে হল খুব শরীর খারাপ। আমি বাড়ি এনে জল দিলাম, খেতে দিলাম। খেতে চাইল না। ঝিম মেরে বসেছিল। পায়েও চোট ছিল। পা ফেলে হাঁটতে পারছিল না।
-    তারপর কি করলেন?
-    আমি বাড়িতেই রাখতে চেয়েছিলাম। কুকুরটাকে দেখে খুব মায়া হচ্ছিল। কিন্তু আমি তো আমার নিজের বাড়িতে থাকিনা। একজনদের বাড়িতে কাজ করি। সেখানেই থাকি। ঐ বাড়ির কেউ কুকুর পছন্দ করে না। কুকুরটা বাড়িতে এনেছি দেখে খুব রেগে গেল আমার ওপর। কোথাকার না কোথাকার কুকুর তাও অসুস্থ। কিছুতেই রাখতে দিল না। আমি আর কি করি। কুকুরটাকে আবার রাস্তায় ধারে ছেড়ে দিয়ে এলাম। কুকুরটা নিশ্চয় আর বেঁচে নেই।
মুখটা খুব দুঃখী করে দাঁড়িয়ে রইলেন মহিলাটি। কিংশুক বলল
-    আপনি যদি ওকে কুকুরদের রেস্কিউ সেন্টারেও দিয়ে আসতেন।
-    রেস্কিউ সেন্টার কি?
-    এটা কুকুরদের অনাথ আশ্রমের মতো। যে সব কুকুরদের কোন মালিকানা নেই, হারিয়ে গেছে বা অসুস্থ তাই কেউ নিতে চায় না তাদেরকে আশ্রয় দেয় এরা। থাকতে দেয়, খেতে দেয়, ডাক্তার দেখায়। ওখান থেকে লোকজন বাড়িতে পোষার জন্যেও কুকুর নিয়ে যেতে পারে।
-    এরকম আছে নাকি এখানে?
-    হ্যাঁ দু-তিনটে আছে। আমি একবার একটা বাচ্চা কুকুরকেকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে দিয়ে এসেছিলাম ‘ডগ লাভারস’ নামের এক রেস্কিউ সেন্টারে।

কোজাগর বলল
-    হয়তো তোর মতো কেউ সেভাবে কুকুরটাকে রাস্তা থেকে ধরে ওরকমই কোন এক রেস্কিউ সেন্টারে দিয়ে এসেছে।
-    সেটাও হতে পারে অবশ্য।
-    চল তাহলে, সেগুলো ঘুরে খোঁজ নিয়ে আসি।

অফিসে ফিরে গিয়ে ওরা চট করে কম্পিউটারে দেখে নিল এই শহরের মধ্যে কটা রেস্কিউ সেন্টার আছে। সব কটার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার টুকে নিল। তারপর একে একে প্রত্যেকটাকে ফোন লাগাল। জিগ্যেস করল দিন তিনেকের মধ্যে কোন সাদা স্পিৎজ কুকুর ওরা উদ্ধার করেছে কিনা বা কেউ দিয়ে গেছে কিনা। ‘লাভ এন্ড কেয়ার ফর এনিম্যালস’ নামে একটা সংস্থা জানাল তারা একটা সাদা কুকুর পেয়েছে। ঐ সংস্থারই এক কর্মী কুকুরটাকে রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে তুলে এনেছে। মাথায় আর পায়ে চোট ছিল। এখন ওষুধ দেওয়ার পর অনেকটাই ভাল আছে। যদিও এখনও পায়ে ব্যান্ডেজ করা আছে। তক্ষুনি সবাই সাইকেল নিয়ে ছুটলো।

কুকুরটাকে ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে মনে হল এটাই জিমি। ‘জিমি’ বলে ডাকতেই কুকুরটা তাকিয়ে দেখল। লেজও নেড়ে নিল একটু। তখন তারা একদম নিশ্চিত হল। মুখে হাসি ফুটে উঠল সবার। কাবেরী ফোন লাগাল মিহিরবাবুকে। সব কথা শুনে মিহিরবাবু বললেন
-    তোমরা ওখানেই থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি।
বাইক নিয়ে আধঘন্টার মধ্যেই এসে হাজির হলেন তিনি। ওনাকে দেখেই জিমি তার খোঁড়া পা নিয়েই ছুটতে ছুটতে এসে লাফাঝাঁপি শুরু করে দিল। মিহিরবাবু তাকে কোলে নিয়ে কেঁদেই ফেললেন।
 
কেকা বলল
-    কুকুরদের প্রতি এমন ভালোবাসা পড়ে যায়। যেন ওরা বাড়িরই একজন সদস্য। যাক বাবা শেষ পর্যন্ত জিমিকে খুঁজে পাওয়া গেল।
 
মিহিরবাবু বললেন
-    আমি তোমাদের আন্ডার এস্টিমেট করেছিলাম। তোমরা তো দেখছি খুব কাজের ছেলেমেয়ে। চলো আমার বাড়ি চলো। খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি যাবে। তোমরা যে আমার কতো বড় উপকার করলে তা তোমরা জানো না।

কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান




সবাই মিলে খুব হৈ হৈ করতে করতে চলল মিহিরবাবুর বাড়ি। কোজাগরের মুখে শুধু হাসি নেই।
-    তোর মুখ ব্যাজার কেন রে। আমরা আমাদের ফার্স্ট প্রজেক্ট এত ভালোভাবে কমপ্লিট করলাম। তুই খুশি হলি না?
-    কিন্তু কুকুরটার পা ভাঙ্গলো কি করে? সেটা তো বুঝতে পারছি না। আর চাবিটাই বা কোথায় গেল?
কাবেরী বলল
-    চাবিটা অত ইম্পর্টেন্ট নয়। মিহিরবাবুর মার অনেক বয়স হয়েছে। নিশ্চয় কোথাও রেখেছেন যত্ন করে। তারপর ভুলে গেছেন। বা খাট থেকে পড়ে গেছে নিচে।
-    তাহলে আমরা খাটের তলাটা সার্চ করে দেখলে পারি তো?
-    দেখা বেশ অসুবিধেজনক। সেদিন আমি নিচু হয়ে খাটের তলাটা দেখেছিলাম। কতো জিনিস যে জড়ো করা আছে? অত কিছু বার করা বেশ ঝামেলা।
কিংশুক বলল
-    ঝামেলা হলেও আজ আমরা একবার চেষ্টা করে দেখতেই পারি। ওখানে থাকব তো অনেকক্ষন। সময়ের অভাব হবে না।
কোজাগর আবার ফিরে এলো সেই পুরনো প্রশ্নে।
-    কিন্তু কুকুরটার পা ভাঙ্গলো কি ভাবে? এমন নয় যে ও ছাদে উঠেছিল। ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেছে?
-    শুধু শুধু পড়তে যাবে কেন? ছাদে তো পাঁচিল আছে।

মিহিরবাবুর বাড়িতে পৌঁছে কলিং বেল বাজানো হল। ওনার মা খুলে দিলেন। কুকুরকে ফিরে পেয়ে বাড়ির সবার আনন্দ আর ধরে না। মিহিরবাবু বললেন
-    সুমিতা। এদেরকেও ধরে আনলাম। এরা না থাকলে জিমিকে আমরা খুঁজে পেতাম না। ‘ডিকিজ কিচেন’-এ ফোন করে আমাদের সবার জন্যে চাউমিন আর চিলি চিকেন অর্ডার করো। এরা খেয়ে তবে বাড়ি যাবে।

জিমি ঐ খোঁড়া ব্যান্ডেজ করা পা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে নামছে। সবার কাছে আদর খাচ্ছে। বাড়ি ফিরে এসে ওরও যে কত আনন্দ হচ্ছিল তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।

কাবেরী মিহিরবাবুর মাকে বলল
-    আচ্ছা দিদা আপনি সেই চাবীটা এখনো খুঁজে পাননি তাই না?
-    না ওটা আর পাওয়া গেল না। কিন্তু জানো আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি খবরের কাগজের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

কিংশুক বলল
-    আপনার খাটের তলাটা আমরা একটু খুঁজে দেখতে পারি? যদি পড়ে গিয়ে থাকে।
-    দেখো না। কিছু অসুবিধে নেই।

মিহিরবাবুর কাছ থেকে একটা টর্চ চেয়ে নিল ওরা। তারপর খাটের তলা থেকে সব টেনে বার করে টর্চ দিয়ে তন্নতন্ন করে দেখল ভেতরটা। না, চাবি খুঁজে পাওয়া গেলনা।

এমন সময় একটা কাক হঠাৎ জানলায় কার্নিসে বসে বেজায় কা কা করে চীৎকার আরম্ভ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে জিমি কোথা থেকে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানলায়। পারলে কাককে এক্ষুনি আক্রমন করে। আর কাকটা এই দেখে ভয় পেয়ে উড়ে গেল। জিমিও ছুট দিলো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে।
কোজাগর বলে উঠলো
-    ঠিক ঠিক। আমি এই বার বুঝতে পেরেছি জিমির পা ভেঙ্গেছিল কি করে।
-    কি করে?
সবাই অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে।
-    তোরা চল আমার সঙ্গে ছাদে।
চার বন্ধুতে হুড়মুড়িয়ে ছাদে ওঠে। দেখে ছাদের পাঁচিলের গায়ে সামনের দু’পা তুলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিমি চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কাকটা উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে বসে সমানে কা কা চীৎকার করে চলেছে।

কোজাগর ওখানে দাঁড়িয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষন করল। তারপর চেঁচিয়ে উঠলো
-    ঐ যে ঐ দেখ ঐ বাড়িটার পাশে যে পেয়ারা গাছটা আছে তার একটা ডালে কেমন চাবিটা ঝুলছে। কাক ব্যাটা সেদিন সবাই ঘুমাচ্ছে দেখে নিশ্চয় জানলা দিয়ে ঢুকে এসে চাবি নিয়ে পালাচ্ছিল। আর ওকে পিছু করতে গিয়ে জিমি ছাদে উঠে এসেছিল। তারপর কাক ধরার জন্যে ঝাঁপ মেরেছিল। তাতেই পড়ে গেছে। তারপর মাথায় চোট লাগায় বাড়িও চিনতে পারে নি বেচারা। রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে থাকবে। পায়ের ব্যাথাতেও কাবু হয়েছিল নিশ্চয়। এপাশে কাকের মুখ থেকেও চাবিটা ফসকে পেয়ারা গাছে পড়েছে। আর সেই ডালেই ঝুলে রয়েছে সেদিন থেকে।

চাবি ও কুকুর দুই-ই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল। তারপর খাওয়া হল জমিয়ে। মনের আনন্দে ওরা ফিরে গেল যে যার বাড়ি।

একসপ্তাহ পরে ওদের অফিসের ঠিকানায় ‘কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান’-এর নামে একটা পার্সেল এলো। খুলে দেখা গেল চারজনের জন্যে চারটে হাতঘড়ি পাঠিয়েছেন মিহিরবাবু। পারিশ্রমিক হিসেবে নয়। ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার উপহার হিসেবে। ওদের প্রথম রোজগার।

 

 

রুচিরা
বেইজিং, চীন