‘দ্যাখো, আমার মনে হয় তুমি আপাততঃ আমার সাথেই চলো – ওখানে সত্যিই যদি তোমার ভালো না লাগে তা হলে না হয় তোমাকে অন্য কোথাও ছেড়ে আসার কথা ভাববো। আসলে কি জানো, আমাদের প্রায় বছর খানেকের এই মেলা মেশাতে তুমি আমার খুব কাছের লোক হয়ে গিয়েছো – তোমার সাথে গল্প করে সন্ধ্যেবেলা গুলো বেশ ভালোই কেটে যায় তার ওপর তুমি তো আমাকে অনেক ভাবেই সাহায্য করেছো তাই তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ঠিক মন চাইছে না।’
‘আমারও তাই – তোমাকে ছেড়ে কি ভাবে আবার একা একা থাকবো সেটাই চিন্তা করছিলাম। ওই শহরে অন্য কোন ওঝার দৌরাত্ম্য মনে হয় থাকবে না তাই একটু স্বাধীন ভাবেই থাকতে পারবো। ঠিক আছে চলো শহরে গিয়েই দেখা যাক।’
মফস্বল শহরটা খুব একটা বড় নয় – হাজার পঞ্চাশেকের মত লোকের বাস তাই ওখানকার অফিসটা ছোটই। শহরের একটু বাইরের দিকেই বাড়ি নিলাম যাতে ভূত বন্ধুর কোন অসুবিধা না হয় – ওখান থেকে সাইকেলেই অফিস যাতায়াত করতে পারবো। ছোট খাটো আলাদা বাড়ি বেশ বড় একটা আম বাগানের গা ঘেঁসে আর পেছন দিকে ধান ক্ষেত। বাড়িটা পাবার আগে কয়েক দিন ওকে ঝোলার মধ্যে নিয়েই অফিসে যেতাম তবে সারা দিন বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো যদি কোন কারণে কেউ টের পেয়ে যায় তা হলে কি হবে? তা ছাড়া ঘাড়ে ঝোলা নিয়ে অফিসারকেও ঠিক মানায় না – প্রথম দিনই অফিসের দু-একজন ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিলো যেন কোথা থেকে এই ঝোলা ঘাড়ে গেঁয়ো ভূত এসে জুটলো। বাড়ি দেখে ভূত বন্ধু খুব খুশি –
‘এই বাড়ি সব দিক দিয়ে খুব ভালো – আমি সারাদিন ওই আম বাগানে খোলা বাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারবো। এত দিন ধরে ওই ঝোলার মধ্যে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম – তাছাড়া তোমাকেও আর সারাদিন আমার জন্য অস্বস্তিতে কাটাতে হবে না।’
আমি অবশ্য ওকে একটু সাবধান করে দিলাম,
‘দ্যাখো, স্বাধীনতার আনন্দে সব ভুলে আবার তোমাদের নষ্টামী মানে লোক জনদের ভয় দেখানো শুরু করো না – তাহলে লোকে বুঝতে পেরে আবার কোন ওঝা নিয়ে আসবে।’
‘আরে না না – ওঝার যা তাড়া খেয়েছি আর ওসব ব্যাপারে নেই - আমি খুব ভালো ভূতের মতই থাকবো। আশে পাশের কেউ টেরটিও পাবে না যে আমি এখানে আছি।’
পরদিন ওকে বাড়িতে রেখেই অফিস গেলাম তবে সারা দিন মনের মধ্যে একটু খচ খচ করতে লাগলো যদি ওর কোন অসুবিধা হয় অথবা এত দিন পর হঠাৎ ছাড়া পেয়ে কোন নষ্টামী না করে বসে সেই চিন্তায় তবে সব থেকে বড় বাঁচোয়া ওকে কেউ দেখতে পাবে না। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এসেই হাঁক পাড়লাম,
‘কোথায় বন্ধু? আজ দিনটা কেমন কাটলো?’
‘বুঝলে আজ পুরো এলাকাটা খুব সাবধানে ঘুরে দেখলাম – মনে হয় ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। আম বাগানে খুব ভালো জাতের আমের সব গাছ আর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সারা দুপুর ওখানেই সব থেকে বড় গাছের মগডালে বসে আরাম করেছি। এত দিন পর বাইরের খোলা হাওয়াতে ঘুরে খুব ভালো লাগছে।’
ভূত বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে চা বানাচ্ছিলাম আর ও চায়ের কৌটো, চিনির কৌটো এই সব এগিয়ে দিচ্ছিলো – বাইরের কেউ দেখলে নির্ঘাৎ ভির্মি খাবে কারণ ভূত বন্ধুকে দেখা যায় না বলে মনে হবে কৌটো গুলো হাওয়াতে ভেসে ভেসে আসছে।
‘জানো, দুপুরে একবার আমাদের ডান পাশের বাড়িতে ঢুকেছিলাম হাল চাল দেখতে।’
শুনেই আমি চমকে উঠলাম – কাপের চা ছলকে উঠলো।
‘ঠিক কোন বদমাইসি করেছো?’
‘আরে তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন – আমি তো কথা দিয়েছি কোন দুষ্টামী করবো না। আসলে খুব সুন্দর রান্নার গন্ধ বেরুচ্ছিলো তাই ওদের রান্নাঘরের জানালাতে বসে দেখছিলাম বাড়ির মহিলা কি রান্না করছেন। রান্নার ধরন আর গন্ধতেই মনে হলো মহিলার হাতের রান্না খুব ভালো। মাছের মুড়ি ঘন্ট বানিয়েছিলো ভালো গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে – কি সুন্দর তার গন্ধ তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না - আমি পুরোটা শিখে নিয়েছি – এই রবিবারে বড় দেখে মাছের মুড়ো নিয়ে এসো তারপর আমি বলবো আর তুমি বানাবে। ভেবেছিলাম একটু খানি তোমার জন্য নিয়ে আসি তবে তুমি যদি রেগে যাও তাই আনি নি।’
‘খুব ভালো করেছো আনো নি – মহিলারা চট করে বুঝতে পারে বাটিতে কেউ হাত দিয়েছে কিনা। পরে বেড়ালে মুখ দিয়েছে বলে হয়তো এত কষ্টের রান্না ফেলেই দিতো। ঠিক আছে একদিন বানানো যাবে না হয় তবে তুমি তো খেতে পারো না – আমার একা একা খেতে মোটেই ভালো লাগবে না।’