২
পটাশ আর ফটাশ যে যমজ সে কথা কি আগেই বলেছি? দেখতে সহজ সাধাসিধে হলে কি হবে ভেতর ভেতর তারা যে কি পরিমান বিচ্ছু তার ধারনা পেলাম একটু পরেই। তাদের দুপুরের ইস্কুলের সাথে পড়াশুনোর কোন সম্পর্ক নেই, আদতে তা হচ্ছে গিয়ে রাজ্যের ডানপিটেমো করার অবাধ জায়গা আর সে শুধু তাদের দুজনেরই নয়, তাদের মত আরো একপাল ছেলেপুলের আড়ত। এই ইস্কুল বসে ইস্কুল বাড়িতেই, আর সেখানে কচিকাঁচাদের অভিজ্ঞরা বদমায়েসির নানা প্যাঁচ পয়জার শেখায়। ইস্কুলের চারদিকে পাঁচিল থাকলে কি হবে, সব্বাই পিছনের দিকে একটা ছোট্ট ফাঁক দিয়ে এসে ঢুকে পড়ে। কয়েকটা ক্লাসরুম খালি থাকে, কেউ সেখানে বোর্ডে চক দিয়ে খেলার মাঠের ছক বোঝায়, কেউ অন্য কোন রকমের ফন্দী বাতলায়।
পটাশ বা ফটাশ দুজনেই এই ইস্কুলের হর্তা কর্ত্তা আর কি। একজন ঢিল ছুঁড়ে টিপ করা শেখাচ্ছে, তো একজন গাছে চড়া। একজন গুলতি বানানো শেখায় তো আরেকজন তীর-ধনুক।
সত্যি কথা বলতে কি এক পলকেই আমার ভালো লেগে গেল দুপুরের ইস্কুল। কিন্তু সেই সঙ্গে একটু ভয়ও করল। বাড়িতে থাকতে কাউকে না বলে খেলতে যাইনি কক্ষনো, তাও সপ্তাহে তিনবার। বাকী সময়টুকু এই ঐ ক্লাস করতে কেটে যায়। এখানে এসে খেলে বেড়াচ্ছি এইসব খবর যদি বাড়িতে পৌঁছয় তবে কি হবে?
একটা সময় আমি পটাশকে আলাদা করে ধরে বললাম, ‘হ্যাঁ পটাশ, রে তোদের বাড়িতে বকবে না জানলে?’
সে একগাল হেসে বললে, ‘আরে আমি তো ফটাশ, এই দেখো মাঝের চুল গুলো খাড়া হয়ে রয়েছে!’ দুজন কে দেখতে তো হুবহু একরকম। খালি নাকি দুজনের চুল দুরকম। ফটাশের মাথার মাঝে খানিকটা চুল টিনটিনের মত উঁচু হয়ে থাকে। সত্যি থাকে না টিনটিনের গপ্প পড়ে এইরকম বানিয়েছে কিনা কে জানে, এই দুপুর রোদ্দুরে কারো চুল দেখে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই।
আমি বললাম, ‘আচ্ছা ফটাশ, তুইই বল বাড়িতে যদি জানে যে তোরা দুপুর বেলা ইস্কুল এসে এত হল্লা করছিস জানলে তোদের বাড়িতে বকবে না?
-‘সে কি বকবে কেন?’
-‘বাহ রে, বাড়ির ছেলেরা দুপুরবেলা এরকম হইচই কান্ড বাঁধাচ্ছে জানলে বকবে না? আর ইস্কুল থেকে যদি কমপ্লেন করে দেয়?’
-‘তুমিও যেমন! আমাদের তো বাড়ি থেকেই এইখানে পাঠায়। আর এসব তো আমাদের বাবা-কাকা তাদের বন্ধুরাও এককালে খুব করেছে। এখন আমরা করছি। বলি, ছেলের হইচই করবে না তো কি বুড়োরা করবে?’
উত্তর শুনে আমি তো থ। মনে মনে বললাম – তাও ঠিক। আমাকে তো বাড়িতে তেমন খেলতে দেওয়া হয় না। এক ঐ ইস্কুলের টিফিন, নইলে ইস্কুল বাস আসার আগে কিছুক্ষন। কতগুলো বিকেল অঙ্কের বই খুলে গালে হাত দিয়ে বসে কেটে গেছে। আজকে আর সেসব কিচ্ছু মনে রইল না। কিছুক্ষনের মধ্যে আমিও ওদের একজন হয়ে খেলায় মেতে উঠলাম। ঘামে জামা ভিজে চপচপ করছে, অথচ সেদিকে খেয়াল নেই।
বিকেল হতে না হতে বুঝলাম, আমার হাতে বেশ টিপ – তা সে গুলতি নিয়ে মাটির গুলিতেই হোক, কি ঢিল ছুঁড়েই হোক। একটা খেলা হচ্ছিল টিপ প্র্যাকটিসের। খেলা অনেক নিয়ম, অনেক কায়দা। প্রথমে সব্বাই কাছ থেকে ছুঁড়ে টিপ করবে। সেখানে যারা ঠিক ঠিক লাগাতে পারবে, তারা পরের রাউন্ডে আবার আরেকটু দূর থেকে টিপ করবে। এই খেলা আমি আগে কক্ষনো খেলিনি। তিন নম্বর রাউন্ডে ত্রিশ পা দূর থেকে যখন গাছ থেকে ঝোলা লেবু, টিনের ফলা আর কাচের বোতল সবকটাই লাগিয়ে দিলাম গুলতি ছুঁড়ে তখন দেখি চারপাশে হইচই পড়ে গেছে। কেউ বললে, ‘শাবাশ!’, কেউ বললে, ‘কেয়াবাত’, ‘কেউ বললে, এতদিন কোথায় ছিলে ওস্তাদ!’
সব্বাই এক এক করে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেল। সব দেখে শুনে আর নিজেকে বাইরের কেউ মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমিও ওদেরই একজন। বাবা মাকে ছেড়ে, নিজের বাড়ী ছেড়ে অন্য কোথাও আছি সে কথা মনেই নেই।
খানিক বাদেই দুভাই মিলে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চললে ফুটবল মাঠের দিকে। আমি বললাম, ‘এখন আবার কি?’
-‘আরে, আজকে ফুটবল ম্যাচ আছে যে!’
-‘তাই নাকি, এরপরে আবার ফুটবল খেলবি তোরা?’
-‘আরে শুধু আমরা কেন, তুমিও খেলবে। এও তো টিপ করে বল লাথানো ছাড়া তো আর কিছু নয়’
আমি ফুটবল আগে তেমন খেলিনি। আমাদের পাড়ায় একটাই ফুটবল মাঠ ছিল, সেখানেও এখন বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ফুটবল বাবার সঙ্গে বসে দেখেছি অনেক, কিন্তু মা বার বার বলে ফুটবল খেলতে নামলে নাকি পা ছড়ে যাবে, হাঁটু ঘুরে যাবে, গোড়ালি মচকে যাবে। কিন্তু আজকে যখন মাঠ ছেড়ে হই হই করতে বেরোচ্ছিলাম, ততক্ষনে জেনে গেছি আমার বাঁ পায়ে দারুন শট আছে। বলতে গেলে আমার গোলেই কিন্তু পটাশরা এই ম্যাচটা ৩-০ য় জিতল। ওদের ডিফেন্ডার মারকুটে মিনেশ যখন আমার মালাইচাকি লক্ষ্য করে একটা লাথি চালিয়েছিল, তখন দেখলাম কেমন নিজের অজান্তেই হালকা লাফে সেটা কাটিয়ে গেছি আর শুধু তাই ই নয়, আমার বাঁ পায়ের ছোঁয়ায় বলটা তখন ওদের গোলে লুটোপুটি খাচ্ছে।