খেলাঘরখেলাঘর

ইলিশ

 

 

খাওয়া দাওয়ার পর সবাই বিশ্রাম করতে গেলেও বুম্বা ছাত থেকে নামলো না – ওখানে বসে বসেই কাদের মিঞার সাথে কত গল্প আর ওর হাজারো প্রশ্নের উত্তর কাদের মিঞা হাসি মুখে দিয়ে গেলো। ওরা এখন সুন্দরবনের দিকে চলেছে – নৌকা গঙ্গা থেকে সরে একটা খাড়ির মধ্যে চলে এসেছে। আস্তে আস্তে দুই পাড়ের চেহারাও পালটে যাচ্ছে বাঁ পাড়ে ধান ক্ষেত, গ্রাম দেখা গেলেও ডান দিকে জঙ্গল। কাদের মিঞা জানালো, এখানকার জলে বেশ বড় বড় কুমির আছে তবে তা থেকেও ভয়ের হলো কামট বা ছোট হাঙ্গর – নদীর ঘাটে সাবধানে দেখে শুনে জলে না নামলে টের পাবার আগেই হাত বা পা কেটে নিয়ে যাবে। বুম্বা অবাক হয়ে ভাবছিলো কাদের মিঞা কি করে নদীর রাস্তা মনে রেখেছে – এক খাড়ি থেকে আর এক খাড়িতে এঁকে বেঁকে চলেছে – বুম্বার কাছে সবই তো সমান মনে হচ্ছে। অবশ্য ডান দিকের জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে এসেছে – এদিকের খাড়িতে বিশেষ নৌকা দেখা যাচ্ছে না। ভাটার জন্য নদীর ধারে বিশেষ করে ডান দিকে ভীষণ কাদা আর তার মধ্যে লাঠির মত কি সব দাঁড়িয়ে আছে – শুধু পাড়েই নয় ওই ডান্ডা গুলো জঙ্গলের ভেতর দিকেও ছড়িয়ে আছে। কাদের মিঞা বললো এগুলো সুন্দরী গাছের শেকড় – জোয়ারের সময় অনেকটা জঙ্গলও নোনা জলে ডুবে যায় তাই শেকড় গুলো খাড়া ওপর দিকে দু তিন ফুট ওঠে আলো হাওয়ার জন্য। এখানকার সব গাছ পালা নোনা জলেই বেঁচে থাকে – এটাই সুন্দরবনের বিশেষত্ব। এর মধ্যে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে অন্য মাঝি বসির আলি একটা ছোট জাল বের করে নৌকার পেছন থেকে ঘুরিয়ে ছুঁড়তে ওটা খোলা ছাতার মত গিয়ে জলে পড়লো। বুম্বা তাড়াতাড়ি নৌকার পেছনে এসে দেখে বসির ধীরে ধীরে জালটাকে টেনে তুলছে আর তার মধ্যে বেশ কিছু ছোট বড় মাছ লাফাচ্ছে। এর মধ্যে খালেদ ভাইও এসে গিয়েছে – ওরা কিছু মাঝারি সাইজের মাছ বেছে নিয়ে বাকিদের জলে ছেড়ে দিলো।
দুপুরের দিবা নিদ্রার শেষে বিথী নৌকার ছাতে এসে অবাক হলো,
‘কি রে বুম্বা, তুই সারা দুপুর এখানেই বসে ছিলি?’
‘মাসি, কাদের মিঞার কাছে কত কিছু শিখলাম – জানো, আমরা এখন সুন্দর বনে চলে এসেছি – ওই যে কাদা আর জঙ্গলের মধ্যে লাঠি গুলো দেখছো ওগুলো কিন্তু সুন্দরী গাছের শেকড় – এখানের সব গাছপালা নোনা জলেই হয়।’
হঠাৎ কাদের মিঞা নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো,
‘দ্যাখেন, দ্যাখেন, এক দল হরিণ আইসে পানি খাইতে।’
সবার নজর ওই দিকে – গোটা দশ বারো হরিণ সজাগ চোখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে কাদা পেরিয়ে নদীর ধারে জল খেতে এসেছে। কি সুন্দর রং – সারা গায়ে হলুদ রঙের মধ্যে কালো বুটি বুটি আর এই বড় বড় টানা টানা চোখ – কয়েকটার আবার বড় বড় শিং আছে – চোখ ফেরানো যাচ্ছে না এত অপূর্ব দেখতে। জল খেতে খেতে ওরা মাঝে মাঝেই মুখ তুলে চার দিক দেখে নিচ্ছে – হঠাৎই একটা বড় শিংওয়ালা হরিণ ছট ফট করে কেমন একটা অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠতেই সব কটা হরিণ জল খাওয়া ছেড়ে লম্বা লম্বা লাফে কাদা পেরিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেলো। নৌকার পেছন থেকে খালেদ ভাই বললো,
‘ও কাদের মিঞা, কুমির আইসে – নৌকার ডাইনে দ্যাখেন।’  
সবাই তাকিয়ে দেখে একটা বড় কুমির পাড়ের কাদার গা ঘেঁসে জলে ভাসছে আর ওটাকে দেখতে পেয়েই হরিণদের সর্দার ওই ভাবে ডেকে উঠেছিলো। লতি ও বিথী শিউরে উঠলো,
‘চিড়িয়াখানায় দেখা আর এখানে দেখার মধ্যে কত তফাৎ।’
কাদের মিঞা ধীরে ধীরে বললো,
‘এত গুলান হরিণ এই খানে – মহারাজ কাছেই হইবেন – কি কও খালেদ ভাই?’
‘মনে তাই হয় মিঞা। এই সময়টা তো ওনার খুব প্রিয় – সব জন্তু জানোয়ার গুলান নদীতে পানি খাইতে আসে।’
সমু জিজ্ঞেস করলো,
‘কি কাদের মিঞা, মহারাজ দর্শন দেবেন নাকি?’
‘দেখা যাউক। ও খালেদ ভাই তুমি আর বসির আলি একটুকান বৈঠা টানো দেখি। মহারাজ বৈঠার আওয়াজটা পছন্দ করেন বলিয়াই তো জানি।’ 
বুম্বা অবাক হলো,
‘বৈঠার আওয়াজ কেন মেসোকাকু?’
‘বৈঠার আওয়াজ শুনে বাঘ বুঝতে পারে নৌকা চলেছে – শুনেছি নদী সাঁতরে এসে ছোট নৌকার ওপর অনেক সময় হামলা করে লোক তুলে নিয়ে গিয়েছে।’
লতি হয়ে কেঁপে উঠলো,
‘এই সমুদা, আমাদের নৌকায় হামলা করবে না তো? কাদের মিঞা তো বৈঠার আওয়াজে নিমন্ত্রণ করছে। তুমি বলো ইঞ্জিন চালিয়ে তাড়া তাড়ি এখান থেকে সরে যেতে। দরকার নেই মহারাজার দর্শনের।’
কাদের মিঞা হাসলো,
‘ভয় পাইয়েন না মা ঠাকরান – আমাগো বড় নৌকা – এই খানে উনি উঠতে পারবেন না। আর আমরা তো মাঝ নদীতে।’
হঠাৎই দূর থেকে একটা গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো। কাদের মিঞা বললো,
‘ওই শুনেন উনার হাঁক – মনে লয় অন্য দিকে চইলা গ্যাছেন শিকারে।’
বুম্বা টুলুর দিকে তাকালো,
‘কি রে টুলু, শুনলি তো মহারাজের হাঁক – তোর কিছু হয় নি তো?’
‘দাদা, আমি বড় হয়েছি – উলটো পালটা কথা বলবি না একদম।’
ধীরে ধীরে গোধূলির আলোতে জঙ্গলে আলো থেকে ছায়ার খেলা বেড়ে গেলো। হাজার হাজার নাম না জানা পাখীর ঘরে ফেরার আওয়াজে চারদিক ভরে গিয়েছে – গাছের ওপর ওদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আসছে। কাদের মিঞা জানালো আর একটু এগিয়ে খাড়িটা যেখানে অনেকটা চওড়া হয়েছে ওখানেই নদীর মাঝখানে আজ রাতের জন্য নৌকার নঙ্গর ফেলবে – অন্ধকারে নৌকা চালানো ঠিক হবে না। গোধূলির আলোর পর অন্ধকার খুব তাড়াতাড়ি নেমে এলো। বসির আলি গোটা তিনেক প্যাট্রমাক্স জ্বালিয়ে ছাতে, ঘরে আর নৌকার সামনে রাখলো আর সেই আঁধো ভূতুরে আলোতে কাদের মিঞা নৌকা এগিয়ে নিয়ে গেলো যেখানটায় খাড়িটা অনেকটা চওড়া আর নদীর বাঁ দিকে একটা গ্রামও দেখা যাচ্ছে – গ্রামের আলোগুলো জোনাকি পোকার মত চিক চিক করছে। সমু আস্তে করে বললো,
‘সুন্দরবনের আরও ভেতরে বোম্বেটেদের আনাগোনা আছে আর চোরা চালানকারীদেরও ফলাও ব্যবসা বাংলা দেশের সাথে। তবে এদিকে এখনও শোনা যায় নি।’ 
বিথী ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
‘কি দরকার ছিলো রাত্রে নদীতে থাকার। তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি – এখন ভালোয় ভালোয় কালকে বাড়ি ফিরে যেতে পারলে বাঁচি।’
কাদের মিঞা ভরসা দিলো,
‘ভয়ের কিছু নাই – ডাকাইতরা এই দিকে আসে না। বাংলা দেশেই বেশী জ্বালায়।’
রাত্রের খাওয়াটাও জমিয়ে হয়েছে – সরষে ইলিশ আর পার্শে মাছের ঝোল। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে ছাতে বসেই গল্প চললো। ডান দিকের জঙ্গল থেকে নানা রকম রাত জাগা পাখীর আওয়াজ আসছে – এই আঁধো অন্ধকারে কেমন যেন গা ছম ছম করা ভাব। পেট্রোমাক্সের আলো চার পাশের অন্ধকারকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের আলো গুলো এক এক করে নিভতে শুরু করেছে – চারদিকে কেমন যেন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। দূরে কোথাও হরিণের ডাক শোনা গেলো তারপরই আবার সেই হুঙ্কার। লতি ভয়ে কেঁপে উঠলো,
‘আর নয় – ছাতে বসে এমনিতেই গা ছমছম করছে তার মধ্যে আবার মহারাজের ডাক – চলো সবাই নিচে শুতে – আমার এখানে ভয় করছে।’