খেলাঘরখেলাঘর

ভূত বন্ধু

 

ভূত বন্ধু

ভূত ব্যাপারটা কি তোমরা বিশ্বাস করো? ভূত বলে কি কিছু একটা আছে? ছোটবেলায় তো কত রকমের ভূতের গল্প পড়েছ – মা ঠাকুমার কাছে নানা ধরনের গা ছমছম করা ভূতের গল্প শুনেছ। আর গ্রামের ছেলে হলে তো কথাই নেই – ঘরের কিংবা বাড়ির আনাচে কানাচে, বাগানে, সন্ধ্যে হলেই অনেক ছায়া ছায়া ভূতকে ঘুরতেও দেখেছ – তাই না? আমাদের ছোটবেলায় তো আমরা অনেক রকম ভূতকে জানতাম, যেমন ধরো – ব্রহ্মদত্যি বেল গাছের ডালে খড়ম পায়ে উবু হয়ে বসে গুড়ুক গুড়ুক করে থেলো হুঁকোতে তামাক খায় – ইয়া বড় বড় দাঁত – গলায় মোটা পৈতে – মাথার লম্বা টিকিতে গাঁদা ফুল ঝুলছে; রোগা সিড়িঙ্গে গেছো ভূত সড়াৎ করে সুপুরি গাছের মাথায় উঠে মেজাজে পা দোলায় আর গাছের নিচে দিয়ে রাত্রে কেউ গেলেই পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরে; একানড়ে তাল গাছের মত খাড়া আর এক ঠেঙ্গা লম্বা – এক মাথা ঝাকড়া চুল – কপালের মাঝখানে একটাই গোল চোখ অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলে; শাকচুন্নী লাল কালো চৌকো কাটা গামছা গায়ে বিল অথবা জলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে পুঁটি মাছ ধরে সেগুলোকে কাদায় পুতে রাখে পচা পুঁটি মাছ খাবে বলে; স্কন্ধকাটার মাথা নেই – চোখ দুটো বুকের মধ্যে – সন্ধ্যের পর যখন তখন বাঁশবনের ধারের রাস্তা দিয়ে দৌড়ায় বাচ্চাদের ধরার জন্য; মামদো ভূত আধো অন্ধকারে লোক জনকে উটকো ভয় দেখিয়ে আনন্দে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে বিটকেল আওয়াজে হাসতে থাকে; পেত্নী সন্ধ্যেবেলা বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে থেকে থেকে খোনা গলায় পান্তাভাত খেতে চায়; আরো কত ধরনের ভূত আর এই ভূতেদের সংসারে ব্রহ্মদত্যি হলো সব থেকে সম্মানিত ভূত। তোমরা, আজকালকার কচি কাঁচারা, জানোও না বাঙ্গালী ভূত পরিবারের ইতিহাস – শুধু জানো বিদেশী ভূতেরা ঝুল ঝাড়নে চেপে ঘুরে বেড়ায়, নানা রকম চেহারাতে সবাইকে ভয় দেখায় আর নয়তো ছোট্ট সুন্দর ভূত ক্যাসপার বাচ্চাদের সাথে খেলতে আর মজা করতে ভালোবাসে – টিভিতে এই সব ভূতেদের গল্প কমিকই তো তোমরা দেখো। শহরে মাঝে মাঝে পড়ো বাড়িতে ভূতের খবর পাওয়া যায় কিন্তু একটু স্থিতু হবার আগেই প্রোমোটারের ভয়ে বেচারিদের পালিয়ে যেতে হয়। সত্যিই ভূতেদের দিনকাল আজকাল খুবই খারাপ যাচ্ছে – ওদের আর থাকার বিশেষ জায়গা নেই, ঘোরা ফেরা করার উপায় নেই। এই রকমই এক মনমরা ভূতের সাথে ঘটনা চক্রে আমার একবার দেখা হয়েছিলো – ওদের দুঃখের কথা শুনলে তোমাদেরও কষ্ট হবে।

আমার জীবনের প্রথম চাকরি ছিলো মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের – নতুন বলে কোম্পানি শহরে জায়গা দেয় নি – পাঠিয়ে দিয়েছিলো গ্রামে গঞ্জে ডাক্তারদের ফ্রি স্যাম্পলের লোভ দেখিয়ে বিক্রী বাড়ানোর জন্য। বেশীর ভাগ জায়গাতেই যাতায়াতের জন্য সাইকেল রিক্সা আর না হলে ভ্যান রিক্সা। এই ভাবে ভবঘুরের মত ঘুরতে ঘুরতে একটা গঞ্জে এসে হাজির হয়েছিলাম। রাতে থাকার মত হোটেল বলতে তেমন কিছু নেই – এক খাবার হোটেলে অনুরোধ করতে ওরা দোতলার একটা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে বললো, ঘরটা অনেক দিন ব্যবহার হয় নি – একটু ম্যানেজ করে নিতে হবে। পুরাতন খাড়া কাঠের সিঁড়ি – প্রতি ধাপেই ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ করে। ওপরে গিয়ে দেখি ঘরটা অনেক দিন নয় বেশ কয়েক বছর বোধ হয় ব্যবহার হয় নি – চারদিক ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরা। একটা নেওয়ারের খাট আর নড়বড়ে কাঠের টেবিল ও চেয়ার – দেওয়াল আলমারিটার একটা পাল্লা কব্জা থেকে খুলে ঝুলছে। ঘরে আলোর ব্যবস্থাও নেই – হ্যারিকেন জ্বালাতে হবে। এক রাতের মাথা গোঁজার জন্য ওখানেই যতটা সম্ভব ঝাড়া ঝাড়ি করে শোবার মত ব্যবস্থা করতে হলো। রাতে নিচের হোটেলে খেয়ে একটা হ্যারিকেন নিয়ে ওপরে এসে খুব সাবধানে চেয়ারটায় বসলাম যাতে ভেঙ্গে না যায়। হ্যারিকেনের আলোতে ঘরে আলো থেকে ছায়ার খেলাই বেশী। চুপচাপ বসে ভাবছিলাম কালকে কোনদিকে যাওয়া যায় হঠাৎ শুনি কোথা থেকে বাচ্চা কুকুরের কুঁই কুঁই-এর মত আওয়াজ আসছে – ভাবলাম কুকুরের বাচ্চাটা নিচে দোকানে না হলে রাস্তায় হবে। আওয়াজটাকে পাত্তা না দিয়ে আস্তে করে নেওয়ারের খাটে পা তুলে যতটা সম্ভব আরাম করে বসার চেষ্টা করতে চেয়ার ও খাট দুটোই মনে হলো একটু প্রতিবাদ করলো। এবার ওই কুঁই কুঁই আওয়াজটা একটু জোরেই এলো – কে যেন নাকি সুরে কাঁদছে আর আওয়াজটা আসছে দেওয়াল আলমারির ভেতর থেকেই। এবার কৌতুহল মাথা চাড়া দিলো – তবে একটু ভয়ও হলো, কি জানি গ্রাম গঞ্জের ব্যাপার – কিসে থেকে কি হয়! হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে জোরে গলা খ্যাঁকারি দিয়ে বললাম,
‘কে রে ওখানে কুঁই কুঁই করে?’