খেলাঘরখেলাঘর

টেণশন

অভি একা বাড়িতে বসে টেনশন করছে। বাবার ফিরতে দেরি হচ্ছে, মা একটু শপিংয়ে বেরিয়েছে। কাজের মাসিও আজ ছুটি নিয়েছে। সুতরাং সে এই মুহূর্তে বিশুদ্ধ একা। তাতে অবশ্য তেমন কিছু নয়। সে এখন বড় হয়ে গেছে, একলা থাকতে হলে আর ঘন ঘন বাথরুম পায় না। তার টেনশনের কারণ অন্য।
ব্যাপারটা সেই চিরাচরিত, অর্থাৎ অঙ্ক। সে যে বোঝে না তা নয়। কিন্তু বিশেষ করে অজানা কোনো প্রশ্নের অঙ্ক সলভ করতে গিয়ে কীভাবে যেন খেই হারিয়ে ফেলে। তারপর দেবু স্যার যখন ক্লাসে “আরে এটা বুঝলিনা, গাধা!” বলে অঙ্কটা কষে দেন, তখন মনে হয় – ইস, এই সহজ ব্যাপারটা মাথায় এলো না! আত্মবিশ্বাসের অভাব, বলেন স্যার।
সেদিন অঙ্ক নিয়ে আর এক কাওতাল হলো। মা ভিসিডি প্লেয়ারে স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তার সম্পূর্ণ জন-গণ-মন গানটা চালিয়ে দিয়েছিলো। তার শেষদিকে ছিলো, “দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে, রক্ষা করিলে অঙ্কে।” শুনে অভি জিজ্ঞেস করেছিলো, “মা, কবিগুরু কি এখানে দেবু স্যারের মতো অঙ্ক টিচারদের কথা বলেছেন?” “না, তা নয়। এখানে অঙ্ক মানে –”, মা কী যেন বোঝাতে শুরু করেছিলো। কিন্তু বাবা এত জোর হেসে উঠেছিলো যে অভি মা’র কথা শেষ অবধি শুনতেই পায়নি।
তা, এখন সেই একগাদা প্রশ্নের অঙ্ক নিয়ে বসে সে মাথা চুলকোচ্ছে। বাবা-মা কেউ থাকলে একটু ধরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তারা ঢুকতে ঢুকতে অভির চোখ ঘুমে ঢুলে পড়বে। হোমওয়ার্ক কমপ্লিট না হলে দেবু স্যার যে মারধর করেন তা নয়, তবে তাঁর মিছরির ছুরি ব্যঙ্গ শুনতে শুনতে বন্ধু-বান্ধবদের সামনে লজ্জায় মুখ-কান লাল হয়ে ওঠে। বাবা-মা’কে এ নিয়ে বললে তারা হয়তো খুঁজেপেতে একজন টিউটর এনে লাগিয়ে দেবে – সে আর এক যন্ত্রণা।

সুতরাং অভি ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে ভেবে যায় আর টেনশন করে চলে। সাথে আবার টেনশন নম্বর দুই – গান। এটা অবশ্য অভি বেশ পারে। অনেকে বলে টিভিতে বাচ্চাদের সারেগামা-ফামা কীসব হয়, তাতে নাম দিতে। বয়ে গেছে অভির! গানে যেটুকু আনন্দ আছে, কম্পিটিশনের ঠ্যালায় দু’দিনে তাও উপে যাবে। অর্থাৎ আরো একটা সবুজ দরজায় কুলুপ।
তবে পাড়ার ক্লাবের ফাংশনে সে বাচ্চা গ্রুপে গায়। গতবারের ফাংশনে ‘ভূমি’ এসেছিলো আর অভির ওপর পড়েছিলো সৌমিত্র কাকুকে ফুল দেবার ভার। উনি একটু হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি আমাদের গান শোনো?”
“হ্যাঁ, তবে আপনাদের গান শুনলে আমার জ্বর এসে যায়।”
“ও, তাই?” অস্বস্তিভরে বলেছিলেন কাকু।
“আপনাদের গান তো নিঃশব্দে শোনা যায় না, সাথে গলা মেলাতে হয়। আর অত চড়া স্কেলে গাইতে গেলেই গলা ভেঙে যায়। তারপর গলাব্যথা, সর্দিকাশি, জ্বর –”
ওর পিঠ চাপড়ে কাকু বলেছিলেন, “এর চেয়ে ভালো প্রশংসা আমি এখনো পাইনি।”
তা, আবার কিছুদিন পর সেই পাড়ার ফাংশনে অভিকে গাইতে হবে। তবে কিছুদিন ধরে একটা বেয়াড়া কাশি। আগেও এমন হয়েছে। কিন্তু এবার অনেকদিন ধরে ভোগাচ্ছে, এদিকে ফাংশন এসে গেলো বলে।
বাবা অগত্যা ডাক্তার দাদুর কাছে নিয়ে গেলেন। উনি দেখেটেখে গম্ভীরভাবে বললেন, “ওর কোনো দোষ নেই। আসলে পাশের ঐ যে আকাশছোঁয়া বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকে ধুলোবালি, কংক্রিট-সিমেন্টের গুঁড়ো এসে বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। ইদানীং আমার কাছে গলা ও বুকের সমস্যা নিয়ে অনেক রোগি আসছে, তাদের বেশির ভাগই বাচ্চা। ঐ বিল্ডারকে সাবধানতা নিতে বাধ্য না করাতে পারলে কতজনের যে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে কে জানে!”
তা, বাবা পাড়ার আরো কয়েকজনকে নিয়ে বিল্ডারের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন, “আরে, বাচ্চা তো আমার বাড়িতেও রয়েছে – কই, তাদের তো কিছু হচ্ছে না!”
হচ্ছে না কারণ তিনি থাকেন ওখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু তাঁকে সে কথা বোঝাবে কে? রোজ ধূলোবালি, সিমেন্টের গুঁড়ো উড়ছে আর বাচ্চারা কেশেই চলেছে। আর অভির টেনশন বেড়েই চলেছে।

“গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো?”
অভি চমকে দেখে, পাশে চেয়ারে বসে প্রায় তার বয়েসী একটি ছোট্ট মেয়ে।
“সে অনেক জ্বালা, তুমি বুঝবে না।” বলেই অভির খেয়াল হলো, “কিন্তু তুমি কে? এখানে এলে কীভাবে?”
“আমি সলমা, আমি তো এখানেই থাকি।”
“ঢপ দেবার আর জায়গা পাও না – এটা তো আমাদের বাড়ি!”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি এখানেই অন্য এক খাঁজে থাকি।”
“খাঁজ?”
“ওঃ, তাও জানো না – একেবারে গাঁইয়া দেখছি!” সলমা হেসে বললো, “আরে বাবা, যেমন ধরো তোমরা যে জমির ওপর তিনতলায় রয়েছো, একই জমির ওপর দোতলায় অন্য লোক থাকছে। তেমন আমরাও তোমাদের সাথে একই জমিতে, একই তলায়, কিন্তু অন্য একটা খাঁজে আছি। যাকে ইংরেজিতে বলে Tier.”
“আমাকে অত বাচ্চা পাওনি যে ইঞ্জিরি-মিঞ্জিরি যাহোক কিছু পড়িয়ে দেবে! আমি ইস্কুলে পড়েছি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা – মাত্রা এই তিনটি। ওসব খাঁজটাজ তো বাপের জম্মে শুনিনি।”
“শোনোনি, এবার শুনলে। আর নিজের চোখেই তো আমাকে দেখছো। খাঁজ যদি না থাকে তো আমি এলাম কোত্থেকে?”
অভি ভেবেচিন্তে বললো, “ওঃ, তার মানে ওসব ভজখট ছেড়ে সংক্ষেপে, তুমি ভূত! আই মীন, পেত্নী। তবে আমি কিন্তু ভূতে-টুতে ভয় পাই না।”
“ভূত, পেত্নী!” সলমা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, “ভূত নয়। তুমি যেমন গবেট দেখছি, মনে হয় আমরা বরং তোমার তুলনায় ভবিষ্যৎ। তা, আমাকে দেখে কি পেত্নী-পেত্নী মনে হচ্ছে?”
“না।” অভি গম্ভীরভাবে বললো, “এত বাচ্চা না হলে বরং তোমাকে পরী রানি মনে হতে পারতো। তা, তুমি কি তাহলে ভিন গ্রহের বাসিন্দা, মানে এলিয়েন?”
“উঃ, বলছি না আমি এখানেই থাকি। পড়শি কখনো এলিয়েন হয়? তবে তোমাদের বিজ্ঞান যে মান্ধাতার আমলের, খাঁজ-ফাজ নিশ্চয়ই বুঝবে না। তাহলে মনের শান্তির জন্য এলিয়েনই ধরে নাও।”
“কিন্তু পড়শি হলে অ্যাদ্দিন তোমায় দেখিনি কেন?”
“আরে, এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজে আসা কি চাট্টিখানি কথা নাকি? তার জন্য চাবির দরকার হয়, যা সবার থাকে না। আমার বাবা সায়েন্টিস্ট – এবার অফিসের লম্বা ট্যুরে বাইরে গিয়েছে আর চাবিটা গিয়েছে ফেলে। আমি ঘরে বসে বসে সুপার-বোর হচ্ছিলাম, তাই চাবি দিয়ে চ্যানেল সার্ফের মতো সব খাঁজ খুঁজতে খুঁজতে দেখি এখানে বসে তুমি কী নিয়ে যেন ধ্যানে বসেছো। তা, ঋষিমশাইয়ের নামটা জানতে পারি? নাকি সেটা তোমাদের খাঁজের শিষ্টাচার নয়?”
অভি একটু লজ্জা পেয়ে বললো, “না, তা কেন! আমি অভি, মানে অভিমন্যু।”
দুষ্টু হেসে সলমা বললো, “তা, তুমি কোন ব্যুহে ঢুকে বেরোবার পথ পাচ্ছো না? অঙ্ক? একবার বলেই দ্যাখো না, যদি আমাদের কাছে কোনো সমাধান থেকে থাকে?”
অগত্যা অভিকে লজ্জার মাথা খেয়ে এই বাচ্চা মেয়েটার কাছে স্বীকার করতে হলো যে ব্যাপারটা তাই। তার কাছ থেকে সব শুনে সলমা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, “ব্যাপারটা তো খুব সহজ। মনে মনে ভাবো তুমি অঙ্কটা না পেরে দেবু স্যারের সামনে এসেছো আর দেবু স্যার বলছেন – দুর গাধা, এটা পারলি না? অঙ্কটা তো খুব সহজ! এরপর তিনি বোর্ডে অঙ্কটা কষে দিচ্ছেন।”
“তো?” অভি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“তো এবার বোর্ড থেকে অঙ্কটা টুকে নাও!”
“কী ভাট বকছো!” বলতে বলতেই অভির মনে হয়, আইডিয়াটা তো মন্দ নয়। একটা আটকে যাওয়া অঙ্ক সে চোখ বুঁজে ভাবে, তারপর স্যার ঐ গাধা-টাধা বলার পর কীভাবে বোর্ডে অঙ্কটা কষে দিচ্ছেন সেটাও ভাবার চেষ্টা করে। আর সত্যি সত্যিই তার চোখের সামনে সমাধানটা ছবির মতো ভেসে ওঠে!
“ইউরেকা! থ্যাঙ্ক ইউ, সলমা!” অভি লাফিয়ে উঠে বলে, “কিন্তু কী করে হলো?”
“ওই যে তোমার স্যার যা বলেন – আত্মবিশ্বাসের অভাব! স্যারের ছবি ভাবলেই সেই বিশ্বাসটা তোমার মনে জন্মায়। এভাবে অঙ্ক কষতে কষতে একদিন তুমি নিজে নিজেই সমাধান খুঁজে পাবে।”
সত্যিই এভাবে অভি সেদিন দু-একটা বাঁদুরে অঙ্ক সহ সাত-আটটা দুর্ধর্ষ জিনিস নামিয়ে দিলো। সলমা তার মুখ দেখে বললো, “মনে হচ্ছে, তোমার টেনশন এখনো যায়নি?”
“না, মানে, সে এক অন্য ব্যাপার। একটা গানের প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু আমার গলাটা একদম ঠিক হচ্ছে না – আশেপাশে যা প্রদূষণ!” এরপর সে সলমার কাছে সব ব্যাপারটা খুলে বললো।
“হয়ে যাবে।” সলমা একটু ভেবে বললো, “তবে আজ নয়। আমাকে বাড়ি ফিরে একটা জিনিস নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া আওয়াজ পাচ্ছি, তোমার মা ফিরলেন বোধহয়। তার আগেই কেটে পড়ি, নইলে আবার একদফা খাঁজ-ফাজ বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হবে। কাল এই সময় আসবো। গুড বাই।”

পরদিন সলমা ঠিক সেই সময় যেন হাওয়ার থেকে এসে হাজির। হাতে তার একটা পুরিয়া।
“তোমরা কি ম্যাজিক জানো নাকি?” অভি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“আরে না না, ম্যাজিক-ফ্যাজিক নয়, সামান্য একটু প্রযুক্তি। আমাদের বাজারেই পাওয়া যায়। এটা তুমি যদি জ্বালিয়ে দাও, একটা ধোঁয়াহীন গ্যাস তৈরি হবে। তখন আশেপাশে যারা আছে, সব কাশতে শুরু করবে। তুমি এটা নিয়ে, পারলে কিছু দলবল জুটিয়ে বিল্ডারের বাড়ি যাবে আর কথা বলতে বলতে চুপি চুপি এটায় দেশলাই জ্বালিয়ে দেবে। তারপর মজা দেখবে। তোমরা নিজেরা অবশ্য গ্যাস মাস্ক পরে নিও। আমি আবার সামনের সপ্তাহে আসবো, কাজ নামলো নাকি জানতে।”
নামবে না আবার! অভি নিঃশব্দে প্রচার করে এক বাচ্চা ব্রিগেড জড়ো করলো, যাদের সব্বার কাশি চলছে আর যাদের অধিকাংশই ফাংশনে গাইবে। একদিন সন্ধেবেলা তারা গিয়ে বিল্ডারকাকুর বাড়ি হাজির, সবার মুখে সার্জিকাল মাস্ক। আগেই খোঁজ নেওয়া হয়েছে, তখন কাকুদের লোকজন সব বাড়িতে।
“এ কী, মুখোশ পরে সব আমার বাড়িতে? ডাকাতি করবে নাকি?” বিল্ডার কাকু মুচকি হেসে বললেন।
“না না, কাকু – আসলে আমাদের সবার সর্দিকাশি কিনা, হয়তো কারো টিবি-ব্রঙ্কাইটিসও হতে পারে। তাই আপনাদের যাতে ছোঁয়াচ না লাগে –”
“তা বাবা, তোমরা ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছো। এটা তো হাসপাতাল নয়।”
“না কাকু, আমরা ঠিক জায়গায়ই এসেছি। আপনি যে ‘পবিত্রধাম’ বহুতল বাড়িটা বানাচ্ছেন, তার থেকে ধুলোবালি, সিমেন্ট উড়ে এসে আমাদের পাড়ায় বায়ু বড়ই অপবিত্র করছে। তাই আমাদের এই অবস্থা। আপনার কাছে তাই আমাদের বিনীত নিবেদন –”
কাকুর ভুরু কোঁচকায়। বলেন, “দ্যাখো, এসব বাচ্চা ছেলেদের ব্যাপার নয়। তোমাদের বড়দের সাথে তো আমি কথা বলেইছি। যদি আমার বিল্ডিং তৈরির জন্যই প্রদূষণ হবে তবে তো আমাদেরও ঐ কাশি-ফাশি হতো। কিন্তু তেমন কিছু তো –”
অভি ইতিমধ্যে নিঃসাড়ে গুঁড়োটা সোফার পেছনে ঢেলে অলক্ষ্যে আগুন দিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে বিল্ডারকাকু কথা শেষ না করেই কাশতে শুরু করে দিলেন। একটু পর ভেতর ঘর থেকেও শোনা গেলো কাশির আওয়াজ। এক-দুই-তিন – বাড়তে বাড়তে হঠাৎ শুরু হলো যেন কাশির মহা ঐকতান।
“আশেপাশে কেউ ধোঁয়া দিয়েছে – জানালা বন্ধ করো।” কাকু কাশতে কাশতে বললেন।
“সরি কাকু”, অভি বললো, “চারদিকে তাকিয়ে দেখুন – কোথাও কোনো ধোঁয়া নেই। এ হচ্ছে অদৃশ্য প্রদূষণ, নিঃশব্দ ঘাতক। কী যেন বলছিলেন – আপনার বাড়িতে কাশিফাশি নেই?”
“নেই – মানে, অ্যাদ্দিন তো ছিলো না। আজ হ্যাঁচকা কিছু একটা হয়েছে।”
“হ্যাঁচকা কিছু নয়। আসলে আপনার বাড়ি একটু দূরে বলে আপনি অ্যাদ্দিন টের পাননি। কিন্তু আজ বোধহয় বাতাস এদিকে, তাই সব প্রদূষক বাতাসে বয়ে হাজির হয়েছে। দাঁড়ান, দেখি –” বলে সে স্মার্টফোনে গুগল-ফুগল কীসব যেন দেখে একটু পর এক গাল হেসে বললো, “এই তো, আজ থেকে কলকাতায় ঘণ্টায় সতেরো কিলোমিটার বেগে হাওয়া উত্তর-পূর্বদিকে বইবে। অ্যাদ্দিন ছিলো উত্তর-পশ্চিম। আর এমনটা আর অন্ততঃ সাতদিন থাকবে। সেইজন্যেই!”
“তার মানে – আর সা-তদিন আমরা এভাবে কাশবো?” কাকু ভয়ার্তকণ্ঠে বললেন।
“না না, কাকু – সব সময় কি আর দমকা আসবে! তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই কাশি হবে। আর যখন হবে না তখনও তো ঐ বালি, সিমেন্ট, কংক্রিটের গুঁড়ো নিঃশব্দে এসে হাজির হচ্ছে আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে গিয়ে জড়ো হচ্ছে আপনাদের ফুসফুসে। তার ফলে ব্রঙ্কাইটিস, টিবি, সিলিকোসিস, এমনকি লাং ক্যান্সারও হতে পারে। অর্থাৎ, নিঃশব্দ মৃত্যু।” অভি ‘নির্মল বায়ু’ এন-জি-ওর প্রোমোটা মুখস্থ ঝেড়ে দেয়।
“তাহলে আমি কী করবো? অ্যাদ্দুর এগিয়ে এখন –” কাকু ফ্যাকাশে মুখে বলেন।
“ছি ছি, বাড়ির কাজ বন্ধ করবেন কেন! তবে আপনারও তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘর – কিছু সাবধানতা নিন। যেমন, চট-ত্রিপল দিয়ে পুরো বাড়িটা ঘিরে দিন, যাতে ধুলো বাইরে বিশেষ না আসে। মিস্ত্রিদের বলুন কোনো বস্তা যেন অসাবধানে না ঢালে, যাতে সিমেন্ট বাতাসে ছড়িয়ে না পড়ে। আর ওরাও তো মানুষ – ওদের বলবেন এই আমাদের মত মাস্ক পরে কাজ করতে। এভাবে শুরু করুন, তারপর বাকি কী কী করতে হবে তা ‘নির্মল বায়ু’র কাকুরা আপনাদের বলে দেবে।”
“ওদের ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে? রেট কত ওদের?”
“ভাববেন না, আমি ওদের আপনার সাথে কনটাক্ট করতে বলবো। ওরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কোনো টাকা নেয় না। তবে প্রদূষণ-বিরোধী ব্যবস্থার জন্য আপনার কিছু খরচ হবে।”
“সে হোক। বালবাচ্চা নিয়ে ঘর করি – তাদের কিছু হবে না তো, অভিবাবু?” বিল্ডারকাকু এবার অভির হাত দুটো চেপে ধরলো।
“ছি ছি কাকু, অমন করবেন না – আমি আপনার ভাইপোর মতো। কারো কিছু হবে না। শুধু আসুন ঐ কচি কচি মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আপনি-আমি সবাই একজোট হয়ে বাতাসকে নির্মল রাখতে সহায়তা করি।” অভি আবার এক বিজ্ঞপ্তি থেকে ভাষা ঝেড়ে দেয়। তারপর হাতজোড় করে বেরিয়ে আসে।
কাম ফতে – অভি বলতে পারে, সাতদিনের মধ্যে তাদের পাড়ায় বায়ু প্রদূষণ কমতে আরম্ভ করবে। ফাংশনের আগেই বাচ্চা ব্রিগেডও সুস্থ হয়ে উঠবে।

“থ্যা-ঙ্ক ইউ, সলমা। তুমি বোধহয় আমার চেয়ে ছোট। তবু বলবো – আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।”
“আরে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।” সলমা উড়িয়ে দেয়, “আমাদের ওখানে এসব মুস্কিল আসান তো বলতে পারো রেডিমেড পাওয়া যায়। পাছে কারো মুখে কালো ছায়া পড়ে, তাই কোনো সমস্যা আমরা জমতে দিই না।”
“তবু সলমা আমার খুব বড় উপকার করলে।”
“আর ভবিষ্যতেও দরকার হলে আমি পাশে আছি। তোমার গোমড়া মুখে আমি হাসি ফোটাতে চাই।”
“ধন্যবাদ, তবে বোধহয় আর অত সাহায্যের দরকার হবে না। তুমি আমাকে সবচেয়ে বড় যা দিয়েছো তা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। দেখিয়েছো যে সমস্যার বিরুদ্ধে কলজে শক্ত করে দাঁড়ালে তারা পালাবার পথ পায় না। এবার থেকে অনেক সমস্যারই আমি নিজে সমাধান করতে পারবো। আর না হলে তো তুমি আছোই।”
“বেশ, তবে এখনকার মতো যাই।”
“যাচ্ছো? তবে তোমার কি আমাদের থেকে কিছু চাই? একটু কিছু প্রতিদান দিতে পারলে ভালো লাগতো।”
সলমা কিছুক্ষণ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললো, “আমাকে একটা জিনিস দেবে?”
“সাধ্যের মধ্যে হলে – অবশ্যই দেবো। নাও, লজ্জা না করে বলেই ফেলো।”
“আমাকে – আমাকে একটু টেনশন দেবে?”
মেয়েটা বলে কী! অভি হাঁ হয়ে গেলো – “টেনশন!”
“হ্যাঁ। জানো তো, আমাদের ওখানে একদম টেনশন নেই। হবার উপক্রম হলেই মুশকিল আসান এসে হাজির, সব ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার জন্যে। এর থেকে বেরোবার উপায় নেই। কী বলবো – লাইফটা স্রেফ আলুভাতে হয়ে গেলো। তোমায় দেখে এক এক সময় আমার হিংসে হয়।”
“তা বলে কেউ সেধে টেনশন চায়? যেন তুমি যেচে ইঁদুর, আরশোলা, ছারপোকা চাইছো।”
“ওসব কি আর কোনো টেনশন! সংরক্ষণ ব্রিগেড সাথে সাথে সাকশনে করে বস্তায় পুরবে, তারপর হাজার মাইল দূরের অভয়ারণ্যে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবে। কী করি বলো তো?”
অভির মাথায় যেন ব্যাপারটা একটু একটু ঢুকছে। সামান্য ভেবে বললো, “দ্যাখো, তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার মনে হচ্ছে আমাদের উল্টো। যেমন, ভূতেদের পছন্দ-অপছন্দ মানুষদের ঠিক উল্টো। তাই তো গু-গা-বা-বার বিটকেলে গানবাজনা শুনে খুশি হয়ে ভূতের রাজা তিন বরই দিয়ে ফেললো। তেমন আমরা টেনশন দূর করার জন্য যা করি, এবার দেখি তা দিয়ে তোমার যদি টেনশন তৈরি হয়।”
“কী দেবে?”
“গল্পের বই আর গান।” বলে অভি একটা বই আর একটা ডিভিডি বের করে বললো, “বইটা তো বাংলা, মনে হচ্ছে পড়তে পারবে। কিন্তু আমাদের ডিভিডি কি তুমি বাজাতে পারবে?”
একটু দেখে সলমা বললো, “আমি সায়েন্টিস্টের মেয়ে – হয়ে যাবে। তা, কী দিলে?”
“ফাটাফাটি জিনিস! বইটা হচ্ছে হরি পোদ্দার বলে এক অনাথ বালকের গল্প। কিন্তু সে ম্যাজিক জানে। তারপর সে এক রাজ্যে হাজির হলো সেখানে আদ্ধেক ম্যাজিশিয়ান আর আদ্ধেক –”
“পাগল না ছাগল কী যেন বলে! হ্যাঁ, আমি শুনেছি এই বইটার কথা। দাও দাও, মনে হচ্ছে এতে কাজ হবে। আর গান?”
“ওটায় আছে আমার চয়েসের দুই গান – টেনশন হলেই আমি ব্যাকগ্রাউন্ডে চালিয়ে দিই। প্রথমটা – ঝোলাভরা ঘি।”
“অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ! হোয়াই নট ঝো-লা-ভ-রা-ঘি-ই-ই? ইস্টুম-খিস্টুম – রাইফেল-মাইকেল – আগডুম-বাগডুম – বোঁচকা বেঁ-ধে-ছি-ই। হোয়াই নট ঝো-লা-ভ-রা-ঘি-ই-ই?”
“ইন্টারেস্টিং! আর দ্বিতীয়টা?”
“ওটা হচ্ছে – শুঁ-ট-কি শ্যামলী-ই! বোধহয় শোনোনি। তবে ফাটাফাটি হিট! জানো, একটা হোটেলে এই গানদুটোর কোনটা বাজবে তাই নিয়ে ঝগড়া করতে করতে দুটো লোক গোলাগুলি চালিয়ে দিয়েছিলো।”
“জবাব নেই – তবে মনে হচ্ছে এতেই হবে। বা-ই, আবার আসবো।” হাত নেড়ে ভ্যানিশ হয়ে যায় সলমা।

সলমা আবার এসেছিলো। আর খুশি হয়ে জানিয়ে গেছে – সে দারুণ টেনশনে আছে। হরি পোদ্দার তার অ্যাদ্দিনের শিক্ষার গোড়া অব্দি ঘুলিয়ে দিয়েছে। এখন কিছু ভাবতে গেলেই টেনশন হয়। আর ঝোলাভরা ঘি ইত্যাদি তার মাথার ঘিলু অব্দি নড়িয়ে দিয়েছে। সুপার-বোর হবার উপক্রম হলেই সে ডিভিডি চালিয়ে উদ্দাম নাচতে শুরু করে আর প্রায়ই টেনশনে মুচ্ছো যায়। অভিও কথা দিয়েছে এগুলো শেষ হলে সে আবার নতুন নতুন টেনশনের জোগান দেবে।
অভি শিখেছে – জীবনে টেনশন আসবে, কিন্তু তা নিয়ে টেনশন নিতে নেই। কারণ, জিরো টেনশন মানে লাইফ আলুভাতে। এই ব্রহ্মজ্ঞান হবার পর সে দিব্যি আছে, মস্তিতে আছে।


অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।