খেলাঘরখেলাঘর

মান্তুর জাদুছক্কা

মানতু এক বছর বারো-তেরোর ছেলে। ছোটবেলায়ই সে মা-বাবাকে হারিয়েছে, কাকা-কাকীমার কাছে মানুষ। কাকার দিলটা ছিলো দরাজ, কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য ছিলো সীমিত। তার মধ্যেই তিনি মানতুর যতটা সম্ভব দেখভাল করতেন। নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে স্কুলে পাঠিয়ে তাকে লেখাপড়া শেখাতেন।
মানতু খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতো। তবে তার ঝোঁক ছিলো আঁকাজোকা আর গানবাজনার দিকে। সে স্বপ্ন দেখতো, বড় হয়ে একদিন নামী চিত্রশিল্পী বা গায়ক হবে।
সেদিন রাতে সে একটি গল্পের বই শেষ করে সবে বিছানায় শুতে গিয়েছে। কোনো কারণে ঘুম আসতে চাইছে না, এমন সময় কানে এলো পাশের ঘরে কাকা-কাকীমার কথোপকথন। তাঁরা গলা নামিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা করছেন। সব কথা শোনা যায় না, তবু তার থেকেই বুদ্ধিমান মানতু বুঝে নিলো যে তাঁর এই আশ্রয়দাতা দু’জন গভীর আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন। কিছুতেই তাঁরা আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য করে উঠতে পারছেন না। তবু এই উদার হৃদয় মানুষ দু’টি সেকথা মানতুর কাছে ঘুণাক্ষরে প্রকাশ করেননি। সে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবেই এখন এ বিষয়ে আলোচনা করছেন।
“আমি যদি কিছু রোজগার করে ওঁদের সমস্যার একটু সুরাহা করতে পারতাম!” এই কথা ভাবতে ভাবতে মানতু একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। কতক্ষণ পর কে জানে, কার ডাকে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেলো। এক মহিলা মিষ্টিস্বরে ফিসফিসিয়ে বলছেন, “মানতু, তোমার দুঃখ আমার বুকে বেজেছে। আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।”
মানতু ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। বললো, “আপনি কোথায়? আপনাকে যে দেখতে পাচ্ছি না।”
“আমাদের দেখা যায় না মানতু, শুধু শোনা যায়।” মহিলা আবার বললেন।
অতি কষ্টে উত্তেজনা দমন করে মানতু বললো, “আপনি কি কোনো দেবী, আমায় বর দেবেন?”
“ঠিক তা নয়। আসলে আমি এক ভিনগ্রহের অধিবাসী। আমি তোমায় একটা যাদু ছক্কা দিয়ে যাচ্ছি, যার সাহায্য নিয়ে তুমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে।”
“এটা কি তবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো কোনো জিনিস?” মানতু কিন্তু-কিন্তু করে বলে।
“অনেকটা, তবে একটু তফাত আছে।” মহিলা বলেন, “ইচ্ছেপূরণের জন্য তোমাকে দুটো শর্ত মানতে হবে।”
 “কী সেই শর্ত?”
“প্রথমতঃ, তুমি কারো অনিষ্ট চাইবে না।”
“আমি কখনো কারো অনিষ্ট চাই না।”
“জানি, আমরা মন পড়তে পারি।” না দেখা স্বরে এবার একটু হাসির ছোঁয়া, “তোমার মনটা ভালো দেখেই আমরা এই ছক্কা তোমায় দিচ্ছি। তবে ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষ বদলে যায়, তাই সাবধান করে দিচ্ছি – তুমি যদি এই ছক্কার কাছে কারো অনিষ্ট চাও তো তোমার নিজেরই অনিষ্ট হবে।”
“আমি যদি তেমন কিছু চাই তবে সেটাই আমার উচিত শাস্তি হবে। এবার বলুন, দ্বিতীয় শর্তটা?”
না দেখা কণ্ঠস্বরে এবার দৃঢ়তার ছোঁয়া, “আমরা অলস, অপদার্থদের সাহায্য করি না। ইচ্ছেপূরণের জন্য তোমাকে আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করতে হবে, তবেই এই যাদু ছক্কা তোমায় উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করবে। চলবে?”
“সে আর বলতে!” মানতু বিনা দ্বিধায় বললো, “পরিশ্রমে আমি কখনো পিছপা নই। শুধু আমি চাই তার ফলে যেন আমার আর আমার প্রিয়জনেদের উপকার হয়।”
“সেই জন্যেই এই যাদু ছক্কা। তুমি এটা হাতে ধরে মনে মনে আন্তরিকভাবে কিছু চাইবে, আর সাথে সাথে কোমর বেঁধে লক্ষ্যপূরণের জন্য কাজে নেমে পড়বে। তাহলেই তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।”
“তাই হবে। কিন্তু – কোন কারণে যদি আমি ছক্কার কাছে যা চাইলাম তার জন্যে কোনো চেষ্টা না করি?”
“তবুও তোমার সেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে।” কণ্ঠস্বরে এবার যেন একটু বিষণ্ণতার ছাপ, “কিন্তু সেই শেষবার। তারপর এই যাদু ছক্কা আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে।”

হঠাৎ যেন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আর মানতু ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ওঃ, তাহলে স্বপ্ন!
কিন্তু তার শিয়রের কাছে ওটা কী জ্বলজ্বল করছে? মানতু আলো জ্বাললো, সাথে সাথে চোখে পড়লো সেখানে একটা লুডোর ছক্কার মতো জিনিস। তার ওপরে অবশ্য ছক্কার মতো এক-দুই ইত্যাদি ফোঁটার বদলে আছে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন। আলো জ্বালাবার পর এখন জিনিসটিকে নিস্প্রভ দেখাচ্ছে। মানতু সেটাকে হাতে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিতেই জ্বলজ্বলে ভাবটা আবার ফিরে এলো। অনিশ্চিত মন নিয়ে মানতু বালিশে মাথা দিলো, একটু পর ঘুমিয়েও পড়লো।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।