খেলাঘরখেলাঘর

 

ইলিশ

পর দিন সকালে পাওরুটি মাখন আর ডিম সেদ্ধ খেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লো গঙ্গার ঘাটের দিকে। নৌকা দেখে বুম্বা অবাক – কত বড় তার মধ্যে আবার ঘরও আছে – ওপরে রেলিং দেওয়া ছাত তাতে আবার চেয়ার টেবিল পাতা। গঙ্গাতে স্রোত বেশ – নদী কি বিরাট চওড়া এখানে – ওপাড় প্রায় দেখাই যায় না। স্রোতে নৌকা বেশ দুলছে – কাদের মিঞা ওদের হাত ধরে কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে নৌকাতে নিয়ে এলো। লতির বেশ ভয় ভয় করছিলো – এই প্রথম নৌকাতে চড়েছে তার ওপর কি স্রোত রে বাবা – বার বার বাচ্চাদের সাবধান করছিলো,
‘তোরা একদম রেলিং এর পাশে যাবি না কিন্তু।’
কাদের মিঞা হেসে বলল,
‘ভয় পাইয়েন না মা ঠাকরান – আমরা আছি – কিছু হইবো না।’
জিনিষ পত্র নিচে রেখে সবাই ছাতে গিয়ে বসতে কাদের মিঞা বদর বদর বলে নৌকার গলুইতে নদীর জল ছিটিয়ে হাল ধরলো আর এক জন মাঝি নৌকার কাছি খুলে দিতেই স্রোতের টানে নৌকা পাড় থেকে খানিকটা দূরে এসে কাদের মিঞার হালের কেরামতিতে হেলতে দুলতে এগিয়ে চললো। গঙ্গার জল বেশ ঘোলা আর ঢেউ গুলো ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পাড়ে এসে ধাক্কা দিচ্ছে – মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে তাই গরম একেবারেই নেই। আকাশে নানা রঙ্গের মেঘে ভেসে চলেছে – কোনটা ধূসর, কোনটা কালচে আর ওদের মাঝে সাদা মেঘেরাও মিলে মিশে চলেছে ঘাড়ে ঘাড় মিলিয়ে তবে বাঁচোয়া যে বৃষ্টি নেই। নদীর পাড়ে গাছ পালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝেই দেখা যায় ছোট ছোট গ্রাম – মাটি কেটে নারকেল গাছ ফেলে তৈরি হয়েছে নদীর ঘাট – মাছ ধরার নৌকা গুলো ঘাটের কাছেই বাঁধা আর তার আশে পাশে বেশ কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাছ ধরার জাল গুলোকে কয়েক জন পরিষ্কার করছে নদীর ধারে। কাদের মিঞা বললো, ভোর বেলা মাছ ধরে জেলেরা ফিরেছে এখন পাইকারি ক্রেতারা দাম দর করছে মাছ কেনার জন্য। নদীতে কত ছোট বড় নৌকা চলেছে – নদীর মাঝখান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে স্টিমার চলেছে বেশ কয়েকটা। একটু পর দূর থেকে একটা মস্ত বড় জাহাজ আসতে দেখা গেলো – ওটাকে সম্ভ্রম দেখিয়েই বোধ হয় সব কটা নৌকা, স্টিমার সরে গেলো নদীর মাঝখান থেকে। জাহাজটা কাছে আসতেই আসল কারণটা বোঝা গেলো - জাহাজের পেছনের টার্বাইন ব্লেডের ধাক্কায় সাদা ফেনা ছড়িয়ে বেশ বড় বড় ঢেউ উঠে দুদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আর তার ধাক্কায় ছোট ছোট নৌকা গুলো বেশ জোরেই দুলে উঠলো এমন কি একটু পরেই ওদের নৌকাকে দুলিয়ে ঢেউ গুলো পাড়ে আছড়ে পড়লো। কাদের মঞা বললো,
‘বিদেশের জাহাজ – অনেক মাল নিয়া চলছে ডায়মন্ড হারবার। আপনাগোর কোলকাতায় এত বড় জাহাজ যাইতে পারে না নদীর পলির জন্য।’
চারদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে কি করে সময় কেটে যাচ্ছে বোঝাই গেলো না – এমন কি লতি বিথীও গল্প করা ভুলে গিয়েছে। দুপুরের খাবার আসতে বোঝা গেলো প্রায় একটা বাজে – একটু লালচে চালের ভাত, ঝুর ঝুরে মৌরালা মাছ ভাজা, পেঁয়াজ দিয়ে মশুর ডাল আর শুকনো শুকনো করে রান্না মুরগির মাংস। কাদের মিঞা বললো,
‘সকালে মৌরালা মাছ পাইয়া গেলাম – দ্যাখেন মা ঠাকরানরা খালেদ ভাই কেমন রান্না করলো। পোলাপানের জন্য মরিচ একেবারেই দেয় নাই।’
এই অপূর্ব পরিবেশে খাওয়াটাও অপূর্ব লাগছে – গঙ্গার বুকে চলতে চলতে এই খাওয়া ভাবাই যায় না। বহুদিন পর লতিরা এই রকম মৌরালা মাছ ভাজা খেলো আর মুরগি রান্না তো যে কোন বড় হোটেলের সাথেই পাল্লা দিতে পারে। সমু আস্তে করে লতিকে বললো,
‘এই জন্যই কাদের মিঞাকে নেওয়া – ও ঠিক বুঝতে পারে আমাদের জিভ।’