খেলাঘরখেলাঘর

মান্তুর জাদু ছক্কা
ছবি আঁকা ছাড়া যা মানতুর মন টানতো তা হচ্ছে গান। যাত্রা চলার সময় যখন পেছনে প্লে-ব্যাকে গান চালানো হতো, তার সাথে সাথে মানতু গুনগুনিয়ে গলা মেলাতো। বলাই বাহুল্য তার গলা নয়, রেকর্ডের গানই সাউণ্ড চ্যানেলে শোনা যেতো। “ইস, আমিও যদি প্লে-ব্যাক গায়ক হতে পারতাম!” সে প্রায়ই ভাবতো।
কিন্তু একদিন একটা ‘গোলমাল’ হয়ে গেলো। যাত্রাদলের এক টেকনিশিয়ান মানতুর এই গুনগুনিয়ে গান গাওয়ার অভ্যেস লক্ষ করে তার সাথে এক নিষ্ঠুর তামাসার পরিকল্পনা করলো। একদিন সে সবার অলক্ষ্যে সাউণ্ড চ্যানেলে সিডি প্লেয়ারের বদলে গ্রীনরুমের মাইক্রোফোন জুড়ে দিলো। ফলে অভিনেতা যখন ‘লিপ’ দিচ্ছিলো, কয়েক সেকেণ্ড চারদিক নিঃশব্দ। কিন্তু তারপরই মাইকে বেজে উঠলো এক কচি, কিন্তু সতেজ ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর – মানতুর অজান্তে তার খালি গলার গান!
যে তামাসা করতে চেয়েছিলো, তার উদ্দেশ্য ছিলো মানতু এভাবে সবার সামনে অপদস্থ হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকার পর দর্শকরা যখন বুঝতে পারলো কোনো কিশোর শিল্পী ‘লাইভ’ গাইছে, সহর্ষ করতালিতে তারা এই নবীন প্রতিভাকে স্বাগত জানালো। গ্রীনরুমে তখনও ভ্যাবাচাকা ভাব কাটেনি। যখন আসল ব্যাপারটা ধরা পড়লো, ততক্ষণে মানতু স্টেজ মাত করে দিয়েছে।
হিংসুটে টেকনিশিয়ানটির কপালে জুটলো বিস্তর বকাঝকা। মালিক তাকে সতর্ক করে দিলেন যে আবার অমন করলে তাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এবার যাত্রাদলের সঙ্গীত পরিচালক মানতুর কাছে এসে নরম স্বরে বললেন, “তুমি চমৎকার ছবি আঁকো। কিন্তু তোমার গানের গলা, এক কথায়, অতুলনীয়! প্রথম সারির গায়ক হবার সমস্ত লক্ষণই তোমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু উঁচুতে উঠতে হলে আগামী দিনগুলিতে তোমাকে এ ব্যাপারে অনেক মেহনত করতে হবে।”
“আমি জানি, স্যার!” হাতে ধরা যাদু ছক্কাটির দিকে তাকিয়ে মানতু যেন স্বগতোক্তি করার মতোই ফিসফিসিয়ে বললো।

শুধু বলা নয়, কাজেও সে করে দেখালো মেহনত কাকে বলে। তার গান শেখার হাতেখড়ি হলো সঙ্গীত পরিচালকের স্নেহের ছায়ায়। পরে মালিকের নির্দেশে ও সাহায্যে সে একজন নামকরা সঙ্গীত গুরুর কাছে শেখার সুযোগ পেলো। গুরুটি ছিলেন খুবই কঠোর, আবার মানতুকে তিনি খুব ভালোও বাসতেন। তাঁর ছত্রছায়ায় মানতু দ্রুত উন্নতি করতে লাগলো, তার নাম আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো।
তারপর একদিন এক চলচ্চিত্র প্রযোজক মানতুর প্রতিভার সন্ধান পেয়ে অনেক টাকার বিনিময়ে তাকে তাঁর সিনেমায় প্লে-ব্যাকে গাইবার জন্য চুক্তিবদ্ধ করলেন। এইভাবে যাদু ছক্কার কাছে চাওয়া তার আর একটি ইচ্ছেও পূর্ণ হলো। নিজের এতদিনের শহর ছেড়ে সে চললো ভারতীয় সিনেমার যাদুনগরী মুম্বইয়ে। প্রযোজকের লোকই তার প্লেনের টিকিট ও অন্যান্য ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত করে দিলেন।
মানতু তাঁর পিতৃতুল্য মালিক দত্তবাবু, যাত্রার সঙ্গীত পরিচালক ও গুরুজীর কাছ থেকে বিদায় নিলো। এঁদের সাহায্য ও প্রাণঢালা ভালোবাসা ছাড়া সে কিছুতেই এত বড় হতে পারতো না। তারপর সে সজল চোখে বিদায় নিলো এতদিনের অভিভাবক কাকা-কাকিমার কাছ থেকে। আসার সময় মানতু বলে এলো যে এবার থেকে তাঁদের আর টানাটানি করে চলতে হবে না, সে নিয়মিত মুম্বই থেকে টাকা পাঠাবে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।