খেলাঘরখেলাঘর


মা ঘরে ঢোকেন। চোখ ফোলা ফোলা, মুখে কান্নার গন্ধ। “মা গো, তুমি কাঁদছো কেন? সোনালীর অসুখ করেছে বুঝি?” অবাক তুতুল প্রশ্ন করে। সোনালী ওর ছোট বোন, মাসীমণির মেয়ে।
ঠোঁট কামড়ান মা। “কই সোনা, কাঁদিনি তো, কিচ্ছু হয়নি তো!” তিনি তুতুলকে বুকের কাছে টেনে আনেন। লজ্জা পায় তুতুল। আবদারের সুরে বলে, “একটা গল্প বলো না, মা।”
“গল্প? বেশ – কিন্তু ঘুমোবে তাহলে?”
“সত্যি বলছি মা, তোমার পাশে শুয়ে ঘুমোব।” তুতুল আলগোছে মা’র আঁচল চেপে ধরে।

“এক দেশে এক রাজা ছিলো। সে ছিলো ভীষণ দুষ্টু –”
“মা, রাজারা খালি দুষ্টুই হয়, তাই না? আমার বন্ধু রাজা কিন্তু একটুও দুষ্টুমি করে না।” বাধা দিয়ে বলে তুতুল।
“তাই বুঝি? তা, এই রাজাটার দুষ্টুমিতে কিন্তু দেশের লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। কেউ হয়তো ইয়া বড়ো এক কুমড়ো ফলিয়েছে, রাজা অমনি এসে হাজির। ‘দিস্‌ তো পাঠিয়ে – রানি কুমড়োর ছক্কা বানিয়ে দেবে, খাবো’, বলে হুকুম ঝেড়ে চলে যেতো। কুমোর মাটির গামলা বানিয়েছে, ‘আরে, আমার গরুকে খাওয়াতে লাগবে’, বলে ট্যাঁকে করে হাওয়া। কারো গাছে হয়তো কলা ধরেছে, ‘ইস, হাতি বেচারা আমার না খেয়ে মরছে’, বলে নিমেষে ঝাড়কে ঝাড় সাফ!
“তবু মানুষ কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু সেবার হলো ভীষণ জলের কষ্ট। প্রচণ্ড গরমে নদী-নালা শুকিয়ে গেলো। তেষ্টায় মানুষের বুকের ছাতি ফাটতে লাগলো। সবাই তখন দল বেঁধে রাজার কাছে গেলো।
“মহারাজ, তেষ্টায় যে মরে গেলাম!” কেঁদেকেটে বলে তারা।
“রাজা এর মধ্যেই পুকুর, কুয়োর যা জল ছিলো তুলে এনে জমিয়েছে প্রাসাদের সব বিরাট বিরাট স্ফটিকের চৌবাচ্চায়। তাই সে চোখ ঘুরিয়ে বললো, ‘যা যা, জল নেই তো আমি কী করবো?’
“মহারাজ, কয়েকটি গভীর দীঘি কাটান – তবে জলকষ্ট ঘুচবে”, বলে এক বুড়ো প্রজা।
“ফুঃ, দীঘি কাটাবে! আমার সোনার পিকদানিটা ভেঙে গেছে, তাই সারাবার পয়সাই জুটছে না, আর ওনাদের যতসব উটকো আবদার!” রেগেমেগে বলে রাজা।
“সুজন নামে এক চাষীর ছেলে ছিলো। সে তখন এগিয়ে এসে বললো, ‘বেশ মহারাজ, তাহলে আমরা নিজেরাই শাবল, কুড়ুল, কোদাল যা পাই তাই দিয়ে দীঘি খুঁড়বো।’
“মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে রাজার মেজাজ গেলো গরম হয়ে। ‘যা, তাহলে মর গে!’ বলে সে গটমটিয়ে উঠে চলে গেলো।
“লোকজন সবাই কিন্তু সত্যি সত্যিই হৈ-হৈ করে কাজে নেমে পড়লো। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা খুঁড়ে ফেললো এক বিরাট দীঘি, তাতে ভরা টলটলে নীল জল।
“সবার মুখে খুশির হাসি। কিন্তু দেখতে না দেখতে তা মিলিয়ে গেলো – যখন লোকলস্কর নিয়ে রাজা এসে সেখানে হাজির হলো।
“অ্যাই ভাগ, ভাগ! আমি রাজা, এই জল আমার।” বলে সব্বাইকে হঠিয়ে দিলো সে। হাতি নামিয়ে দিলো জলে। তীরে বসালো পাহারা। মুখ চূণ করে ফিরে গেলো প্রজারা।
“কাণ্ড দেখে মাটির ভীষণ রাগ হলো। রাজার দুষ্টুমির সাজা দেবার জন্য সে রাতারাতি দীঘির সব জল লুকিয়ে ফেললো। পরদিন সকালে রাজা এসে দেখে – ও মা, সব যে আবার শুকিয়ে খটখট! অনেক তর্জন-গর্জন করলো সে, কিন্তু করেই বা কী ফল!
“দেশের লোক ওদিকে তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ। কত ছোট্ট সোনা ঠোঁট চাটতে লাগলো, কত দাদু-ঠাকুমা মরেই গেলো – তবু না হলো একছিটে বৃষ্টি, না পেলো কেউ একফোঁটা জল।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।