খেলাঘরখেলাঘর

কুটুস ও ভিখারি

 

বিরাট বড় ফুটবল মাঠের মত,চারিদিকে পাকা দেওয়াল দিয়ে জাগাটা ঘেরা। তার মধ্যে এক কোনায় তিন চারটে ঘর,ঘরগুলি দেখলে অনেক পুরনো মনে হয়.বাইরে থেকে একটা ঘরে খুব
কম পাওয়ারের আলো দেখা যাচ্ছিল। বিশ্বনাথ কুটুসকে কোলে নিয়ে আলো জ্বালা ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে গেলো.দরজা ধাক্কা দিয়ে চাপা স্বরে ডাকতে লাগলো,জগুভাই! জগুভাই!

দু তিনবার ডাক দেবার পর ঘরের ভিতর থেকে 'কৌন?' বলে খুব গম্ভীর আওয়াজ এলো!
--আমি বিশ্বনাথ,দরবাজা খোলো,সাহাব!বিশ্বনাথ বলে.
এ এলাকা রাত দশটা বাজতে না বাজতেই ঝিমোতে থাকে,চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে,--
দুরে দু চারটে ঘরে--টিম টিম করে আলো জ্বলছে,দেখলেই মনে হয় জায়গাটা মুম্বাই মহানগর থেকে অনেক বাইরে। ঘড়.র.র..করে দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেলো.সামনে দাঁড়িয়ে ভীম নাথ,
দলের সাগরেদ.জগু দলের স্থানীয় ম্যানেজার,এখানকার সমস্ত কাজের দযিত্ব ওর ওপর। তারই হেলপার ভীম।
--অন্দর আ যা,ভীম চাপা স্বরে বলে ওঠে।
কাঁধে ঘুমন্ত কুটুসকে নিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে বিশ্বনাথ।জগু এগিয়ে আসে,বলে,
কিরে জিন্দা হায় না?ছোট্ট কুটুস ওদের কথাবার্তায় ঘুমের মধ্যে একবার চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করে,আবছা অন্ধকারে কাউকে চিনতে না পেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে.
--লেড়কা জিন্দা হায়,দেখ লিয়া না?বলে বিশ্বনাথ। অব মেয় জাউংগা,মেরা পয়সা দে দো  সাহাব!।

জগু টাকা এনে বিশ্বনাথের হাতে দিল। বিশ্বনাথ ছেলে পাচারের পাঁচ হাজার টাকা হাতে নিয়ে কুটুসকে ঘরের খাটিয়াতে শুইয়ে
দিয়ে বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হোয়ে গেলো।

সকাল থেকে কুটুসের হাত মুখ বাঁধা,মুখে কাপড় ঠুসে দেওয়া,যাতে ও চীত্কার করতে না পারে।বড় বড় ষন্ডা গুন্ডা মার্কা লোক এঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে । দীনু,অংকু,ভীম, আনোয়ার এমনি সব নাম ওদের ।এর মধ্যে আনোয়ারের কাজ সব পঙ্গু ছেলে মেয়েদের
সকাল বেলা নিয়ে গিয়ে ভীড় হওয়া রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করার জন্য বসিয়ে আসা । দিন ভর ওরা ভিক্ষা করে,আবার সন্ধ্যের পর আনোয়ার ওদের ঘরে নিয়ে ফেরে । ওদের পাওয়া টাকা পয়সার নব্বই পার্সেন্ট যাবে মালিকের হাতে। বাকী দশ পার্সেন্টে এখানকার কাজ কর্ম চলে.সবার মাইনে,অন্যান্য সমস্ত খরচ। এখানকার মালিককে একমাত্র জগু বলে লোকটাই চেনে। আর কেউ নয়। বাচ্চাদের হাত পা,জীভ কেটে পঙ্গু তৈরী করার কাজ ভীম,দীনু,অংকু ওদের ওপর দেওয়া আছে।

কুটুস গোঁ গোঁ করে চীত্কার করার চেষ্টা করছিল,ভীম এসে তার মাথায় জোরে থাপ্পড় মারলো.বাঁধন খোলার কত না চেষ্টা করছে কুটুস।  কিন্তু পারবে কেন ?জীবনে এত শক্ত বাঁধন পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারে সেটা কি ও কোনো দিন চিন্তা করতে পেরে
ছিলো!দু চোখ বেয়ে তার জলের ধারা বয়ে যেতে লাগলো । কতবার সে চীত্কার করে মা বাবার কাছে যেতে চাইল।কোনো শব্দই মুখ থেকে বেরোতে পারলো না। অংকু ভীমকে প্রশ্ন করে,কেয়া নাম উসকা--ইউ.পি.সে জো ছোকরা কো লায়া গয়া?
ভীম উত্তর দেয়,পরেশ নাম হায় উসকা।উসকা আজ তারিখ হায় না?তিন দিন পর আজ এক অংক জাদা হো যায়েগা--ছাব্বিশ হো যায়েঙ্গে।

পরেশকে অংকু,দীনু ওরা নিয়ে গেল,এক কোনার ঘরে। একটু পরেই ওই ঘর থেকে অস্ফুট কান্নার চাপা চীত্কার শোনা গেল । পরেশের জীভ কেটে দিল ওরা,অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ও অজ্ঞান হোয়ে গেলো,আবার ওর মুখে গুঁজে দিল কাপড়ের গোলা । জ্ঞান ফিরে ও যাতে চীত্কার করতে না পারে। পরেশ আর কোনো দিন কথা বলতে পারবে না।
এক মাস কেটে গেলো.ইতিমধ্যে তিনজন বাচ্চাকে শরীরের কোনো অংগ কেটে পঙ্গু বানানো হয়েছে । কুটুসের সময় আসবে--এমনি জল্লাদের দল ওকে নিয়ে যাবে--হাত পা কেটে ফেলবে--আর একদিন কুটুস বাটি হাতে করুণ ভাবে কেঁদে কেঁদে ভিক্ষা  চাইবে--খানা দে ,রোটি দে বাবু!গরীব কো এক পয়সা দে বাবু!...কুটুসের পঙ্গু চেহারা দেখে--হাত পা কাটা এইটুকু একটা ছেলেকে দেখে অনেকের দয়া হবে,পয়সা, কাপড় চোপর,খানা দেবে।

বসের ফোন এলো জগুর কাছে । একমাত্র জগুই এখানে মোবাইল রাখার যোগ্য।
বস বললো,ও ছোটা লেড়কা বশ মে আয়া?--রোনা ধোনা কম কিয়া?
--নেহী, সাহাব..এক দো দিন মে সব ঠিক হো যায়েগা,জগু বলে।
--বাহার সে এক সাহাব আয়েগা,মেরী চিটঠি লে কর,উস্ কে হাত মে লেড়কা কো দে দেনা,ও বিক গয়া। ও আদমী আগলে মাহ উসকো ফরেন লে যায়েগা ।শুন লিয়া না! বলে
বস ফোন রেখে দেয়.
--জী হাঁ--জগুর মুখ থেকে ভয় মাখা উত্তর বের হয়ে আসে।

মাস ঘুরে গেলো,কুটুসের মা বাবা দুঃখে ভেঙে পড়েছেন.মা তো প্রায় সব সময় ছেলের কথা মনে করে কাঁদতে থাকেন।বাবা রমেন ছেলে হারানোর শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রোজ অফিস যাচ্ছেন,ঘরে ফিরছেন আর চুপচাপ ঘরে বসে থাকছেন। এমনি একদিন অফিস থেকে ডিউটি পড়ল বিলাসপুর।দুদিন থাকতে হবে সেখানে।প্রথমে ভাবলেন যাবেন না তিনি,তারপর কি ভেবে যেন তাঁর মনে হলো,যাই একবার ঘুরে আসি-- সারা জবলপুরের অলিগলি সব জাগা তো দেখা হয়ে গেল--কে জানে অন্য কোনো জায়গায় অন্য কোনো পথে হঠাত যদি দেখা হোয়ে যায় কুটুসের সঙ্গে!

 

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।