খেলাঘরখেলাঘর

 

ভূত বন্ধু

 

সাথে সাথে কান্না থেমে গেলো, কে যেন কাঁপা কাঁপা খোনা গলায় বললো,
‘আঁলোঁটাঁ কঁমিঁয়েঁ দাঁও – চোঁখেঁ লাঁগঁছেঁ – আঁমিঁ ভূঁতঁ।’
গলা শুনেই বুকের ভেতরটা ভয়ে গুড় গুড় করে উঠলো তবে বাইরে খুব সাহস দেখিয়ে রাগের ভান করে বললাম,
‘তা আলমারির ভেতরে বসে কেঁদে যাচ্ছো কেন? জ্বালাতন করার আর জায়গা পেলে না? সারা দিন খেটে খুটে এসে একটু ঘুমাবো তারও উপায় নেই দেখছি।’
[এর পরে ভূতের কথা বার্তায় এত চন্দ্রবিন্দু দিলে ছাপাখানার অসুবিধা হবে –          ওটা তোমরাই বসিয়ে নিও]
‘এত বছর পর ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ভাবলাম তুমি আমাকে ধরতে এসেছো – সেই ভয়ে আমার কান্না পেয়ে গেলো।’
‘আমি জানতামই না তুমি এখানে আছো।’
‘তুমি মনে হচ্ছে বাইরের লোক তাই বোধহয় জানো না। কিছুদিন হলো এক ওঝা এখানে এসে ভূত ধরার ব্যবসা শুরু করেছে – ধরতে পারলেই ভালো পয়সা। ও ব্যাটা কি করে যেন টের পায় কোথায় আমরা লুকিয়ে আছি। তারপর মন্ত্র পড়ে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে খালের জলে ফেলে দেয়। আমি কোন রকমে পালিয়ে এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছি – একটু যে বাইরের হাওয়ায় ঘুরবো তারও উপায় নেই। একা এই আলমারিতে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।’
‘তা তুমি অন্য কোন জায়গায় পালিয়ে গেলে না কেন?’
‘কোথায় যাবো বলো? আমাদের ভূতেদের সেই রবরবা তো আর নেই – এখন গ্রামে গঞ্জে সব জায়গায় ইলেকট্রিকের আলো জ্বলে – এত আলো আমাদের সহ্য হয় না। তাছাড়া এক কালে লোক জনকে ভয় দেখিয়ে বেশ আনন্দেই দিন কাটতো – এখন বাচ্চা ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত ভূতের কথা শুনলে হাসে – কোন পাত্তাই দেয় না – আসলে ওরা তো বাঙ্গালী ভূতের কথা জানেই না। এ রকম নিরানন্দ ভূতের জীবন কি ভালো লাগে।’
‘তা হলে আর কী করবে বলো। আপাততঃ তুমি আলমারির মধ্যে ঢুকে যাও। কালকে আমার অনেক কাজ – একটু ঘুমাতে দাও, কাল রাতে আবার কথা হবে। তবে কুঁই কুঁই করে একদম কাঁদবে না আর কোন রকম বদমাইসি করার চেষ্টাও করো না।’
পরেরে দিন এখানকার ডাক্তারদের পেছনে ঘুরেই সময় গেলো। এই সব গ্রাম গঞ্জের ডাক্তারদের মধ্যে কত জন সত্যিকারের ডাক্তার বলা মুস্কিল – নামের শেষে এক গাদা লেজুড় লাগিয়ে রেখেছে কিন্তু তা এ্যালোপ্যাথি না হোমিওপ্যাথি না আয়ুর্বেদিক কে জানে। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে রাতের খাওয়া শেষ করেই ঘরে ফিরলাম। সারাদিনের চক্করে আর ডাক্তারদের সাথে ভ্যানর ভ্যানর করে ভূত ব্যাটার কথা মনেই ছিলো না। হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে আরাম করে বসতেই খেয়াল হলো বাবা জীবন তো ঘরেই আছেন।
‘কৈ হে – কোথায় গেলে?’
‘এই যে, আমি তোমার অপেক্ষাতেই আছি। কালকে তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে – অনেক দিন পর কথা বলার সঙ্গী পেলাম।’ 
‘দ্যাখো বাবা, আমাকে আবার ভূত বানিয়ে দিও না।’
‘কি যে বলো! সবাই বলে ভূতে ঘাড় মটকায় – আদপেই তা নয় – আমরা একটু ভয় টয় দেখাই এই পর্যন্ত। আমাদের দেখতে পায় না বলেই লোকে এত ভয় পায়। তা ছাড়া বদনামটা হয়েছে শুধু এই ছিঁচকেমি আর পেছনে লাগার জন্যই।’
‘আমি কিন্তু কালকে ভোরে উঠেই ভোঁ কাট্টা - একটু দূরের একটা শহরে যেতে হবে। আমার কাজই এই – সারা বছর ঘুরে বেড়ানোর – কোথাও একটু স্থিতু হয়ে বসার উপায় নেই। তুমি তো এই ঘরেই থেকে যাবে, তাই না?’
‘কালকেই চলে যাবে? আবার একা একা মনমরা হয়ে আলমারিতে পড়ে থাকতে হবে। তারপর কোন দিন ওঝা ব্যাটা টের পেয়ে আমাকেও হাড়িতে ঢুকিয়ে খালে ফেলে দেবে – ও তো ভূত ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। (একটু চিন্তা করে) আমাকে একটু সাহায্য করবে?’
‘বলে ফ্যালো – পারলে করবো।’
‘আমাকে নিয়ে চলো না তোমার সাথে। তুমি তো একা একাই ঘোরো – গল্প টল্প করতে পারবে অবসর সময়ে – আমিও ওঝার হাত থেকে বেঁচে যাবো। তোমার ওই ঝোলা ব্যাগের মধ্যেই ঢুকে যাবো – কেউ টেরও পাবে না।’
‘হ্যাঃ, আমি সারা জীবন একটা ভূতকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। টের পেলে জনতা তো আমাকে পিটিয়ে ভূত বানিয়ে ছাড়বে।’
‘না না, আমি কথা দিচ্ছি কেউ টেরই পাবে না। আর সুবিধে মত জায়গা পেলে আমি নিজেই চলে যাবো।’
‘বুঝলাম - এতে তোমার তো জান বাঁচবে - কিন্তু আমার কি লাভটা হলো?’
‘দ্যাখো, আমরা একেবারে ফ্যালনা নই – আমাদেরও কিছু কিছু গুণ আছে। আমি হয়তো তোমার সাহায্যও করতে পারি – তাছাড়া পাহারাদারের কাজও করবো। কথা দিচ্ছি কোন রকম নষ্টামি করবো না – আমাদের কথা কিন্তু খুব পাক্কা।’
ভূতের কথাটা মনে ধরলো – একটু মজাও লাগছিলো একটা সত্যিকারের ভূতকে ব্যাগের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো বলে – তাছাড়া আমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না ওকে নিয়ে ঘুরতে। এতে ওর যদি কোন উপকার হয় তো ভালোই। যেখানে সুবিধা মত জায়গা পাবো সেখানে না হয় ছেড়ে দেবো।
‘ঠিক আছে, তুমি আমার ঝোলা ব্যাগটাতে ঢুকে যাও – তারপর দেখা যাবে কি হয়। তবে বুঝবো কি করে তুমি ব্যাগে আছো কি না?’
‘তুমি ব্যাগের ওপর টোকা মারলেই আমি তোমার হাতে টোকা দেবো।’
সকালে উঠে চা টা খেয়ে ব্যাগটা ঘাড়ে নিলাম তারপর আস্তে টোকা দিতে আমার হাতেও টোকা লাগলো। একটা সাইকেল রিক্সা ধরে বাস ষ্ট্যান্ডে এসে একটু ছায়া দেখে দাঁড়ালাম বাসের জন্য। বুঝি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম হঠাৎ ভূত বললো,
‘বাস আসছে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাও – বসার জায়গা পাবে।’
খেয়াল করি নি যে বাস আসছে – তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম – না হলে কম পক্ষে ঘন্টা দুয়েক দাঁড়াতে হতো। ধীরে ধীরে ভূতের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। একা একা থাকার বিরক্তিটা আর ছিলো না – বিশেষ করে রাত্রে বেশ গল্প করেই সময় কেটে যেতো। হিসেব করে দেখলাম ওর মানুষ আর ভূত জীবন মিলিয়ে বয়সে প্রায় আমার সমানই। এর মধ্যে দুবার আমাকে খুব বাঁচিয়েও দিয়েছে। একবার রাস্তা পেরুবার সময় খেয়াল করি নি উলটো দিক থেকে আসা একটা ট্রাককে – ভূত না বললে ধাক্কা খেয়ে হাসপাতালে যেতে হতো। আর একবার গ্রামের আধো অন্ধকার রাস্তায় হাঁটার সময় দেখতে পাই নি কাল কেউটে সাপটাকে ঝোপের পাশে – একটু হলেই লেজে পা পড়তো। হঠাৎ দেখি সাপটা আমার সামনে হাওয়াতে দোল খাচ্ছে – ভূত ওটার লেজ ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে।         এর কিছুদিন পরে হঠাৎই হেড অফিস থেকে চিঠি – ভয়ে ভয়ে খুললাম – কি জানি চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিলো কি না। দেখি কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার আমার কাজের প্রশংসা করে জানিয়েছেন আমার প্রমোশনের কথা। আর গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে হবে না – শহরের অফিসেই বসতে হবে তবে খোদ কলকাতাতে নয় – একটা মাঝামাঝি ধরনের মফস্বল শহরে। ভূতকে রাত্রে বললাম,
‘তোমার জন্যই হয়তো আমার কপাল ফিরেছে না হলে এত তাড়াতাড়ি কাউকেই প্রমোশন দেয় না। এবার আমাকে শহরের অফিসেই বসতে হবে।’
ভূতের মনে হলো মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো।
‘বন্ধু, এবার আমাকে কোথাও ছেড়ে এসো। শহরের আলো আর ভিড়ে তো আমি থাকতে পারবো না।’
ভূত যে চলে যাবে এটা আমার মাথাতেই ছিলো না – ও আমার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে – মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তারপর ভাবলাম ওই মফস্বল শহরে তো কলকাতার মত আলো, ভিড় ভাট্টা নেই তাহলে ভূত বন্ধু কেন থাকতে পারবে না।