খেলাঘরখেলাঘর

সরল ও হাতি
 
ইশকুলে যাওয়া হচ্ছে না বলে সরলের খুব মনখারাপ । কত মজা হয় ইশকুলে । গরমেন্ট শুধু বইখাতা দেয় নি, ড্রয়িংবই ড্রয়িংখাতা আর রঙপেন্সিলও দিয়েছে । সেই খাতায় ইশকুলে বসে কত ছবি আঁকে সরল । বাড়িতে বসে বসে এত ছবি এঁকেছে সরল যে ড্রয়িংখাতার সব পাতা শেষ । ইশকুলে গেলে তবেই তো আর একটা ড্রয়িংখাতা পাবে !
তাছাড়া ভূগোল ক্লাসটার জন্যেও মনখারাপ করে । ভূগোল সবচেয়ে ভালো লাগে সরলের । মাস্টারমশাই কি সুন্দর দেশ বিদেশের গল্প বলেন । একটা লম্বা রঙচঙে কাগজ দেখিয়ে যেদিন বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখ, এইটা হল আমাদের দেশ’; সেদিনের কথাটা স্পষ্ট মনে আছে সরলের । দেশ মানে ভারত, সেইটা আগে থেকেই জানত । কিন্তু ভারত যে ওই কাগজটাকে বলে সেইটা জেনে তো সরল অবাক । তারপর মাস্টারমশাই বললেন, ‘এইটাকে মানচিত্র বলে ।‘ সেই মানচিত্রে নাকি ভারতের সব জায়গার নাম আছে । একেবারে ডান দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে এইটা গঙ্গা, এই হল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ .. আর এই দ্যাখো পুরুলিয়া, এইখানেই আমাদের কুলহি গ্রাম ।‘
অনেক খুঁজেও কুলহি নাম দেখতে পায় নি সরল, তখন মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, কাছাকাছি কোনো বড় জায়গার নাম দিয়ে বুঝতে হবে । সব ছোট ছোট জায়গার নাম তো থাকে না, শুধু রাজধানী বা বড় শহরের নাম থাকে । আর কোনো জায়গায় যদি কোনো দর্শনীয় জিনিস থাকে কিংবা কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই জায়গার নাম থাকে ।
ইস, সরলদের গ্রামে যদি একটা স্মরণীয় ঘটনা হত !
আর এখন তো ইশকুলেই যাওয়া হচ্ছে না । খুব মনখারাপ করে সরলের ।
                   
সাত দিনেও কোনো সুরাহা হল না । আজ সকালে ক্ষেতে যাবার নাম করে বেরিয়েছে সরল । গাঁয়ের সব পুরুষমানুষ হয় ক্ষেতের কাছে নয় বনের দিকে পাহারায় । নদীর দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সরল । রাস্তা তো চেনাই আছে । পলাশ গাছটার পাশ দিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়বে । হাতি এলে কোথায় লুকিয়ে পড়বে তাও ঠিক করে নিয়েছে মনে মনে । যেমন করেই হোক, আজ ইশকুলে যাবেই ।
বনের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি এক ছুটে পেরিয়ে এসে মাকড়সার জালের কাছে এসে বসল সরল । আর একটুখানি । ওই আমলকি গাছটার পাশ দিয়ে গেলেই একটা জলা, জলা পেরোলেই শালগাছের বন, সেইটা পেরোলেই শিমুলগাছ । তারপরেই বড় রাস্তা । জলার কাছ পর্যন্ত ভালোভাবেই পেরিয়ে এল । তারপরই থমকে দাঁড়িয়েছে । কালো পাহাড়ের মতো বড় হাতিটা । জল খেতে এসেছিল নিশ্চয় । জল খেয়ে হাতিদের নুন খেতে হয় । হাতিটা জলার পাশের মাটি চাটছে । সরল জানে, ওটা নোনা মাটি । ওই জলায় জল খেয়ে সব ছোট বড় জানোয়ার মাটি চাটে । পাগলা হাতি মাটি চাটায় ব্যস্ত, সরলকে দেখতে পায় নি ।
পাশেই একটা বুড়ো মস্তবড় শিশু গাছ । একটুও আওয়াজ না করে সরল তরতর করে শিশু গাছে উঠে গেল । একটা পাতাওয়ালা ডাল দেখে লুকিয়ে বসল তারপর । সেইটুকু আওয়াজেই হাতি মুখ তুলে তাকিয়েছে, ভাগ্যিস সরলকে দেখতে পায় নি । তবু কি ভেবে হাতিটা এগিয়ে এসে শিশুগাছে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে গেল । গাছের ডাল আঁকড়ে বসে রইল সরল ।
হাতি চলে যাবার পরও নামে নি । যদি হাতিটা আবার ফিরে আসে । পাগলা হাতি পলকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দেবে ।
দেখতে দেখতে বেলা কাটল আরো । হাতি কাছাকাছিই আছে । মাঝেমাঝেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে কালো শরীর দেখা যাচ্ছে । কতক্ষণ সময় কাটল কে জানে । সেই সকালে বেরিয়েছে সরল, সূর্য এখন মাথার ওপর । খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে । শিশুগাছে না উঠে পাশের মহুয়া গাছটায় উঠলে ভালো হত । ছোট ছোট ফলে ও গাছটা ভরে আছে । তখন অত দিকে খেয়াল হয় নি ।
সরলের একটু একটু ভয় করছে । এমনিতে গাঁয়ের লোকজন এ রাস্তায় আসে, কিন্তু এখন হাতির ভয়ে কেউ আসছে না । কেউ যদি না আসে ! বাড়ি ফিরবে কি করে !
পাশের ডালে খুব ছোট একটা হনুমান, গায়ে একটু একটু লোম, কুচকুচে মুখ, পিটপিট করে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে বকতে লাগল সরলকে । যেন বলছে, ‘এটা আমার বাড়ি, তুই এখানে কেন ?’
আওয়াজ শুনে হাতিটা না ফিরে আসে । সরল চোখ পাকিয়ে তাকালো । তাতে রেগে গিয়ে হনুমানটা ভেংচি কেটে দিল । খানিক পরে একটা বড় হনুমান এসে ছোট হনুমান্টাকে মুখে করে তুলে নিয়ে গেল ।
যাক বাবা । মা-হনুমানটা ভাগ্যিস রাগ করে নি !

আরো খানিকক্ষণ পরে কালো শরীরটার নড়াচড়া দেখতে পেল সরল । কি একটা টেনে আনছে হাতিটা । একটু করে আসছে, আর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করছে । সে কি চিৎকার । ভয়ে সরলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল । হাতিটা খুব রেগে আছে । কি হবে এবার ?
একবার মহুয়া গাছের ডালটা হাওয়ায় সরে যেতেই হাতিটাকে দেখতে পেল । একটা বাচ্চা হাতিকে টেনে আনছে । মা-হাতি একটু করে টেনে আনছে, আর বাচ্চা-হাতিটা বেজায় চিৎকার করছে । সেই শুনে মা-হাতি আরো জোরে চিৎকার করছে । বাচ্চা-হাতির পায়ে লেগেছে বোধ হয়, চলতেই পারছে না । আহা রে, ওর পা ভেঙে গেছে ।
এবার বুঝেছে সরল । মা-হাতিটা মোটেই পাগল নয় । বাচ্চার পায়ে লেগেছে বলে ওরা দুজনে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে । দলের সঙ্গে হেঁটে যেতে পারে নি । কেউ কাছে এলেই মা-হাতি ভাবে ওর বাচ্চাকে মারতে আসছে বুঝি, তাই তেড়ে যায় । বোধহয় সরলদের গ্রামের কাছেই ছিল এতদিন, তাই গ্রামে ঢুকে তান্ডব করত যাতে কেউ ওদিকে না যায় । হাতি খেদানোর দল এলে তাই হাতি তাড়া করত ।
               
মা-হাতি বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, সেই ফাঁকে আস্তে গাছ থেকে নেমে পড়ল সরল । তারপর এক ছুটে গ্রামে । গ্রামের লায়াবুড়ো অনেকরকম ওষুধ জানে । দিকুমাঝির ঠাকুমাও জড়ি বুটি দিয়ে অনেক রোগ সারায় । তারপর বাবুকে রাজি করিয়ে গ্রামের লোকজনকে বুঝিয়ে আনা কম ঝক্কি !
চুপি চুপি গাছের আড়াল দিয়ে হাতির কাছ পর্যন্ত পৌঁছবার আগে হাতিও টের পায়নি ।
কাছে গিয়েই সরল মা-হাতিটার পিঠে চড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল । লায়াবুড়ো আর ঠাকুমা ওষুধ নিয়ে বাচ্চা-হাতির পায়ে লাগাতে বসল । ওষুধ দিয়ে মোটা কাপড় দিয়ে বাঁধা, একটু একটু করে পাতলা ওষুধ খাওয়ানো, অনেক সময় লাগল । বাচ্চা-হাতি প্রথমে ছটফট করছিল, একটু পরে শান্ত হয়ে মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল । বাবু মাথাটা কোলে নিয়ে বসল । মা-হাতি কি বুঝল কে জানে, কাউকে তেড়ে গেল না, চিৎকারও করল না, বরং চোখ বুজে সরলের আদর খেতে লাগল ।
লোকজন মিলে বাচ্চা-হাতিকে তুলে গ্রামে নিয়ে আসা হল । মা-হাতি সরলকে পিঠে নিয়ে শান্ত হয়ে গ্রাম পর্যন্ত এল । কতদিন ধরে বাচ্চা-হাতি ওদের গাঁয়েই থাকল তারপর । মা-হাতি জঙ্গলে থাকত, আর রোজ একবার এসে বাচ্চাকে দেখে যেত । একদিনও ক্ষেত মাড়ায় নি, কাউকে ভয় দেখায় নি ।