খেলাঘরখেলাঘর

সরল ও হাতি
সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে দিতে চায় নি, ক্ষেতের কাজে সরল আজকাল বেশ পোক্ত হয়েছে যে। কিন্তু পঞ্চায়েত থেকে বলেছে সব ছেলেমেয়েকে ইশকুলে পাঠাতেই হবে। ইশকুলের মাইনে, বইখাতা সব নাকি গরমেন্ট দেবে । দুপুর হলে পেট ভরে খিচুড়ি খেতেও দেবে । সেই শুনে বাবু রাজি হয়েছে । এমনিতে তো সরল সেই ছোট্ট থেকে সকাল হলেই বাবুর সঙ্গে আর দাদাদের সঙ্গে ক্ষেতের কাজ করতে যায় । দুপুরে একবার বাড়ি এসে বাবুর জন্যে, দাদাদের জন্যে ভাত নিয়ে যায় । ক্ষেতের কাজে ভারি মজা । শুকনো মাটিতে নিড়ানি দাও, শুকনো পাতা মাথায় করে ফেলে এসো, ঝারি করে জল নিয়ে গাছকে চান করিয়ে দাও । দু’সন ভালো ধান হয় নি । সে নিয়ে গাঁয়ের সবাই খুব ভাবনা করেছিল । এবছর ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তাই এমনিও বাবুর মেজাজ ভালো আছে । প্রথমে রাজি না হলেও সব শুনে টুনে  বলল, ‘আচ্ছা, সরল ক’বছর ইশকুলে যাক না হয় । একজনের একবেলার খাওয়াটাও হবে ।‘
গরমেন্ট কে সরল জানে না । কিন্তু মনে মনে গরমেন্টকে প্রণাম করেছে সরল । গরমেন্ট নিশ্চয় একজন খুব ভালো লোক । তাই তো সরলের ইশকুলে যাবার সাধ মিটল ।
মাঝিপাড়ার পবন, গুলু, সোরেন আগেই ইশকুলে যাওয়া শুরু করেছে । সরলদের পাড়া থেকে সরল আর গণেশ ওদের সঙ্গেই চলে যাবে, বাবু বলে দিল । জেলেপাড়া নামোপাড়া থেকেও ক’জন ছেলে আছে । আট-দশজনের একটা দল । ইশকুল অনেক দূর । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আট দশ মাইল গেলে পাকা সড়ক । হাইওয়ে বলে সড়কটাকে, এখন জানে সরল । সেই হাইওয়ে ধরে আরো দু’মাইল প্রায় । তারপর দূর থেকে ইশকুল বাড়ি দেখা যায় ।
ইশকুলটা একটা ছোট পাহাড়ের ওপর । পাহাড়ের ঢালুতে একটা মস্ত জারুল গাছ । তার ঠিক পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, একেবারে ইশকুলের ফটক পর্যন্ত । ফটকের পাশে খেলার মাঠ, তার ওপর বালি ছড়ানো । আর ফটক দিয়ে ঢুকলেই ফুলের বাগান । লাল নীল হলুদ বেগুনী ফুলে ঝলমলে বাগানটায় ঢুকলেই সরলের মন ভালো হয়ে যায় ।

যাওয়ার গোটা পথটা মন ভালো করা । জঙ্গলের মধ্যে রোদ ঢোকে না, ছায়া ছায়া রাস্তা ধরে দৌড়ে দৌড়ে যায় সবাই মিলে । হলুদ সবুজ কত প্রজাপতি, বনের গাছে গাছে কত পাখির ডাক । গাছের পাতায় নানারকম সবুজ, হালকা সবুজ, ঘন সবুজ, হলুদ ছোপ ছোপ সবুজ, কালচে সবুজ । জোরে জোরে বাতাস বয়, রাশি রাশি পাতা গাছ থেকে টুপটাপ পড়তে থাকে মাথায়, মুখে । সবাই মিলে খোলা গলায় হাসে । বেশি জোরে হাসা, কথা বলা বারণ । বনদেবতা রাগ করবেন ।
বনের মধ্যে এক জায়গায় খোলা একটুখানি জায়গা আছে । সেখানে রোজ সরলরা একটুক্ষণ বসে । ঠিক মুখোমুখি একটা লেবুগাছ, তার পাতার নিচে মস্ত আটকোণা মাকড়সার জাল । সেই জালে রোদ্দুর পড়ে কেমন সোনালি চিকচিকে রঙ হয়, সেইটা রোজ দেখে সরল । খুদে খুদে জানোয়াররা ঘুরে বেড়ায়, মেঠো ইঁদুরগুলো সরলদের দেখে লুকিয়ে পড়ে । একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটে সরলরা ।
পাকা রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে একটা বড় শিমুল গাছ । সেই গাছটার ডালে বোলতারা মেটে রঙের মস্ত চাক বেঁধেছিল । গণেশের বড়জ্যাঠা একদিন বাঁশের আগায় মশাল বেঁধে সেই চাকে আগুন ধরিয়ে দিল । জ্বলতে জ্বলতে চাকটা মাটিতে পড়ল, আর কত কত বোলতা সেই আগুনে পুড়তে লাগল, রাগে আওয়াজ করতে করতে চারদিকে উড়তে লাগল । সরলদের সবার হাতে বড় বড় পাতাসুদ্ধ ডাল ধরিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা আগেই । ওরা সমানে সেই পাতাগুলো নিজেদের চারদিকে ঘোরাচ্ছিল । নইলে বোলতার হুল । বাব্বা ! ফুলে ঢোল হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে ব্যথা । সেই চাকভাঙা মধু নিয়ে সন্ধেবেলা সরলদের পাড়ায় কত হুল্লোড় হল ।
                      
দুদিন ধরে সরলদের গ্রাম থেকে কেউ ইশকুলে যাচ্ছে না । একটা বুনো হাতি এসেছে । কদিন আগে সরলদের পাশের ক্ষেতে এসে সব ধান খেয়ে চলে গেছে । প্রতিবছরই হাতি এসে ফসল খেয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু হাতিদের আসার সঙ্গে গ্রামবাসীদের একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে । পরবের আগে কোনোদিন এ গ্রামে হাতি আসে নি । এবার হাতি শুধু আগে আগে আসে নি, প্রায় আট দশজনের ক্ষেতের ধান নষ্ট করেছে, ধান খেয়েছে, রাগে ক্ষেত মাড়িয়ে দিয়েছে ।
খবর পেয়ে তীরধনুক, মশাল, ক্যানেস্তারা, পটকা নিয়ে ছুটে গেল সবাই । তখন হাতি পালিয়ে গেল । কি রাগ, কি ভয়ানক চিৎকার, গোদা গোদা পায়ে সব ধান মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ।
কি ভাগ্যি, সরলদের ক্ষেতের ধানে সেদিন পা পড়ে নি হাতির । সেই থেকে সারাদিন ধরে, সারারাত জেগে গ্রামসুদ্ধ লোক ক্ষেত পাহারা দিচ্ছে । মশালের আগুনে হাতি ভয় পায়, পটকার আওয়াজেও ভয় পেয়ে পালায় । শুধু একদিন ক্যানেস্তারা বাজাতে বাজাতে সিধুজ্যাঠা বনের কাছ পর্যন্ত চলে গেছিল, সেদিন হাতিটা রেগে গিয়ে সিধুজ্যাঠাকে তাড়া করেছিল । আর একদিন পবনের ছোট ভাইটাকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দিয়েছিল, ভাগ্য ভালো প্রাণে বেঁচে গেছে, হাত ভেঙে পিঠের হাড় ভেঁঙে সদরের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ।
সবাই বলছে, ‘হাতিটা পাগলা হয়ে গেছে ।‘
পঞ্চায়েত অফিস থেকে কেরোসিন দিয়েছে, পটকা দিয়েছে । গাঁয়ের লোক গিয়ে বনদপ্তরে হাতির নামে নালিশ লিখিয়ে এসেছে । কিন্তু এখনও পাগলা হাতিকে ধরা যায় নি । ফরেস্টার বাবুরা এসে বন্দুক নিয়ে আকাশে গুলি ছুঁড়ে, ক্যানেস্তারা বাজিয়ে হাতি খেদিয়ে দূরের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে যায় ।
কোথায় লুকিয়ে থাকে হাতি কে জানে, ফরেস্টারবাবুরা চলে গেলেই এসে গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার মুখের অর্জুনগাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায় । খুব বুদ্ধি হাতির । মুন্ডাপাড়ার দিকে লোকজন পাহারা দিচ্ছে,  হাতি মাঝিপাড়ার দিক দিয়ে এসে তান্ডব করে যায় ।
কদিন আগে কার্তিকদের ঘরের চাল উপড়ে দিয়ে গেছে । একদিন রাস্তার ওপর একটা গরুর গাড়ি উলটে দিয়েছে । দিন নেই, রাত নেই, কখন হাতি আসবে সেই ভয়ে গ্রামসুদ্ধ লোক অস্থির । ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছে । মুখে মুখে গল্প ঘুরছে । সেই যেবার বাদনা পরবের পরে মাঝিপাড়ার অমন জোয়ান ছেলেটাকে হাতি মেরে ফেলেছিল । এই তো গত বছর পাশের গাঁয়ের মোহন টুডুর একমাত্র কচি ছেলেটাকে শুঁড়ে করে আছড়ে মেরে ফেলেছিল ।

দেখেশুনে গাঁয়ের সবাই ঠিক করেছে, এখন আর সরলদের ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই । কখন হাতি তাড়া করবে কে জানে । বুনো হাতি এমনিই ভয়ঙ্কর, তার ওপর এ হল পাগলা হাতি । একেবারে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে ।