খেলাঘরখেলাঘর

চিলাপাতার জঙ্গলে

নিত্যবাবু এই যুক্তি মানতে রাজি নন। আমাদের যেতে বারণ করেছিলেন বারবার। সে আপত্তিতে কান না দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি আমরা। বেশ কিছুটা গিয়ে অরণ্যের গভীরে বনদপ্তরের চেক পোস্টে আটকে গেল আমাদের জিপ। পথের ওপর লোহার চেন দিয়ে বাঁধা শাল গাছের গুড়ি। আনেক খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু বিট অফিসারের দেখা পাওয়া গেল না।

হেমন্তের সন্ধে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, জঙ্গলে ছায়া গাঢ় হছে। আমি একটা হাফহাতা সোয়টার পরেছি, তবুও বেশ শীত শীত করছে এখন। আমাদের পাশ দিয়ে ছলাত্ ছল শব্দ করে বয়ে যাছে একটি নদী। তার পাড়ে বনদপ্তরের একটা সবুজরঙা কাঠের বেঞ্চ। সেখানে বসে পদম বলল, এটা হল চিলাপাতার জঙ্গল। নদীর ওপারে ওই যে বন দেখছেন, ওটা জলদাপাড়া। শিলতোর্সা নদী আলাদা করেছে দুটো জঙ্গলকে।

আমি বললাম, গাড়ি যাওয়ার পথ তো বন্ধ। নলরাজার গড় এখান থেকে কতদুর ? হেঁটে যাওয়া যাবে না সেখানে ?

পদম বলল, আনেকটা হবে স্যার।

ইমন বলল, হাঁটতে হলে হাঁটব। এত কাছে এসেও ফিরে যাব নাকি ?

ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ওডোমস নিয়ে এসেছিলাম। মশার কামড় থেকে বাঁচার সেই মহৌষধ গায়ে লাগিয়ে জঙ্গল দিয়ে এগোচ্ছি। দূর থেকে একটা  অদ্ভূত শব্দ আওয়াজ এল একবার। একসঙ্গে আনেক ঘোড়া ডাকলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন। এক জায়গায় জঙ্গল একটু দোমড়ানো মনে হল। পদম দাঁড়িয়ে পড়ে চিন্তিত স্বরে বলল, দাগটা বেশিক্ষণ আগে তৈরি হয়নি। মনে হচ্ছে কোনও গন্ডার গিয়েছে এই পথ দিয়ে এক-দু'ঘন্টা আগে।

ইমন আমার পিঠে হাত রেখে বলল, জলদাপাড়ায় যে শান্তশিষ্ট গন্ডারটা দেখেছিলি সে মানুষের মুখ দেখে দেখে অভ্যস্ত। কচুরিপানা খেতে আসা হাতিরাও একরকম তাই। চিলাপাতার চারপেয়ে বাসিন্দারা কিন্তু ততটা নিরীহ নয়। কাজেই বি আ্যলার্ট রাহুল।

আমি ঢোঁক গিললাম। এমন নিশ্ছিদ্র জঙ্গল আগে দেখিনি কখনও। দিনের বেলাতেই আলো ঢোকে না ভালো করে। এই সন্ধেবেলা তো সে প্রশ্নই নেই। আমার হাতে একটা টর্চ। সেই টর্চ জ্বেলে জঙ্গল ভেঙে ভেঙে হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছি। খানিকটা হাঁটার পর অবশেষে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়েছি। পদম আঙুল তুলে বলল, ওই যে, ওটাই নলরাজার গড়।

সন্ধে ঢলে রাত নামছে ধীরে ধীরে। একফালি চাঁদ তার ফিনফিনে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে নলরাজার গড়ের ওপর। পুরনো আমলের স্থাপত্য, যার প্রায় কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই, ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। শুধু কিছু পুরানো ইঁটের দেওয়াল রয়ে গিয়েছে এখও। যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে আগাছা।

ইমন বলল, এই গড় থেকে কোচ সেনাবাহিনির সফল কামরূপ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চিলা রায়। সষ্কোশ থেকে কোচ রাজ্যের পরিধি বড়িয়েছিলেন সুদুর কামরূপ পর্যন্ত, আজ যাকে অসম রাজ্য বলে আমরা জানি। এখানে এসে আমার তো রীতিমত গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রে রাহুল।

 আমি উঁচু গলায় বললাম, ইমন, ওটা কি ?

খানিকটা দূরে ঝুঁঝকো মতো একটা গাছে ছেয়ে আছে জোনাকি। গোটা গাছটা ঢাকা পড়ে আছে হাজার হাজার হিরের টুকরোয়। আলোগুলো একবার জ্বলছে, একবার নিভছে। আরো গাছ আছে এ তল্লাটে, কিন্তু সে গাছগুলোতে জোনাকির বংশ পর্যন্ত নেই।

ইমন বলল, চল তো, কাছে গিয়ে ব্যাপারটা দেখি একবার।

হাজার হাজার জোনাকি জ্বলছে গাছটাকে ঘিরে। কাছাকাছি আসতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এল। ঠিক যেন তুবড়ি পোড়ার মত গন্ধ। আসংখ্য তুবড়ি যেন জ্বলছে কোথাও।

ইমন নাক কুঁচকে বলল, এ তো সালফারের গন্ধ। এখানে সালফার এল কোথা থেকে ?

তখনি কেমন শোঁ শোঁ একটা শব্দ আসতে লাগল দূর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে জোনাকিগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে গাছটাকে ছেড়ে উড়ে যেতে লাগল নলরাজার গড়ের দিকে।

পদম ফিসফিস করে বলল, ফিরে চলুন স্যার। কেমন গড়বড় লাগছে সব।

তিনজন ছুটছি। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম একবার। মুখের কাছটা ছড়ে গেল একটু। হাতের টর্চ ছিটকে গেল জঙ্গলের মধ্যে। টর্চ খুঁজে সময় নষ্ট না করে আবার দৌড়তে শুরু করেছি। জঙ্গল দিয়ে খানিকটা পথ আসার পর একটু উঁচু ফাঁকা জমি এসেছে। কী ভেবে পেছন ফিরে তাকিয়েছি। আমার গায়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। জিভ সহসা অসাড়, কাউকে ডাকব সে ক্ষমতাও বুঝি আমরা লোপ পেয়ে গিয়েছে। ইমন আর পদম গুটিগুটি এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। আমরা তিনজনই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি নলরাজার গড়ের দিকে।

আজস্র জোনাকি ঝাঁকে ঝাঁকে নলরজার গড়ের ঠিক মাঝখানটায় এসে কিছু একটা কেন্দ্র করে। হেমন্তের মিহি কুয়াশা একটা আবছা আড়াল তৈরি করেছে আমাদের চোখের সামনে। বুকের মধ্যে ধামসা মাদলের শব্দ হচ্ছে, চোখের পলক পড়ছে না আমাদের। রণ-পা চড়ে মানুষ যেমন হয়,  অল্পক্ষনের মধ্যেই ঠিক তেমনি বিরাট আদল তৈরি করে ফেলল জোনাকিগুলো।

এবার একটু স্পষ্ট হয়েছে সেই অতিমানবীয় অবয়ব। কালীপুজোর সময় আনেক পুজোমন্ডপে কুড়ি-পঁচিশ হাত উঁচু প্রতিমা দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি উচ্চতার এক মূর্তি সেখানে দাঁড়িয়ে। সারা গা দিয়ে যেন আলো বেরোছে তার। জ্বলজ্বল করছে দুটো স্থির চোখ। দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সেই মূর্তিটির পরনে যুদ্ধের বেশ, মাথায় শিরস্ত্রাণ, একহাতে উদ্যত বিশাল এক ধনুক, অন্যহাতে অদ্ভুতদর্শন এক তির।

ঠিক তখনই আবার তুবড়ি-তুবড়ি গন্ধটা কোত্থকে এসে ঝাপটা মারল নাকে। আচমকা সমস্বরে একশো ঘোড়ার ডাকের সেই পিলে চমকে দেওয়া শব্দটা কাঁপিয়ে দিল সমস্ত জঙ্গল। মেরুদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল যেন। আমরা একপা দু'পা করে পিছোতে পিছোতে দৌড়তে শুরু করছি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।

ক্ষীণ চাঁদের আলোতে পথটুকু ঝাপসা দেখাছে। ঘাম জবজবে অবস্থা, এই শীতও ঘামছি কুলকুল করে। মনে হছে ফুসফুস বুঝি ফেটে পড়বে এখনই। বুড়িতোর্সার তীরে চেকপোস্টের কাছে আমাদের জিপটা দাঁড়িয়ে ছিল। সেইটুকু পর্যন্ত পৌঁছতে কতবার যে এক-একজন আছাড় খেয়ে পড়লাম তার ঠিক নেই।

হেডলাইট আর ফগলাইটের জোরালো আলো ফেলে ঘন জঙ্গল চিরে পাগলের মতো গাড়ি ড্রাইভ করে পদম আমাদের নিয়ে এল লজে। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে পড়েছি আমি আর ইমন। পদম বিস্ফারিত চোখ নিয়ে তখনও বসে আছে ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি থেকে নামার কথা যেন মনেই নেই তার।

নিত্যবাবু আমাদের দেরি দেখে লজের বাইরে পায়চারি করছিলেন। আমাদের তিনজনকে বিপর্যস্ত দশায় দেখে লবিতে এনে বসালেন। তিন গ্লাস জল এল তাঁর নির্দেশে। চোঁচোঁ করে গ্লাসের পুরো জল খেয়ে নিলাম তিনজন। ইমনের মুখে সব শুনলেন নিত্যবাবু। বড়বড় চোখ করে বললেন, সেই অতিকায় পায়ের ছাপের মালিককেই কি তবে দেখলন আপনারা ? এ তো ভৌতিক কান্ড মশাই !

আমি স্বগতোক্তি করার মতো করে বললাম, ভুত-প্রেত তো কখনও দেখিনি কিন্তু যেসব গল্প যেমন শুনছি এ তো তেমন মনে হল না। অতিকায় চেহারা অবধি ঠিক আছে, কিন্ত ভূতের গা দিয়ে কি জ্যোতি বেরোয় ?

পদম বলল, ভূত কি যুদ্ধের পোশাক পরে থাকে কখনও ? তাদের হাতে কি তিরধনুক থাকে ?

আমি ইমনের পিঠে একটা আলতো চাপড় মেরে বললাম, তোর মহাভারতের পাতা থেকে কোনও চরিত্র উঠে আসে নি তো ?

ইমন হাসল না মোটেই।  বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। বলল, হ্যাঁরে রাহুল, আমরা অশ্বত্থামাকে দেখিনি তো?

আমি আকাশ থেকে পড়লাম,  অশ্বত্থামা ? মানে ?

ইমন আদ্ভুত স্বরে বলল, মহাভারতে দশজন চিরজীবীর উল্লেখ আছে জানিস তো। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে দু'পক্ষ মিলিয়ে মাত্র দশজন বীর বাঁচেছিলেন। পান্ডবপক্ষের সাতজন হলেন যুধিষ্ঠির, ভীম, আর্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, শ্রীকৃষ্ণ। কৌরবপক্ষের মাত্র তিনজন। অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য আর কৃতবর্মা।

নিত্যবাবু হাঁ করে শুনছেন ইমনের কথা। আমি ভ্রু কুঁচকে ইমনের দিকে তকিয়ে বললাম, তাতে কী প্রমাণ হল ?

ইমন উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, দ্রোণ আর কৃপীর পুত্র হলেন  অশ্বত্থামা। জন্মেই ঘোড়ার মতো ডেকেছিলেন বলে  অশ্বত্থামা নাম তাঁর। বাবার কাছেই তিনি অস্ত্রশিক্ষালাভ করেন, তাঁর কাছ থেকেই ব্রহ্মশির অস্ত্র পান। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত অবস্থায় দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে,  ধৃষ্টদ্যুম, শিখন্ডীকে বধ করেন আশ্বত্থামা। এমনকী তাঁর অস্ত্রে উত্তরার গর্ভস্থ অভিমন্যুর সন্তান মারা যায়। তাঁর মাথায় একটা মণি ছিল। সবসময় সেটা জ্বলজ্বল করত। সন্তানশোক, ক্রোধে উন্মাদ হয়ে দ্রৌপদী বলেছিলেন আশ্বত্থামার মাথার মণি  আমার চাই।

আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। তিনজন একসঙ্গে বললাম, তারপর ?

ইমন বলল, যুদ্ধশেষে অশ্বত্থামার মাথার মণি ভীম খুলে দ্রৌপদীর হাতে দিয়ে দেন। মণি হারিয়ে চিরজীবী অশ্বত্থামা বনে চলে যান। কে বলতে পারে, যুগ যুগ ধরে সেই হারানো মণির খোঁজে আজও হয়তো বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, এ তোর কষ্টকল্পনা। দিনরাত মহাভারত পড়ছিস, তাই এসব গাঁজাখুড়ি ভেবে দুই প্লাস দুই বাইশ করছিস।

ইমন স্মিতমুখে বলল, অমি একটা সম্ভাবনার কথা বলালম। আমি ভুল হতে পারি। তবে খেয়াল করে দেখিস যখন আলোর জ্যোতি বেরোতে থাকা মূর্তিটা আমরা জঙ্গলের মধ্যে দেখলাম তখন যেন একশো-হাজার ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে ডেকে জঙ্গল ফাটিয়ে ফেলছিল। চিলপাতার জঙ্গলে এত ঘোড়া আসবে কোত্থেকে বল তো !

সময় গড়িয়ে যাছে সময়ের মতো। আমার স্থানুর মতো বসে রয়েছি পর্যটন লজের লবিতে। খিদে-তেষ্টা ভুলে গিয়েছি সবাই। আজ নিজের চোখে যা দেখেছি সে ঘটনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে কখনও ? অসম্ভব। হেসে উড়িয়ে দেবে সকলে। কিন্তু ইমনের অনুমান সত্যি হোক বা না হোক, একটা ব্যাপার নিশ্চিত, এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার স্বাদ আমরা বয়ে বেড়াব সারাজীবন ধরে।                                                        

জলপাইগুড়ির বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখিতে হাতেখড়ি। পেশায় সরকারি চাকুরে মৃগাঙ্ক নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিষ্টিত এবং স্বল্প পরিচিত কাগুজে পত্রিকায় এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে বড়দের এবং ছোটদের জন্য গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখেন। লেখালিখির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েন মৃগাঙ্ক।