খেলাঘরখেলাঘর

ইলিশ

মাসির বাড়ি যাবার কথা শুনলে বুম্বা ও টুলু নাচতে থাকে তাই রথের সময় মাসির বাড়ি যাবার প্ল্যান হয়েছে শুনে তো ওরা আনন্দে আত্মহারা – বুম্বা তখনই ক্যালেন্ডার দেখে বলে দিলো আর মাত্র চার দিন। তবে চার দিনও যে কাটতে চায় না – স্কুল থেকে ফিরেই দুজনে মায়ের পেছনে ঘুরছে – কখন বেরুতে হবে, কদিন থাকবো ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নে লতিকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। বুম্বা ও টুলুর মত লতিকা আর ওর ছোট বোন বিথীকা বছর দুয়েকের ছোট বড় আর দুই বোনে ভীষণ ভাব। প্রায় রোজই ফোনে ঘন্টা খানেক গল্প হবেই তাতেও মনে হয় স্বাদ মেটে না – তাই ছেলে মেয়েদের মত লতিকার মনেও খুসির জোয়ার। ওদের বর অতনু ও সোহম বা সমু আবার কলেজের বন্ধু – বুম্বা ও টুলু সমুকে মেসোকাকু বলেই ডাকে। সমু ও বিথীর মেয়ে ময়না বয়সে প্রায় টুলুর সমান তাই দেখা হলেই ওদের আর আলাদা করা যায় না – খাওয়া, শোয়া সবই প্রায় একই সাথে – দুজনেই আবার বুম্বাদাদার ভীষণ ভক্ত। সমু এখন সেচ বিভাগের কুলপি অফিসের বড় ইঞ্জিনিয়ার – এবার রথযাত্রার ছুটির সাথে শণি রবিবার ইত্যাদি মিলিয়ে দিন চারেকের ছুটি তাই সমু ফোন করেছিলো ওদের চলে আসার জন্য। এই সময়ের ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে খুব ইলিশ মাছ উঠছে গঙ্গাতে আর এটা ইলিশ মাছ খাওয়ার নিমন্ত্রণ তাছাড়া অন্য প্ল্যানও আছে তবে সেটা খোলসা করে বলে নি। কুলপি ডায়মন্ড হারবার ছাড়িয়ে আরও নিচে গঙ্গার ধারে ডিষ্ট্রিক্ট টাউন আর ওখানকার সেচ বিভাগের মাথা হচ্ছে সমু অতএব দুবার ভাবার ব্যাপারই নয়। অতনুরা ভেবেছে এবার নিজেদের গাড়ি নিয়েই যাবে – ডায়মন্ড হারবারের রাস্তাটা ভালোই – ভোর ভোর বেরুলে ঘন্টা ছয়েকের মধ্যে পৌছে যাবে।
যাবার আগের দিন থেকেই বুম্বা ও টুলুর ভীষণ উত্তেজনা – রাত্রে ঘুম আর আসতে চায় না – ঘন্টায় ঘন্টায় উঠে ঘড়ি দেখছে – শেষে মার ঘড়ির এলার্ম বাজার আগেই দুজনে উঠে চান টান করে একেবারে জুতো মোজা পরেই ঘর থেকে বেরিয়েছে। লতি তো হেসে অস্থির – অতনুকে ডেকে বললো,
‘তোমার ছেলে মেয়েকে দ্যাখো – মাসির বাড়ি যাবার জন্য কাক ভোরে উঠে দুজনেই রেডি আর স্কুলের দিন হলে তো বিছানা থেকে টেনে তোলাই মুস্কিল। তা হলে আর দেরি কেন – বেরিয়ে পড়লেই হয় – রাস্তায় কোথাও চা টা খেয়ে নেওয়া যাবে।’
ছটার আগেই ওরা বেরিয়ে পড়লো – সুন্দর রাস্তা আর এত ভোরে প্রায় ফাঁকা। ঘন্টা খানেক পর একটা ছোট জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মাটির ভাড়ে চা আর ল্যাড়ে বিস্কুট খাওয়া হলো। তারপর ডায়মন্ড হারবার শহরে কচুরি ও গরম জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট। এর মধ্যে সমুর ফোন – ন্যাসনেল হাইওয়ে থেকে ওদের বাড়ি পর্যন্ত মাইল দশেক রাস্তা বৃষ্টিতে খারাপ হয়ে খানা খন্দে ভরে আছে – ওখানটা অতনু যেন সাবধানে চালায় আর গাড়ির জানালা যেন অবশ্যই বন্ধ রাখে না হলে ট্রাক কিংবা বাস কাদা ছিটিয়ে একাকার করবে। কুলপির রাস্তায় ঢুকে গাড়িতে আর স্পিড দেওয়া যাচ্ছে না – গাড়ি, বাস, ট্রাকের সাথে গরুর গাড়ি, মোষ, ছাগল সবই চলেছে তার মধ্যে আবার ঝির ঝির বৃষ্টির শুরু। এর মধ্যে একটা ট্রাক ওদের পাশ কাটাবার সময় গাড্ডায় পড়ে ওদের ছোট্ট গাড়িকে একেবারে কাদা স্নান করিয়ে দিয়েছে – ভাগ্যিস সমুর কথা মত গাড়ির জানালা বন্ধ ছিলো। অবশেষে প্রায় একটা নাগাদ ওরা সমুদের বাড়ি পৌছালো। গাড়ির আওয়াজে প্রথমেই ময়না দৌড়ে বেড়িয়ে এসে টুলুর গলা জড়িয়ে ধরেছে – এর মধ্যে বিথী ও সমুও এসে গিয়েছে – টুলু ও ময়নার মত লতি বিথীও পারলে গলা জড়িয়ে নাচ শুরু করে। বেচারি বুম্বা গম্বীর মুখে গাড়ির ডিকি থেকে সুটকেস দুটো বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সমু তাড়াতাড়ি বুম্বাকে হাত ধরে নিয়ে এসে বিথীকে বললো,
‘তোমরা কিন্তু এ বেচারিকে পাত্তাই দিচ্ছো না – এটা অন্যায়।’
বিথী দিদিকে ছেড়ে এসে বুম্বাকে জড়িয়ে ধরলো,
‘আমার বুম্বা দাদার রাগ হয়েছে বুঝি – এবার মাছি তোকে আর ছাড়বে না। চলো, চলো সবাই ভেতরে চলো তো – এই ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে আর ভিজতে হবে না। এই দুই মেয়ে – তোরা কি বাইরেই নাচবি না ভেতরে আসবি?’
সমু হাসলো,
‘আয়, আয় সবাই ভেতরে আয় – বাচ্চাদের তো ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছে – তাই না রে বুম্বা। তোদের জন্য স্পেশাল অর্ডারে আজ সকালে এখানকার মাছের সব থেকে বড় আড়তদার ইয়াসিন মল্লিক একটা আড়াই কিলোর ইলিশ দিয়ে গিয়েছে – এই চওড়া পেটি – এ রকম বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দারুণ জমবে। কি রে বুম্বা, ইলিশ মাছ তো তোর ভীষণ প্রিয় – তোর জন্য সব থেকে বড় পেটি গুলো মাসি রেখেছে।’
হাত মুখ ধুয়ে সবাই খাবার টেবিলে – বিথী টেবিল গুছিয়েই রেখেছিলো – ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি থালায় সাজিয়ে দিলো সেই সাথে ইলিশ মাছ ভাজা – যত ইচ্ছে।
‘এ্যাই দিদি, তোর আর আমার কিন্তু প্রথমে সাদা ভাত – ইলিশ মাছ ভাজার তেলটা আলাদা করে রেখেছি আর মুড়োটা একেবারে কুড়কুড়ে ভাজা।’
‘অপূর্ব, এই না হলে আমার বোন – কত দিন ইলিশ মাছ ভাজার তেল দিয়ে ভাত খাইনি রে আর তার সাথে কুড়কুড়ে মুড়ো ভাজা – আহাঃ।’
অতনু একটু চিমটি কাটলো,
‘লতি একটু সামলে – না হলে জিভের জলে যে টেবিল ভেসে যাবে।’
টুনু ও ময়নার মাছ বেছে দিতে দিতে বিথী বললো,
‘আর বদমাইসি না করে খাওয়াতে মন দাও তো তনুদা – সব ঠান্ডা হয়ে গেলো। দেখ তো বুম্বা কেমন লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে যাচ্ছে।’
খেতে খেতে সমু ওর অন্য প্ল্যানটা বললো – কাল সকালে ওরা লঞ্চে করে সুন্দরবন বেড়াতে যাবে। সব ঠিক হয়ে গিয়েছে – লঞ্চে রান্না, খাওয়া, শোওয়া সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। কপাল ভালো হলে সুন্দরবনের মহারাজের সাথেও দেখা হতে পারে। বড় মাঝি কাদের মিঞা আরো দুজন বিশ্বাসী মাঝিকে সঙ্গে নেবে। বুম্বা ও টুলু খাওয়া বন্ধ করে হাঁ হয়ে সমুর কথা শুনছিলো – টুলু জিজ্ঞেস করলো,
‘মেসোকাকু, মহারাজটা কে?’
বুম্বা গম্বীর মুখে উত্তর দিলো,
‘এটাও জানিস না? সুন্দরবনের মহারাজ হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার – চিড়িয়াখানায় দেখিস নি? মনে নেই ওটা ডাকতে তোর কি হয়েছিলো – বলবো?’  
‘এই দাদা, একদম না – তাহলে কাট্টি হয়ে যাবে কিন্তু।’
ওদের খাওয়া শেষ হতে না হতেই কাদের মিঞা এসে খবর দিয়ে গেলো লঞ্চ রেডি আছে – চাল, ডাল, তরি তরকারির সাথে দুটো মুরগি ও ডিজেল তুলে নিয়েছে। কাল সকালে জোয়ারের পরে সকাল আটটা নাগাদ রোওয়ানা হবে। ভর দুপুরে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভূরিওভোজের পর সবারই ঢুলুনি এসে গিয়েছে – সমু ও অতনু তো সোজা বিছানাতে। বাচ্চারাও একটু সময় এদিক ওদিক করে আর জেগে থাকতে পারলো না তবে লতি ও বিথী বিছানাতে শুয়ে শুয়ে নিজেদের গল্পে মেতে রইলো।