খেলাঘরখেলাঘর

পাপাঙ্গুল

পাপাঙ্গুলকে তোমরা অনেকেই চেনো। সেই পাপাঙ্গুল... "নিল মাথাতে সবুজ রঙের চুল"...এই গল্পটা সেই পাপাঙ্গুলের...যখন সে তার ছাঁকনি চড়ে সাগরপারি দিল। তারপর, অনেকদিন অনেক রাত গেছে কেটে, সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ...পাপাঙ্গুলের নৌকো যখন অনেক ঝর অনেক ঢেউ পেরিয়ে এসে পৌঁছল এক মাঝ সমুদ্রে, সমুদ্রের ঢেউ ততক্ষণ অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। ছাঁকনিতে বাঁধা সবজেটে রুমালটা খুব আলতো করে, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিচ্ছিল খুব কাছে, খুব কাছেই আছে পাপাঙ্গুলের দেশ। নিজের দেশ...

পাপাঙ্গুল তার ছাঁকনির ধারে বসে ভাবছিল সে নানান কথা – কেমন করে ঘর ছেড়েছিল...
“সে এক ঝমঝমে বৃষ্টির রাত, তিনদিন তিনরাত টানা বৃষ্টিতে যখন চারিদিক জলে থৈ-থৈ করছে, একটানা বৃষ্টির জলে ভেসে যে গেছে তার সব কিছুই, কোথাও কিছুই নেই। পাপাঙ্গুল তখন সেই বৃষ্টির রাতেই বেরিয়ে পরেছিল তার ছাঁকনিটাকে সম্বল করে, হুঁকোয় তার সবজে রুমালটা বেঁধে – তাকে পাল করে। তারপর ভাসতে ভাসতে কত যে কাল পেরিয়ে গেল, কত দেশ, কত মানুষ।”

এসব ভাবতে ভাবতে হটাৎ পাপাঙ্গুলের চোখ চলে গেল জলে – সেখানে একটা ছোট্ট গোল্ডফিশ। তার নৌকার খুব কাছে দিয়ে যাচ্ছে, একা একা। মুখটা তার ভারী ভারী, চোখ দুটো ছলছল। পাপাঙ্গুলের মনটা কেমন করে উঠল...সেও কি তার মত দেশছাড়া, সঙ্গীছাড়া কেউ? একা একা পথ ভুলে কিম্বা অভিমানে ঘর ছেরেছে? পাপাঙ্গুল একটু ঝুঁকে আস্তে করে ডাকল – “এই যে শুনছ...”
কোনও সাড়া নেই। গোল্ডফিশ আনমনা হয়ে সাঁতরেই চলছে একা একা। কোথায় যে যাচ্ছে তার কোনও ঠিকঠিকানাও নেই। চোখের কোনে তার এক চিলতে জল। ঠোতদুটো তার অভিমানে ফোলা। পাপাঙ্গুল আবার ডাকল – “এই শোনো, তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

ঘোর কাটলে গোল্ডফিশের, এক চোখে পাপাঙ্গুলকে দেখে বলল – “আমায় কিছু বলছ তুমি?”

পাপাঙ্গুল মুখটা জলের দিকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করল – “নাম কি তোমার, কোথায় চললে তুমি?”

“জানিনা”।
“তুমি আমার ছাকনিতে এসো, একটুখানি জিরিয়ে নাও। অনেকক্ষণ থেকে সাঁতার কাটছ মনে হচ্ছে।” – পাপাঙ্গুল খুব নরম করে গোল্ডফিশকে বলল।
“কেন? আমি কেন তোমার ছাকনিতে চরবো?” – খুব গভীর দুঃখ যে হয়েছে, সেটা তার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

পাপাঙ্গুল বলল – “না মানে আমি ত তোমার বন্ধু হতে পারি, অনেকটা পথ আমিও একা একা চলেছি, যদি একটা বন্ধু পেতাম, মনের মত দুটো কথাও বলা যেত। সেই কতকাল দেশ ছেড়েছি, তালুক-তুলুক মালুক-মুলুক সব ভুলে আমারও কি ছাই একা একা আর ভাল লাগে বল? তাই ভাবলাম যদি তুমি আমার নাও-এ এসে একটু আমার সাথে গপ্পো কর...”

কি জানি কি ভেবে গোল্ডফিশের মন একটুখানি নরম হল। সে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে পাপাঙ্গুলের ছাঁকনিতে চড়ে বসল।

“তোমার নাম কি?”

“অনি...অনিফিশ”

“তোমার বাড়ী কোথায়?” অনিফিশ কোনও উত্তর দিলনা। পাপাঙ্গুল বুঝল একে ঘাঁটিয়ে কাজ নেই, তার থেকে এর সাথে বন্ধুত্ব করা যেতে পারে। বলল – “আমার নাম পাপাঙ্গুল। অনিফিশ, তুমি আমার বন্ধু হবে?”
পাপাঙ্গুল নাম শুনে বোধহয় অনিফিশের খুব ভাল আর মজাও লেগেছে। সে ফিক করে একটু হেসে বলল – “পাপাঙ্গুল...!!??”

“হ্যাঁ, আমার নাম পাপাঙ্গুল।

আমি ছাঁকনি চড়ে, নৌকো করে,

দূর দেশেতে ঘুরে, ফিরছি আবার ঘরে।”

 

পাপাঙ্গুলের ছড়া শুনে অনিফিশ খুব মজা পেয়ে গেল। সে বলল – “হুম, আমি বন্ধু হতে রাজি।”
তারপর শুরু হল অনিফিশ আর পাপাঙ্গুলের গল্প।
অনিফিশ বলল – “আমি ছিলাম সমুদ্দের মাঝে একটা ছোট্ট পাহাড়ের নিচে, একটা গর্তে। সেখানে আমরা অনেকে মিলে থাকতাম, আমার মা-বাবা ভাইবোন, বন্ধুরা সবাই মিলে। বেশ আনন্দেই কাটত আমাদের দিন, সব্বাই মিলে, সাঁতার কেটে এদিক-ওদিক ঘুরে বেরাতাম। সূর্যের প্রথম আলো যখন সেই জলের নিচে পৌঁছত...সেই সোনালি জলের মধ্যে আমরা দৌড়োদৌড়ী করে খেলা করতাম। ছোট্ট ছোট্ট সবুজ গাছের মধ্যে সমুদ্রের নিচে যে সে কত কি আছে...তোমায় কি বলব পাপাঙ্গুল, সে ভারী আজব দুনিয়া। কত সুন্দর সব নানা রঙের মাছ সেখানে, কত সুন্দর সেখানে নানান গাছ, তাতে নানা রঙের ফুল। তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। তুমি ফাইটোপ্লাঙ্কটন দেখেছ পাপাঙ্গুল?”
পাপাঙ্গুল তো সেসব কিছু দেখেনি, মাথা নাড়িয়ে বলল “না”। অনিফিশ বলে – “সে ভারী সুন্দর জিনিষ পাপাঙ্গুল, সমুদ্রের ফুল, খুব সুন্দর, সুমদ্রের জলে ভেসে থাকে। আমরা বন্ধুরা মিলে সেই ফাইটোপ্লাঙ্কটনের বাগানে মাঝে মাঝে পিকনিক করতাম। কিন্তু জানো পাপাঙ্গুল, আমার মনটা শুধু আমায় বলত এখানের থেকে আরো দূরে যাব, আরো অনেক দূরে, এই সমুদ্রকে আবিষ্কার করতে। তারপর একদিন আমাদের সেই সুখের দেশে হানা দিল এক বিশাল হাঙর। সেদিন ছিল একটা খুব ঝলমলে দিন। আমরা বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করেছিলাম একটু দূরে সবাই বেরাতে যাব। তাই সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে এক ঝাকে আমরা চলে ছিলাম। হটাৎ করে দেখি সেই আলোর আকাশে একটা কালো মেঘের ছায়া, যেন অন্ধকার নেমে এল। আমাদের মধ্যে কে যেন বলে উঠল – পালাও পালাও পালাও...।” মাথা ঘুরিয়ে পিছন ফিরে আর দেখা হলনা পাপাঙ্গুল। যে যেদিকে পারল ছুটে গেল, কিছু বন্ধু পারলনা। হাঙর তাদের খেয়ে ফেলল। আমি দলছুট হয়ে খুব জোরে সাঁতার কেটে একটানা যখন প্রাণে বাঁচলাম দেখলাম এক অজানা দেশ। কেউ কোথাও নেই। একা আমি এখানে, কাউকে চিনি না। আমিতো পথ হারিয়েছি পাপাঙ্গুল। একা খুব একা।”

 

এই কথা বলতে বলতে পাপাঙ্গুল দেখে অনিফিশের সেই সুন্দর চোখের থেকে টুপটুপ করে দু-এক ফোঁটা জল পরছে পাপাঙ্গুলের হাতে। পাপাঙ্গুল অনিফিশের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল – “ছিঃ! অমন করে কাঁদতে আছে? আমি না তোমার বন্ধু হলাম আজ?”

“পাপাঙ্গুল আমার যে কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই। আমি খুব একা হয়ে গেছি।”

“আমি তো আছি” এই বলে পাপাঙ্গুল অনিফিশের পাশে এসে চুপটি করে বসল। এদিকে গল্প করতে করতে কখন যে দিন গড়িয়ে বিকেল পেরিয়ে পশ্চিম সাগরে সূয্যিমামা অস্ত গেছে কেউ খেয়াল করেনি। আকাশে আজ খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। পাপাঙ্গুল সেদিকে তাকিয়ে বলল – “অনিফিশ দেখ...কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এর মানে সব মেঘ কেটে গেছে আমরা এবার আবার সব ফিরে পাব।”
পাপাঙ্গুলের কথা শুনে অনিফিশের মনটা খুশীতে ভরে উঠল। সে তার ছোট্ট ছোট্ট পাখনা নেড়ে বলল - “আমরা আবার নতুন করে সব বন্ধু করে নেব, এই সমুদ্রে জা কিছু আছে সব আবার নতুন করে চিনে নেব।”

পাপাঙ্গুলের সবুজ চুল তখন হাওয়ায় ফুর ফুর করে উড়ছে। অনিফিশ আর পাপাঙ্গুলের মনে খুব আনন্দ আজ...অনেকদিন পর। বন্ধু পেয়ে বেজায় খুশী দুইয়ে। তারা তাদের চারিদিকে চেয়ে গেয়ে উঠল -

“আহা আলংগুশ, আজকে আমাদের মেজাজ খুশ, আহা আলংগুশ!!!”


অনন্যা দত্ত
রামপুরহাট, বীরভূম